রাঙ্গুনিয়া থানা অপারেশন

55

(পূর্ব প্রকাশের পর)
ওরা রেকি গ্রুপের দু’দলকে গাইড করে নির্দিষ্ট টার্গেটের স্থানে এবং এর চারিদিকে ঘুরে ফিরে দেখাবে। রোয়াজার হাট ব্রিজ পাহারারত রাজাকারদের অবস্থানও স্বচক্ষে দেখে আসা এবং (Operation) অপারেশনের দিন কাট অফ বাহিনী মোতায়েন করার উত্তম জায়গাগুলো চিহ্নিত করার তাগিদ দেয়াসহ আক্রমণকারীদের সঠিক ঊীরঃ পথ চিহ্নিত করার পর অত্যধিক গুরুত্ব দেয়া হল। দলনেতারা সকলকে যা যা করতে হবে সেসব সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দিলেন। আমরা ইছামতীকূল হয়ে সৈয়দবাড়ি গ্রামের মধ্যদিয়ে এসে ওখানকার প্রাইমারি স্কুল মাঠের সামনে থেকে একদল থানার পূর্বদিক দিয়ে থানা ক্রস করে রোয়াজারহাটের দিকে রেকিং কাজ চালিয়ে যাই। অন্য দলটি থানার দক্ষিণে দীঘির দক্ষিণ পশ্চিম পাড় হয়ে ডা. বিনয় ভূবন দাশের বাড়ির সামনে দিয়ে গিয়ে থানাকে ডানে রেখে রোয়াজারহাটে রাজাকার আস্তানার দিকে গিয়ে এবং পরে থানার ক্রস করে যা যা দেখার তা জানার সব শেষ করে উভয় দল প্রাইমারি স্কুলে মিলিত হয়ে ভিন্ন পথে আমরা কর্ণফুলীর তীরে এসে পৌঁছাই। বাজার ফেরা লোকজনদের সাথে নদী পাড়ি দিয়ে শিলক এসে পৌঁছি। আমরা আনুমানিক রাত নয়টায় পায়ে হেঁটে আমরা ‘ছিপছরি’ ক্যাম্পে উঠি। টি এম আলী, নজির আহমদ সাহেব ও অন্যরা আমাদের অপেক্ষায় ছিলেন। আমরা রেকি গ্রুপের সব সদস্যরা খুবই ক্লান্ত ছিলাম। খাবার খেয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে দলনেতাগণ কোম্পানি কমান্ডার সাহেবকে রেকি সম্পর্কিত সবকিছু অবহিত করলাম। সব জেনে কমান্ডার সাহেব সন্তোষ প্রকাশ করলেন। আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহের শেষদিকে আমরা আরও একবার ভালভাবে টার্গেট স্থল রেকি করে আসি। রেকি গ্রুপের সব সদস্যগণ আলোচনার মাধ্যমে পরবর্তী করণীয় ঠিক করলেন। ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস, এই দিনেই থানা আক্রমণ করা হবে আগে থেকে ঠিক করা ছিল। টি এম আল সাহেবের কোম্পানিতে থাকা সব প্লাটুন কমান্ডারদের সাথে আলাপ করে ১৯ সদস্য বিশিষ্ট একটি শক্তিশালী দল গঠন করা হল। দলের সবাইকে ডেকে সবার নিজ নিজ মত নেয়া হল ১৪ই আগস্টে থানা অপারেশনের লক্ষ্যে। সবাই এক বাক্যে বলেন, আমরা প্রস্তুত যা হবার তাই হবে ইনশাল্লাহ। ১৪ আগস্ট আমরা টি এম আলী মহোদয়ের নেতৃত্বে দলবল নিয়ে শিলক পৌঁছি সেই ছিপছড়িপাড়া ক্যাম্প থেকে। মাঝপথে সৈয়দবাড়ির স্বজন তালুকদার ও রাঙ্গুনিয়া থানা পুলিশের এক ছেলে আয়ুব রানার দেখা পাই। তারা নাকি মুক্তিবাহিনীর খোঁজে পদুয়া যাচ্ছিল। দু’জনকে থামালাম বুঝালাম আমাদের সাথে যেতে হবে। দু’জনেই ছিল আমার খুব পরিচিত। তাদেরকে আমাদের সাথে নেয়া কেরোসিনের গ্যালন দু’টো বহন করার জন্য দিলাম যা ব্যবহার হবে থানা পোড়ানোর কাজে।
এদিকে শিলক নোয়া রাস্তার মাথার নূর মোহাম্মদ (ডাক নাম-চাঁদু) গাই ইছাক, রাস্তার মাথার লেদু মিঞা, চেয়ারম্যান, নজির আহমদ সাহেবের বড় ছেলে হাবিব ভাই ও অন্যান্য আমাদের খাওয়া দাওয়া ও কর্ণফুলী পাপারের সব ব্যবস্থা ঠিক করে রেখেছিলেন। ঐ দিন কর্ণফুলী ছিল কানায় কানায় পূর্ণ তবুও আমরা কেউ সাহস হারাইনি। আনুমানিক রাত সাড়ে দশটায় আমরা খরস্রোতা নদী অতিক্রম করে উত্তর পাড়ে উঠি। অন্ধকার রাত, সিগারেট ও আলো জ্বালানো নিষিদ্ধ ছিল। ঠিক মধ্য রাত্রির পর তিন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে থানা আক্রমণ পরিচালনার পরিকল্পনার করা হয়। থানার পূর্ব ও পশ্চিম দিকে নিরাপদ দূরত্বে দু’গ্রুপ অবস্থান নেয়, যাতে করে কাপ্তাই রাস্তার উভয় দিকে থেকে পাক হানাদার বাহিনীর গতিরোধ করা যায়। এ দু’টি গ্রুপের কাছে দু’টি করে চারটি এলএমজি (LMG-Light Machine Gun) ছিল এবং তৃতীয় গ্রুপটি দায়িত্ব ছিল Santry-K Hands up এবং থানার ভিতরে ঢুকে সরাসরি আঘাত হানা ও ফায়ার করা। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা সবাই ইন্ডিয়ান অটো-রাইফেল, রাশিয়ান এস এম জি Sami Machine Gun বা স্টেশনগান, ৩, ৮ বোরের পিস্তল ও শক্তিশালী Land Granade দ্বারা সুসজ্জিত ছিল। আমাদের আক্রমণে এ অস্ত্রগুলোর প্রায় সবই ব্যবহৃত হয়েছিল। থানার ভিতরে বাইরে অবস্থানরত কোন পুলিশ সিপাহী বা রাজাকার কেউ পাল্টা আঘাত করেনি। তারা তাদের নিজ নিজ হাতিয়ার ফেলে প্রাণভয়ে ছুটে পালিয়েছিল। এদের মধ্যে তিনজন পুলিশ আমাদের সামনে পড়ে গেলে তারা হাত উপরে তুলে সারেন্ডার করে। থানার দারোগা নুরুল হক সাহেব চাকর ছেলের বেস ধরে ওসি সাহেবের বাসার খাটের নিচে লুকিয়ে থেকে প্রাণে রক্ষা পেয়েছিলেন (পরে জেনেছিলাম, চাকর লোকটি ছিল OC)। উল্লেখ্য যে এত গোলাগুলির মাঝেও পূর্বদিকে রাঙ্গুনিয়া কলেজ থানা পাক ক্যাম্প এবং পশ্চিম দিকে কাপ্তাইসংলগ্ন তখনকার Easterm Chemical Industiry -তে থাকা পাকা বাহিনীর কোন দল পাল্টা আঘাত করার জন্য থানার দিকে এগিয়ে আসেনি এবং Blank Fire ও করেনি। এতে বুঝা যায়, তাদের মনোবল একেবারে ভেঙে পড়েছিল। এই আক্রমণের প্রচন্ড গোলাগুলির শব্দে পুরো রাঙ্গুনিয়া যেন থর থর করে কাঁপছিল। শুরু হলো রাজাকারদের Surrender এর পালা। সারেন্ডার করা তিন পুলিশকে আমরা ধরে নিয়ে বন্দি করে রাখি। পরে এই তিন পুলিশ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করায় তাদের ক্ষমা করে দেয়া হয়। থানায় রক্ষিত ছিল সদ্য সমাপ্ত এসএসসি পরীক্ষার প্রচুর খাতাপত্র। এগুলোর কিছু কিছু আমরা বের করে এনে তছনছ করে দিই। থানা ও থানায় রকি্িষত মালামল কিছুই পোড়ানো সম্ভব হয়নি কারণ যে দু’জনকে কেরোসিনের গ্যালন বহন করার দায়িত্ব দেয় হয়েছিল তাদের কাউকে অপারেশনে স্থলে বা তাদের যেখানটাই থাকতে বলা হয়েছিল সেখানটায় তাদের আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।
থানায় থাকা রাজাকার বা পুলিশের সাতটি রাইফেল (আটো নয়) আমরা হস্তগত করি। ইচ্ছা করলে আমরা অনেক পুলিশ সদস্যকে খতম করতে পারতাম কিন্তু তা করিনি। থানার ভেতর তাহের ভাই একটি পাকিস্তানি পতাকা গচ্ছিত অবস্থায় দেখতে পান। তিনি সেটা নিয়ে ম্যাচের কাটি জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেন। আমি আর ফজলু ভাই EPR এর wareless core এর operator) বাহিরে পতাকা stand-এ থাকা পাকিস্তানের পতাকাটি ওসির বাসায় থাকা হারিকেন বাতির কেরোসিন জ্বালিয়ে দেই এবং আমার কাছে থাকা বাংলাদেশের পতাকাটি রশির সাথে বেধে উপরে উঠিয়ে দিই এবং জোরে জোরে ‘জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে থানা কম্পাউন্ড কাঁপিয়ে তুলি। এটা আমার জীবনের এক বড় প্রাপ্তি।
অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে আমাদের অপারেশন শেষ হয় বিধায় বেক করার নির্দেশ এল। কালবিলম্ব না করে আমরা সকলে বেক করতে শুরু করলাম। পূর্ব দিগন্তে লাল আভা দেখার আগে আমরা সব ক’জন মুক্তিযোদ্ধা নিরাপদে কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ তীরে ফিরে এসেছিলাম। আমাদের মাঝি মাল্লারা ছিল অত্যন্ত সাহসী ও দেশপ্রেমিক। তারা সবাই বিনে পয়সায় আমাদের শ্রম দিয়েছিলেন। হাজারো ছালাম জানাই তাদের।
আমি ছিলাম শেষ ব্যক্তি যে সবা পরে নদী অতিক্রম করি। অপারেশনে অংশগ্রহণকারী প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধাকে নৌকায় তুলে দিয়ে গন্তব্যে ফিরিয়ে নেয়ার বাড়তি দায়িত্বটা ছিল আমার ওপর। আমি স্থানীয় লোক বিধায় আমি যতক্ষণ নদীঘাটে ফিরিনি ততক্ষণ পর্যন্ত ঐ নাম না জানা মাঝি মাল্লার অধীর আগ্রহে আমরা পথ পানে চেয়ে অপেক্ষা করছিলেন। আমি নৌকায় উঠতেই তাদের সবার মুখে হাসি রেখা ফুটে উঠে। পরের দিন খোঁজ নিয়ে দেখি থানা আক্রমণের কারণে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশংসায় রাঙ্গুনিয়াবাসী ছিলেন পঞ্চমুখ কেবল কতিপয় কুলাঙ্গার ছাড়া। আমার বার বার যেন নিম্নোক্ত চরণকগুলো গেয়ে চলি।
‘সাবাস বাংলাদেশ
এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়
জ্বলে পুড়ে মরে ছারখার
তবুও মাথা নোয়াবার নয়’
হ্যাঁ, আমরা মাথা নোয়াইনি, উচ্চশিরে পৃথিবীর মানচিত্রে গর্ব সহকারে দাঁড়িয়ে আছি। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু। বাংলাদেশ চিরজীবী হউক।
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা