রূপকথার মহানায়ক

275

১৯২০ সালের ১৭ মার্চ। ভারতবর্ষের অজানা ও নিভৃত প্রত্যন্ত গ্রাম নাম ‘টুঙ্গিপাড়া’ যে গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে মধুমতি নদী। প্রত্যন্ত এই গ্রামে যে শিশু ভ‚মিষ্ঠ হয়েছিলো, একসময় সে জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত হবে, তার নাম ও যশ ছড়িয়ে পড়বে দূর-দূরান্তেÍ এতটুকু স্বপ্ন হয়তোবা তার গর্বিত পিতা-মাতার ছিল। পরাধীন দেশে মানুষের স্বপ্ন কতটুকুইবা পূর্ণতা পায়? আর দূর-দূরান্তে যশ ছড়িয়ে পড়া! সে কত দূরকে বোঝাবে? গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া গ্রামে শেখ লুৎফর রহমান ও শেখ সায়েরা খাতুনের ঘর আলোকিত করে ফুটফুটে যে ছেলের জন্ম হয়েছিল পরবর্তিতে তিনি হয়ে উঠেছিলেন বাঙালির ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এ মহান নেতার ৫৫ বছরের জীবনের প্রায় অর্ধেক শৈশব, কৈশোর, তারুণ্য আর যৌবনের বিশাল এক অংশ কেটে যায় ভবিষ্যতের প্রস্তুতিতে, পরাধীন ভারতবর্ষে। তারপর ১৯৪৭ সালের আগস্ট থেকে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পর্যন্ত ২৪ বছর কেটে যায় নবগঠিত রাষ্ট্র পাকিস্তানে বাংলার মানুষের এবং বাঙালির অধিকার আদায়ের সংগ্রামে। জীবনের এই অধ্যায়ের প্রায় পুরো সময়টাই কেটে গেছে পাকিস্তানিদের হাতে প্রতিনিয়ত হয়রানির শিকার হয়ে এবং কারা অভ্যন্তরে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সশস্ত্র যুদ্ধ শুরু করলে ২৬ মার্চের সূচনালগ্নে গ্রেফতার হওয়ার আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতির উদ্দেশ্যে বলেন, ‘এটাই হয়ত আমার শেষ বার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। পাকিস্তান সেনাবাহিনী অতর্কিতে পিলখানার ইপিআর ঘাঁটি, রাজারবাগ পুলিশ লাইন আক্রমণ করেছে এবং শহরের লোকদের হত্যা করছে। ঢাকা, চট্টগ্রামের রাস্তায় রাস্তায় যুদ্ধ চলছে। আমি বিশ্বের জাতিগুলোর কাছে সাহায্যের আবেদন করছি। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা বীরত্বের সঙ্গে মাতৃভ‚মি মুক্ত করার জন্য শত্রুদের সঙ্গে যুদ্ধ করছে। সর্বশক্তিমান আল্লাহর নামে আপনাদের কাছে আমার আবেদন ও আদেশ- দেশকে স্বাধীন করার জন্য শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যান। আপনাদের পাশে এসে যুদ্ধ করার জন্য পুলিশ, ইপিআর, বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও আনসারদের সাহায্য চান। কোন আপোস নেই, জয় আমাদের হবেই। আমাদের পবিত্র মাতৃভ‚মি থেকে শেষ শত্রুকে বিতাড়িত করুন। সব আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী এবং অন্য দেশপ্রেমিক ও স্বাধীনতাপ্রিয় লোকদের এ সংবাদ পৌঁছে দিন। আল্লাহ আমাদের মঙ্গল করুন। জয় বাংলা।

একদিকে বাংলার মানুষ মুক্তিযুদ্ধে হানাদারদের বিরুদ্ধে লড়াই করছেÑঅন্যদিকে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের মিয়ানওয়ালী কারাগারে বন্দী। তাঁর বিচার চলছে। বিচার চলাকালে ডিফেন্স লইয়ার হিসেবে একে ব্রোহীকে নিয়োগ দিতে চেয়েছিল পাকিস্তান সরকার। বঙ্গবন্ধু সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলেন, আই উইল নট ডিফেন্ড মাইসেলফ। বিকজ ইয়াহিয়া খান ইজ দি প্রেসিডেন্ট অব পাকিস্তান। ইয়াহিয়া খান ইজ দি চিফ মার্শাল’ল অ্যাডমিনিস্ট্রেটর। হি ইজ দি কনফার্মিং অথরিটি অব মাই ডেথ সেনটেন্স। অলরেডি হি টোল্ড, মুজিব ইজ এ ট্রেইটর। যেহেতু রায় দেওয়া হয়ে গেছে। সুতরাং আমি নিজকে ডিফেন্ড করবো না। ইয়াহিয়া খান যখন ভুট্টোর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে অনুরোধ করেছিলেন, এবং বলেছিলেন আমার একটা অসম্পূর্ণ কাজ রয়ে গেছে সেটা হলো মুজিবকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলানো। ক্ষমতা হস্তান্তরের আগে আমি এই কাজটি করতে চাই। ভুট্টো সাথে সাথে মিয়ানওয়ালী কারাগারের প্রিজন গভর্নর হাবীব আলীকে মেসেজ দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে কারাগার থেকে সরিয়ে হাবীব আলীর বাসভবন চশমা ব্যারাজে নিয়ে গিয়েছিলেন। যাতে কমান্ডো গিয়ে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে না পারে। তারপর ভুট্টো বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে বিভিন্ন প্রস্তাব দিলে বঙ্গবন্ধু তা প্রত্যাখ্যান করেন এবং ৮ জানুয়ারি ১৯৭২, শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানি কারাগার হতে মুক্তি দিতে বাধ্য হন। মুক্তি পেয়ে বঙ্গবন্ধু পিআইএর একটি বিশেষ বিমানে লন্ডনের উদ্দেশে যাত্রা করেন। ৮ জানুয়ারি সকাল ৭টায় বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসে প্রচারিত খবরে বলা হয়েছিল ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান বিমানযোগে লন্ডনে আসছেন।’ বিমানবন্দরে অবতরণ করার পর ব্রিটিশ সরকার বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রীয় অতিথির মর্যাদা দেয়। এবং ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি ব্রিটিশ রাজকীয় বিমান বহরের কমেট জেটে লন্ডন থেকে বিজয়ীর বেশে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। সারা দেশে আনন্দ ও উচ্ছ¡াসের বন্যা বয়ে যায়। দেশের সর্বস্তরের লাখো জনতা তেজগাঁ পুরাতন বিমানবন্দরে তাঁকে বীরোচিত অভ্যর্থনা জানায়। লন্ডন থেকে প্রকাশিত দৈনিক গার্ডিয়ান পত্রিকার ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারির সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়েছিল : ‘শেখ মুজিব ঢাকা বিমানবন্দরে পর্দাপণ করা মাত্র নতুন প্রজাতন্ত্র এক সুদৃঢ় বাস্তবতা লাভ করে।’ ব্যক্তিত্বে ও নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধু বিশ্ব মিডিয়ার নজর কেড়েছিলেন। আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় তাকে তুলে ধরা হয়েছে ‘মহান নেতা’ ও ‘অসামান্য ব্যক্তিত্ব’ শিরোনামে। নিউজউইক ম্যাগাজিন তাদের প্রচ্ছদে বঙ্গবন্ধুকে ‘পোয়েট অব পলিটিকস’ আখ্যায়িত করে নিবন্ধ প্রকাশ করে। মুক্তির পরের সাড়ে তিন বছর সময় অতিবাহিত হয় একদিকে যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন বাংলাদেশকে গড়ে তোলার নিরবচ্ছিন্ন কঠোর প্রচেষ্টায় এবং একই সঙ্গে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্ত সামলাতে। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে বঙ্গবন্ধু যে পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছিলেন, তা তিনি বাস্তবায়ন করে যেতে পারেননি। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট সপরিবারে তাকে হত্যার মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি পরাজিত শক্তি বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা পিছিয়ে দিয়েছিল। প্রতিবছর আগস্ট মাস সমাগত হলে বাঙালী শোকাতুর হয়ে পড়ে। সেইদিন ঘৃণ্য নরপশুরা শুধু একজন বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেনি, তারা একে একে হত্যা করেছে বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, বঙ্গবন্ধুর পুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল, শিশুপুত্র শেখ রাসেলসহ পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজী জামালকে। জঘন্যতম এ হত্যাকান্ড থেকে রক্ষা পাননি বঙ্গবন্ধুর ভাই শেখ নাসের, ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত, ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মণি, বেগম আরজু মণি, কর্নেল জামিলসহ ১৭ জন। ঘাতকদের নিক্ষিপ্ত গোলায় মোহাম্মদপুরে কয়েকজন সাধারণ নারী-পুরুষও মারা যায়। এসব হত্যার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের মহান আদর্শ ও চেতনাকে মুছে ফেলার চেষ্টা শুরু হয়। যার ডাকে জেগেছিল সাড়ে সাত কোটি প্রাণ রণাঙ্গনে, সেই কণ্ঠকে স্তব্ধ করাই শুধু নয়, জাতির বিকাশকে স্তিমিত করার ঘৃণ্য চেষ্টাকে অবলোকন করেছে বিশ্ববাসী। কিন্তু তারা শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি। ফিন্যানশিয়াল টাইমস ১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট তাকে নিয়ে লিখেনÑবঙ্গবন্ধু না থাকলে কখনই বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না। বিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিন এর প্রচ্ছদে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে শিরোনাম করে ‘বাংলাদেশ : ফ্রম জেইল টু পাওয়ার’। দ্য গার্ডিয়ানে লেখা হয় ‘শেখ মুজিব ছিলেন এক বিস্ময়কর ব্যক্তিত্ব’। পশ্চিম জার্মানির পত্রিকায় ‘শেখ মুজিবকে চতুর্দশ লুইয়ের সঙ্গে তুলনা করা হয়। জনগণ তার কাছে এত প্রিয় ছিল যে, লুই ইয়ের মতো তিনি এ দাবি করতে পারেন, আমি-ই রাষ্ট্র। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে বঙ্গবন্ধু যে পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছিলেন, তা তিনি বাস্তবায়ন করে যেতে পারেননি। প্রয়াত ভারতীয় বিজ্ঞানী ও সাবেক রাষ্ট্রপতি এ. পি. জে. আবদুল কালামের ভাষায় বঙ্গবন্ধু নিজেই ছিলেন ‘ঐশ্বরিক আগুন’ এবং তিনি নিজেই সে আগুনে ডানা যুক্ত করতে পেরেছিলেন। ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ভাষায় তিনি হলেন এ দেশের মুক্তিদাতাও বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের বন্ধু। কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রো বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হিমালয়ের সঙ্গে তুলনা করেছেন। শ্রীলংকার সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী লক্ষণ কাদির গামা উপমহাদেশের এ মহান নেতা সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘দক্ষিণ এশিয়া গত কয়েক শতকে বিশ্বকে অনেক শিক্ষক, দার্শনিক, দক্ষ রাষ্ট্রনায়ক, রাজনৈতিক নেতা ও যোদ্ধা উপহার দিয়েছে। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান সবকিছুকে ছাপিয়ে যান, তার স্থান নির্ধারিত হয়ে আছে সর্বকালের সর্বোচ্চ আসনে। সাবেক ইরাকি প্রেসিডেন্ট প্রয়াত নেতা সাদ্দাম হোসেন বলেছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হচ্ছেন সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের প্রথম শহীদ। তাই তিনি অমর।’ ফিলিস্তিনি নেতা ইয়াসির আরাফাত বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বলেন, ‘আপোসহীন সংগ্রামী নেতৃত্ব আর কুসুম কোমল হৃদয় ছিল মুজিব চরিত্রের বৈশিষ্ট্য।’নোবেল বিজয়ী উইলিবান্ট বলেন, ‘মুজিব হত্যার পর বাঙালিদের আর বিশ্বাস করা যায় না, যারা মুজিবকে হত্যা করেছে তারা যে কোনো জঘন্য কাজ করতে পারে। ’বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার খবর শুনে কাস্ট্রো বলেছিলেন, ‘শেখ মুজিবের মৃত্যুতে বিশ্বের শোষিত মানুষ হারাল তাদের একজন মহান নেতাকে, আমি হারালাম একজন অকৃত্রিম বিশাল হৃদয়ের বন্ধুকে। মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত এতটাই দুঃখ পেয়েছিলেন যে, তিনি আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘তোমরা আমারই দেওয়া ট্যাংক দিয়ে আমার বন্ধু মুজিবকে হত্যা করেছ! আমি নিজেই নিজেকে অভিশাপ দিচ্ছি।’ ১৯৭৫ সালের সেই ভোরে কি বৃষ্টি হয়েছিল? খুব ভোরবেলা টেলিফোনের শব্দে ঘুম ভাঙ্গে বঙ্গবন্ধুর, তিনি শুনতে পান আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বাসায় হামলা হয়েছে, গোলাগুলি হচ্ছে। তিনি টেলিফোন করেছিলেন পুলিশকে। কিন্তু তিনি কোনো দিনও ভাবেননি তার বাড়িতেও যে হামলা হতে পারে! ভারত ও আমেরিকানরা সাবধান করে দিয়েছিল, বিশেষ প্রতিনিধি বাড়িতে এসে খবর দিয়েছিল, ও সাবধান করে দিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, বাংলার মানুষ কোনো দিনও আমার ক্ষতি করবে না। পাকিস্তানি জেনারেলরা সাহস পায়নি গায়ে হাত দেয়ার, বাঙালিরা কোত্থেকে পাবে? কিন্তু তিনি যখন দেখলেন, তার বাড়িতেও আক্রমণ করা হয়েছে, বাইরে গোলাগুলি হচ্ছে, তখন কী ভাবছিলেন বঙ্গবন্ধু? যখন দেখলেন, শেখ কামালের বুলেটবিদ্ধ শরীর থেকে রক্তের ধারা বইছে, তখন এই বাঙালিদের ওপর থেকে আস্থা কি টলে যাচ্ছিল? না কারণ, বঙ্গবন্ধু পুলিশকে বলেছিলেন, পাল্টা গুলি করা বন্ধ করো। গুলি বন্ধ হলো। খুনিরা ঢুকে গেল বাড়িতে। বঙ্গবন্ধু সিঁড়ি দিয়ে নামছিলেন। পরনে লুঙ্গি, পাঞ্জাবি, হাতে পাইপ আর দেশলাই। ‘তোরা কী চাস?’ বঙ্গবন্ধুর এই প্রশ্নের জবাবে ওরা যখন গুলি করল, তখনো কি বাঙালিদের ওপর থেকে আস্থা হারাননি? গুলিবিদ্ধ হয়ে সিঁড়িতে পড়ে যেতে যেতে কি ভেবেছিলেন বঙ্গবন্ধু? ওরা বাংলার মানুষ, ওরা আমার কোনো ক্ষতি করতে পারে না! বলেছিলেন, আমি বাঙালি, বাংলা আমার ভাষা, বাংলা আমার দেশ… আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি। হয়তো তিনি ভেবেছিলেন ‘এই দেশের মানুষের কাছে তার ঋণ ছিল, তারা তাকে খুব ভালোবাসত, তার রক্ত দিয়ে যদি সেই ঋণ কিছুটা শোধ যায়, তবে তাই হোক…। হায়রে ঘাতক বাঙালি! তোমরা জাতির পিতাকে নয়, পুরো বাঙালি জাতির আশা-আকাংক্সক্ষাকে হত্যা করেছিলে। সেদিন ঘাতকদের বুলেটের আঘাতে নশ্বর মুজিব অবিনশ্বরতার পথে চলে গেলেন চিরতরে। তাঁর জীবনাবসানে উত্থান হলো চিরন্তন মুজিবের। ইতিহাস তাকে নিয়ে গেল ধরাছোঁয়ার ঊর্ধ্বে রূপকথার মহানায়কের আসনে, তাঁর যথাযোগ্য স্থানে। এই পৃথিবীর কোনো ষড়যন্ত্র আর কোনো দিন তাঁকে স্পর্শ করতে পারবে না। বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে স্বাধীনতার ইতিহাস বিকৃত ও ¤øান করার বহুবিধ চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু সে-সব অসত্য পরাজিত হয়ে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক জীবনে আজ ইতিহাসের সত্য সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দেশের তরুণ প্রজন্মসহ সকলেই আজ স্বাধীনতার প্রকৃত ইতিহাস জানতে সক্ষম হচ্ছে। পৃথিবীতে অনেক নেতা এসেছেন, অনেক নেতা আসবেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মতো এরকম বিচক্ষণ, সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো নেতা পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেছেন বলে জানা নেই। তার জীবনী পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বঙ্গবন্ধুর প্রতিটি দিন, প্রতিটি মুহূর্ত ছিল সংগ্রামী। ২০২০ সালের ১৭ মার্চ বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী পালন করতে চলেছে-যা হবে মুজিববর্ষ। আশা করি সরকার ‘মুজিববর্ষ’ পালনের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর জীবনী পরিপূর্ণভাবে তুলে ধরার মাধ্যমে তার মাহাত্ম বিশ^ময় ছড়িয়ে দিতে সমর্থ হবে। ইতোমধ্যে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশত বার্ষিকীকে চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ইনস্টিটিউট ফর পিস এন্ড লিবার্টি: জন্ম শতবার্ষিকী স্মারক’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত গ্রহন করেছে। এর কাজ হবে বঙ্গবন্ধুর জীবন দর্শনের আলোকে মানব মুক্তি, মুক্তি সংগ্রাম, বৈষম্যহীন বিশ্ব গড়ে তোলাসহ সমসাময়িক বিশ্বজনীন বিষয় নিয়ে দেশি-বিদেশি গবেষকদের কাজ করার সুযোগ দেওয়া। এই প্রতিষ্ঠানটি প্রথা মাফিক কোনো ডিগ্রি না দিলেও গবেষণার স্বীকৃতি দেবে। এতে আগামী শতবর্ষ ধরে বঙ্গবন্ধুর প্রাসঙ্গিকতা উজ্জ্বলভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে।

লেখক : প্রাবন্ধিক, শিক্ষক