রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন এবং ফররুখ আহমদ

298

বাঙালি “মুসলিম রেনেসাঁর কবি”ফররুখ আহমদ (১০ জুন ১৯১৮ – ১৯ অক্টোবর ১৯৭৪) যেমন ছিলেন বাংলার অধঃপতিত মুসলিম সমাজের সম্মুখভাগের কান্ডারী, ঠিক তেমনই বাঙালির ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতি কবি ছিলেন গভীর মমতায় আবিষ্ট। একজন কবি হিসেবে তাঁর কবিতা প্রকরণকৌশল, শব্দচয়ন এবং রূপক-প্রতীকে অনন্য বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। বিস্ময়পুরুষ কবি ফররুখ আহমদ তাঁর কবিতায় আধুনিকতার সকল উপাদান ঠিক রেখে সৃষ্টি করেছেন নিজস্ব কাব্যভাষা। বাংলা ভাষার একজন শক্তিমান কবি হিসেবে ঐতিহাসিক রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে কবি ফররুখ আহমদ ছিলেন সম্মুখ সারিতে। সাতচল্লিশে দেশভাগ হবার প্রাক্কালেই কবি ফররুখ আহমদ পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার প্রতি দৃঢ় সমর্থন এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জোর দাবি জানিয়েছিলেন। “বাংলাদেশের স্বাধীনুা যুদ্ধ দলীলপত্র”, ১ম খÐের ০৯ নং পৃষ্ঠায় দেশভাগের পূর্বেই রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষের সৈনিক হিসেবে ফররুখ আহমদের নাম উল্লেখ করে তথ্য সন্নিবেশিত করা হয়েছে, “আব্দুল হক, ফররুখ আহমদ প্রমুখ আরও অনেকের রচনায় বিভাগ-পূর্বকালেই (সাবেক) প‚র্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার প্রসঙ্গ আলোচিত হয়েছিল।”
ফররুখ আহমদ নিরহংকারী এবং সদালাপী ব্যক্তি হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন। সৈয়দ বংশের লোক হওয়ার পরও নিজের নামের প্রথমে সৈয়দ না লেখাটাও তার উজ্জ্বল প্রমাণ বহন করে। কবি ফররুখ আহমদ স্কুল জীবনে কবি গোলাম মোস্তফা, কথাসাহিত্যিক আবুল ফজল ও কবি এমএ হাশেমের মতো গুণীজনদের পেয়েছিলেন। নিঃসন্দেহে তাঁদের জীবনদর্শনে তিনি কিছুটা হলেও প্রভাবিু ছিলেন।
১৯৪৩ সালে ফররুখ আহমদ কর্মজীবন শুরুকরেনকলকাতায় আইজিপ্রিজন অফিসে। ১৯৪৪ সালে সিভিল সাপ্লাইতে এবং ১৯৪৬ সালে জলপাইগুড়িতে একটি ফার্মে চাকরি করেন। ১৯৪৫ সালে তিনি মাসিক “মোহাম্মদী”র ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করেন। তবে এসবের কোথাও তিনি স্থায়ী হতে পারেননি।১৯৪৮ সালে দেশ ভাগের পরকবি ফররুখ আহমদ কলকাতা থেকে ঢাকায়স্থায়ীভাবে চলে আসেন এবং ঢাকা বেুারে যোগ দেন। প্রথমে অনিয়মিত হিসেবে এবং পরে নিয়মিত স্টাফ আর্টিস্ট হিসেবে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন। ছাত্র জীবনের মাঝামাঝি সময় হতে দীর্ঘ কর্মজীবনের শেষ পর্যন্ত তিনি বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতি তথা বাংলা ভাষার জন্য সংগ্রাম করে গেছেন।কবি ফররুখ আহমদ ১৩৫৪ বঙ্গাব্দের আশ্বিন (সেপ্টেম্বর-অক্টোবর ১৯৪৭) সংখ্যায় মাসিক সওগাত-এ “পাকিস্তান : রাষ্ট্রভাষা ও সাহিত্য” নিবন্ধে বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা না করার গভীর গোপন ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা জানান। কবি ফররুখ আহমদ ঝাঁঝালো ভাষায় লিখেন, “গণতান্ত্রিক বিচারে যেখানে সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা হওয়া উচিত, সেখানে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষাকে পর্যন্ত যাঁরা অন্য একটি প্রাদেশিক ভাষায় রূপান্তরিত করতে চান তাঁদের উদ্দেশ্য অসৎ। পূর্ব পাকিস্তানের সকল অধিবাসীর সাথে আমিও এই প্রকার অসাধু প্রতারকদের বিরুদ্ধে আমার তীব্রপ্রতিবাদ জানাচ্ছি।”
উল্লেখিণ নিবন্ধের শুরুর দিকে তিনি বলেন, “পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হবে এ নিয়ে যথেষ্ট বাদানুবাদ চলছে। আর সবচাইতে আশার কথা এই যে, আলোচনা হয়েছে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে, জনগণ ও ছাত্রসমাজ অকুণ্ঠভাবে নিজের মতামত ব্যক্ত করেছে। সুতরাং এটা দৃঢ়ভাবেই আশা করা যায় যে, পাকিস্তানের জনগণের বৃহৎ অংশের মতানুযায়ী পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা নির্বাচিত হবে। যদি তাই হয়, তাহলে এ কথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে, বাংলাভাষাই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে।”
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠারও কয়েক বছর পূর্বে কবি ফররুখ আহমদ “উর্দু বনাম বাংলা” শীর্ষক ব্যাঙ্গাত্মক সনেট কবিতায় রাষ্ট্রভাষা বাংলার সপক্ষে দৃঢ় মনোভাব পোষণ করেন।পাকিস্তানী ক্ষমতাশালীদের প্রভাবে পড়ে বাংলাভাষী হয়েও ক্ষুদ্র স্বার্থে বাংলার বিরোধিতাকারীদের বিরুদ্ধেই তিনি ‘উর্দু বনাম বাংলা’ শিরোনামের কবিতাটি লিখেছিলেন। এই তথ্য এবং পুরো কবিতাটি “বাংলাদেশের স্বাধীনুা যুদ্ধ দলীলপত্র”, ১ম খÐের ১০ নং পৃষ্ঠায় গুরুত্বের সাথে সন্নিবেশিত আছে। কবিতাটিতে তিনি সুযোগ-সুবিধার প্রত্যাশায় যে সকল বাঙালি উর্দুর পক্ষে কথা বলছিলো তাদের তীব্র ভাষায় কটাক্ষ করেন,-
“দুই শো পঁচিশ মুদ্রা যে অবধি হয়েছে বেুন
বাংলাকে তালাক দিয়ে উর্দুকেই করিয়াছি নিকা।
বাপান্তর শ্রমের ফলে উড়েছে আশার চামচিকা
উর্দুনীল আভিজাত্য (জানে তা নিকট বন্ধুগণ)।”
অপর কবিতায় কবি ফররুখ আহমদ মাতৃভাষা আন্দোলনের সকল শহিদ, সকল ভাষা শহিদ এবং শহিদ মিনারকে নিয়ে লিখেছেন,
“যাদের বুকের রক্তে মাতৃভাষা পেয়েছে সম্মান
সঙ্গীনের মুখে যারা দাঁড়িয়েছে নিষ্পাপ, অম্লান
মানে নাই কোন বাধা, মৃত্যু ভয় মানে নাই যারা
যাদের স্মরণ চিহ্ন এ মিনার কালের পাহারা
এখানে দাঁড়াও এসে মনে কর তাদেরি সে দান
যাদের বুকের রক্তে মাতৃভাষা পেয়েছে সম্মান।”
বাংলার বিরোধীতাকারীরা যখন উর্দুকে বর্ণমালার বিচারে আরবির কাছাকাছি এবং ধর্মীয় ভাষা হিসেবে সাব্যস্ত করতে ব্যস্ত ছিলো, কবি ফররুখ আহমদ তখন নিজের মাতৃভাষা বাংলাকে “খোদার সেরা দান” আখ্যায়িত করে বাঙালি মুসলমানের মনে নুুন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন। ‘ভাষার গান’ কবিতায় মাতৃভাষা বাংলার শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করে কবি লিখেছেন,
“ডালে ডালে পাখির বাসা,
মিষ্টি মধুর পাখির ভাসা
সাত সাগরে নদীর বাসা
কুলুকুলু নদীর ভাষা।
হাজার সুরে, হাজার ভাষায়
এই দুনিয়া ঘেরা
আর মাতৃভাষা বাংলা আমার
সকল ভাষার সেরা।”
পবিত্র কোরআনের সূরা ইব্রাহিমের ৪ নং আয়াতে বলা হয়েছে, “আমি কোনো নবীই এমন পাঠাইনি, যে তাঁর জাতির মাতৃভাষায় আমার বাণী তাদের কাছে পৌঁছায়নি, যাতে করে সে তাদের নিকট আমার আয়াতসমূহ পরিষ্কার করে বুঝিয়ে বলতে পারে।” সুতরাং প্রত্যেক ভাষাই আল্লাহ প্রদত্ত এবং কোন ভাষাকে অন্য কোন ভাষার উপর আলাদা মর্যাদা প্রদান করা হয়নি। পাকিস্তানী নেুারা মুখে ইসলামের কথা বললেও তাদের বাস্তব কাজকর্মে ইসলামের কোন প্রভাবই দেখা যেতো না।তারা এবং তাদের দোসররা উর্দুকে ধর্মীয় ভাষা আখ্যায়িত করেছিলো নিজেদের স্বার্থে। তাদের দ্বিমুখী আচরণের বিরুদ্ধে কবি ফররুখ আহমদ লিখেন ব্যঙ্গ কবিতা ‘আহা বেশ বেশ’। ভাষা আন্দোলনের স‚চনা এবং নেুৃত্ব প্রদানকারী সংগঠন ‘তমদ্দুন মজলিস’র মুখপত্র ‘সাপ্তাহিক সৈনিক’-এর প্রথম বার্ষিক সংখ্যায় প্রকাশিত হয় কবিতাটি,-
“যতেক শয়তান মিলে উজাড় করে দেশ।
ইসলামের নাম নিয়ে ইসলাম করে শেষ \
ধ‚য়া : আহা বেশ বেশ …
কেউবা ছিল দালাল এদের কেহবা উকিল।
কেউবা ছিল ভন্ড আলিম আস্ত আজাজিল,
বেজায় চালক এখনো তাই খায়নি কেহ কিল,
বগলে ইট এসব পাকা জবানী দরবেশ \’
ধ‚য়া : আহা বেশ বেশ ….”
বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতি অগাধ ভালোবাসা এবং পাÐিত্যের কারণে ফররুখ আহমদের রাষ্ট্রভাষা সংক্রান্ত লেখাগুলো খুবই শক্তিশালী ছিলো এবং ভাষা আন্দোলনে নুুন মাত্রা যোগ করেছিলো। ইতিপূর্বে কাব্যজগতে খ্যাতির শীর্ষে আরোহন করে পাঠকমহলে তিনি যথেষ্ট আন্দোলন সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ১৬ জুন ১৯৭৩ সালে দৈনিক গণকণ্ঠে প্রকাশিত এক নিবন্ধে তাঁর সৃজনক্ষমতা ও শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে মহাত্মা আহমদ ছফা লিখেছেন,- আজকের সমগ্র বাংলা সাহিত্যে ফররুখ আহমদের মতো একজনও শক্তিশালী ¯্রষ্টা নেই।” সব্যসাচী লেখক, গবেষক ও খ্যাতিমান সমালোচক আবদুল মান্নান সৈয়দ ফররুখ আহমদকে মূল্যায়ন করেছেন এভাবে,“ফররুখ আহমদ ছিলেন অফুরানভাবে সৃষ্টিশীল। তার সৃষ্টিধারায় কখনো ছেদ বা বিরতি পড়েনি। সব মিলিয়ে তার সাহিত্য-শস্যের পরিমাণ বিরাট।”এমন শক্তিশালী একজন কবির বিদ্রোহী লেখনী রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে সন্দেহাতীতভাবে বেগবান করেছিলো। শুধু লেখনীই নয়, ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রয়ারি সালাম, জাব্বার, রফিক, বরকতরা শহিদ হলে কবি ফররুখ আহমদ স্বয়ং পাকিস্তানের বেুারে বসেই এই নির্মমতার তীব্র প্রতিবাদ জানান। কবি ফররুখ আহমদ আমাদের ভাষা এবং সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। একজন ভাষা সংগ্রামী, ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অগ্র কলম সেনা এবং একজন শক্তিমান কবি হিসেবে তিনি মহাকাল অবদি বেঁচে থাকবেন। সময়ের পরিক্রমায় আমাদের ভাষা আন্দোলন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে। সেই রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে কবির অবদান জাতি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে।