রাসেলের চায়ের কেটলি : আস্তিক নাস্তিক বিতর্কের সঙ্গে এর কী সম্পর্ক

89

মনে করুন আপনি আপনার বন্ধুর সঙ্গে চা পান করছেন। আপনার বন্ধু আপনাকে বললো, সৌরজগতে পৃথিবী আর মঙ্গলগ্রহের মাঝখানে কোন এক জায়গায় একটি চায়ের কেটলি আছে যেটি সূর্যকে প্রদক্ষিণ করছে।
আপনি আপনার বন্ধুকে এটি প্রমাণ করার জন্য চ্যালেঞ্জ করবেন, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তখন আপনার বন্ধু আপনাকে বলবে, এটি এত ছোট যে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দূরবীণ দিয়েও এটি দেখা যাবে না।
কাজেই আপনার বন্ধুর পক্ষে প্রমাণ করা সম্ভব নয় যে, এরকম একটি টি পট বা চায়ের কেটলি সত্যিই আছে। আবার আপনার পক্ষেও দেখানো সম্ভব নয় যে এটি আসলে নেই।
এই উভয়সংকটে তাহলে কার কাঁধে বর্তাবে এটি প্রমাণের দায়িত্ব ?
এই আপাত নির্দোষ উদাহারণকে কেন্দ্র করে বহু দশক ধরে উত্তপ্ত বিতর্ক চলছে নাস্তিক আর আস্তিকদের মধ্যে।
এই উদাহারণটি দিয়েছিলেন খ্যাতনামা ব্রিটিশ দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল। ১৯৫২ সালে তিনি একটি নিবন্ধ লেখেন, যার শিরোণাম ছিল “ঈশ্বর বলে কি কেউ আছে?” সেখানে তিনি প্রথম এই টি পট বা চায়ের কেটলির উপমাটি দেন। সেই থেকে এটি ‘রাসেলের টিপট’ নামেই পরিচিত।
ব্রিটিশ জীববিজ্ঞানী রিচার্ড ডকিন্স এযুগের নিরীশ্বরবাদী আন্দোলনের সবচেয়ে সরব কন্ঠ। তিনি তার অনেক বক্তৃতায় এবং সাক্ষাৎকারে এই ‘রাসেলের কেটলি’র উদাহারণ দিয়েছেন।
কিন্তু সৃষ্টিকর্তা বা ঈশ্বর আছেন কি নেই, তার সঙ্গে রাসেলের কেটলির কী সর্ম্পক?
পবিত্র চায়ের কেটলি
মহাশূণ্যে কোন চায়ের কেটলি থাকার ধারণা বার্ট্রান্ড রাসেল নিজেও আজগুবি বলে উড?িয?ে দিয়েছেন। কিন্তু এরকম একটি উদাহারণ তিনি দিয়েছিলেন ঈশ্বর বা সৃষ্টিকর্তার ধারণা আসলে তার কাছে কতটা আজগুবি মনে হয় সেটি ব্যাখ্যা করার জন্য।
সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী এই দার্শনিক ১৯৫০ সালে লিখেছিলেন, “যদি প্রাচীন কোন পুস্তকে মহাশূণ্যে এরকম একটি চায়ের কেটলির অস্তিত্বের কথা থাকতো, যদি প্রতি রোববার এটিকে পবিত্র সত্য হিসেবে শেখানো হতো সবাইকে, সব স্কুলে শিশুদের মনে এই ধারণা গেঁথে দেয়া হতো, তখন কেউ যদি এটির অস্তিত্বে বিশ্বাস আনতে ইতস্তত করতো, সেটাকে পাগলামির চিহ্ন বলেই মনে করা হতো। এ নিয়ে সন্দেহপোষণকারী যে কাউকে হয়তো মনোচিকিৎসকের কাছে পাঠানো হতো— অথবা তাকে জেরা করতে পাঠানো হতো।”
বার্ট্রান্ড রাসেল ছিলেন নাস্তিক। তার মতে, বিশ্বের বহু মানুষ ঈশ্বরে বিশ্বাস করে বলেই এটা ধরে নেয়া যাবে না যে ঈশ্বর বলে কিছু আছে। তিনি আসলে যেটা বলেছিলেন তার মানে হলো, কোন কিছুর অস্তিত্ব যে প্রমাণ করা অসম্ভব, সেটাকেই বিষয়টির অস্তিত্বের প্রমাণ বলে ধরে নেয়া যাবে না।
অদৃশ্য ড্রাগন
ঈশ্বর বলে যে কিছু নেই এবং সেটা যে প্রমাণ করারও কোন দরকার নেই, সেটির পক্ষে এরকম একটি উদাহারণ দেন নাস্তিক বা নিরীশ্বরবাদীরা।
তাদের যুক্তিটা এরকম : ঈশ্বরের অস্তিত্বের কোন প্রমাণ নেই, কাজেই তাতে বিশ্বাস করারও কোন কারণ নেই।
মার্কিন বিজ্ঞানী কার্ল সাগান ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত ‘দ্য ডেমন হন্টেড ওয়ার্ল্ড’ বইতে লিখেছেন, “যেসব দাবি পরীক্ষা করা যায় না আর যেসব ধারণা প্রমাণ করার কোন উপায় নেই , সেগুলো কার্যত অর্থহীন, সেগুলো আমাদের যতই অনুপ্রাণিত করুক না কেন?”
কার্ল সাগান আসলে বার্ট্রান্ড রাসেলের পদাংক অনুসরণ করে তার নিজের উপমাটি দিয়েছিলেন: তিনি দাবি করেছিলেন তার গ্যারেজে এক অদৃশ্য ড্রাগন বাস করে। অর্থাৎ তার কথা হলো, এরকম একটি ড্রাগন যে আছে, এটি প্রমাণ করার কোন উপায় নেই। কাজেই এতে বিশ্বাস করারও দরকার নেই।
এখন কথা হলো কোন কিছুর অস্তিত্বের প্রমাণের দায়িত্ব কার?
আস্তিকরা অবশ্য বলে যে ‘রাসেলের টিপটের’ উপমা তারা মানতে নারাজ, তারা মনে করে না যে ঈশ্বরের অস্তিত্বের পক্ষে তাদের কোন প্রমাণ খুঁজে বের করার দরকার আছে।
কলম্বিয়ার একজন খ্রীষ্টান যাজক এবং দার্শনিক জেরার্ডো রেমোলিনা ২০১৭ সালে রিচার্ড ডকিন্সের সঙ্গে এক বিতর্কে বলেছিলেন, “রাসেলের টিপট হচ্ছে একেবারেই কল্পকাহিনী। ঈশ্বরের বাস্তবতার সঙ্গে এর তুলনা চলে না। আমাদের প্রকৃতি, আমাদের জীবন, সব কিছুই ঈশ্বরের কল্যাণে। “
আরেক দার্শনিক নটরডেম ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক আলভিন প্লানটিঙ্গার যুক্তি হচ্ছে রাসেলের টিপটের উপমার গোড?াতেই গলদ আছে।
২০১৪ সালে তিনি নিউ ইয়র্ক টাইমসে একটি সাক্ষাৎকার দেন। এতে তিনি বার্ট্রান্ড রাসেলের যুক্তি খন্ডন করে বলেন, “কোন দেশ যদি সত্যিই মহাকাশে কোন টিপট পাঠাতো, সেটা বিরাট খবর হতো। আমরা সবাই সেটা জানতাম। কিন্তু আমরা কেউ এরকম শুনিনি। কাজেই রাসেলের টিপটের উপমার বিরুদ্ধে বিস্তর যুক্তি আছে।”
কাজেই আস্তিকতাকে যে বার্ট্রান্ড রাসেল মহাকাশে টিপট থাকার বিশ্বাসের সঙ্গে তুলনা করেছেন এবং আস্তিকদের চ্যালেঞ্জ করছেন এরকম একটি টিপট আছে তা প্রমাণ করার জন্য, তা প্রত্যাখ্যান করছেন অধ্যাপক প্লানটিঙ্গা। তিনি বলছেন, ঈশ্বর যে নেই সেটি প্রমাণের দায়িত্ব আসল নাস্তিকদের ওপরই বর্তায়।