রাঙামাটিতে পর্যটকের ঢল

105

ইট-পাথরের শহর আর যান্ত্রিক জীবনের ক্লান্তি দূর করতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভ্রমণ পিপাসু মানুষ ছুটে আসছেন রাঙামাটিতে। নতুন বছরের শুরুতে পর্যটকের ঢল নেমেছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি রাঙামাটিতে। পর্যটকরা উপভোগ করছেন পাহাড়, ঝর্না আর হ্রদের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য।
এতে ছন্দে ফিরতে শুরু করেছে রাঙামাটির পর্যটন ব্যবসা। হোটেল-মোটেলসহ শহরের পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসা এখন জমজমাট। এছাড়া মৌসুমি ফলের ব্যবসাও জমে উঠেছে। ফলে সাময়িকভাবে চাঙ্গা হয়ে উঠেছে রাঙামাটির অর্থনীতিও। নিরাপত্তা ব্যবস্থায় খুশি হলেও পর্যটন স্পটগুলোর সংস্কার এবং এসব যুগোপযোগী না হওয়ায় অনেক পর্যটকই হতাশা ব্যক্ত করেছেন। অন্যদিকে সীমাবদ্ধতার কথা স্বীকার করে শিগ্গির সংস্কার করা হবে বলে জানিয়েছেন পর্যটন শিল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
উল্লেখ্য, ডিসেম্বর থেকে মার্চ- এ চারমাস ও দুই ঈদের দুই সপ্তাহজুড়ে পর্যটকদের উপচে পড়া ভীড় থাকে রাঙামাটিতে। কিন্তু ২০১৭ সালের ১৩ জুন রাঙামাটিতে ভয়াবহ পাহাড়ধসে ১২০ জনের প্রাণহানির ঘটনা এবং এরপর ‘জোড়াতালির’ সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে পর্যটন ব্যবসায় ধস নামে। বছর না ঘুরতেই আবারও ২০১৮ সালে ১২ জুন ১১ জনের প্রাণহানির ঘটনা পর্যটন ব্যবসার জন্য ‘মরার ওপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে উঠে।
এছাড়া গত বছরের জুনে পাহাড়ধসের সপ্তাহতেই ঈদুল ফিতর ও আগস্টে ঈদুল আজহার সময় ঝুলন্তসেতু পানির নিচে তলীয়ে যায়। তাই এ দুই ঈদ মৌসুমে টানা ছুটিতেও রাঙামাটির পর্যটনস্পটগুলো ছিল অনেকটাই ফাঁকা। এর সাথে সাম্প্রতিক আঞ্চলিক ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে হত্যাকান্ডের খবরে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে রাঙামাটির পর্যটন শিল্পে। আর ২০১৮ সালের শেষভাগে একাদশ সংসদ নির্বাচনের কারণে পর্যটক কমে গিয়েছিল রাঙামাটিতে।
পর্যটনখাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আবার আগের চেহারায় ফিরছে পর্যটন খাত। এমন পর্যটক সমাগম থাকলে গত দেড় বছরে ‘পর্যটন খরার’ ক্ষতি কাটিয়ে উঠা সম্ভব হবে। প্রতিনিয়ত হাজার হাজার পর্যটক ছুটে আসেন রাঙামাটি। বিনোদনের খোঁজে পাহাড়ে আসা পর্যটকদের আনন্দ- উচ্ছ¡াস সাময়িক সময়ের জন্য হলেও ভুলিয়ে দিচ্ছে জীবনের নানা জটিলতা। সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে পর্যটকদের উপচে ভিড় থাকে।
তারা জানান, সুবলং ঝর্না, রাজবন বিহার, রাজবাড়ি, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের জাদুঘর, ডিসি বাংলো, কাপ্তাই লেক, পেদাটিংটিং, বেরান্যা ইকোভিলেজ সহ কাপ্তাই লেকের পাড়ে গড়ে ওঠা বিভিন্ন পর্যটন স্পটগুলো থাকে পর্যটকদের পদচারণায় মুখরিত। এছাড়া রাঙামাটি শহরে সেনাবাহিনী পরিচালিত আরণ্যক হলিডে রিসোর্টে দৃষ্টিনন্দন ওয়াটার পার্ক ‘হ্যাপি আইল্যান্ড’ ও জেলা পুলিশের পলওয়েল পার্ক, রাঙামাটি-কাপ্তাই সড়কে বেশ কয়েকটি ইকো রিসোর্ট রাঙামাটির পর্যটনে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
তবে রাঙামাটিতে পর্যটকদের মূল আকর্ষণ ৩৩৫ ফুট দৈর্ঘের ঝুলন্ত সেতুকে ঘিরেই। ১৯৮৫ সালে দুই পাহাড়ের মাঝখানে তৈরি করা হয় এ আকর্ষণীয় সেতুটি। তাই পর্যটকরা প্রথমেই ছুটে যান পর্যটন কমপ্লেক্স এলাকায়। বছরে প্রায় দুই লাখ দেশি-বিদেশি পর্যটক সেতুটি দেখতে আসেন।
জানা গেছে, পর্যটন কমপ্লেক্সের অধীন দুটি হোটেল-মোটেল, ছয়টি কটেজ রয়েছে। এসব হোটেল-মোটেলে রয়েছে ৮৬টি কক্ষ। এর বাইরে শহরে বেসরকারি ৪২টি হোটেল-মোটেল রয়েছে। প্রতিদিন তিন হাজার অতিথি হোটেল-মোটেলে থাকতে পারেন। পর্যটকদের সেবা দিতে এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন চার শতাধিক। হোটেল-মোটেল, রেস্টুরেন্ট, টেক্সটাইল (পাহাড়িদের তৈরি কাপড়), নৌ-যান এবং বিনোদনকেন্দ্রকে ঘিরেই মূলত রাঙামাটির পর্যটনশিল্প।
গতকাল শুক্রবার দুপুরে ঝুলন্তসেতু এলাকায় পর্যটকদের সাথে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। খাগড়াছড়ি সদরের ব্যবসায়ী রুইতি মারমা (৩৬) এসেছেন পরিবারের ২৯ সদস্য নিয়ে। তিনি বলেন, পাহাড়ের মানুষ তবুও পাহাড় দেখতে আসলাম। তবে নতুন কিছু থাকলে আরও ভালো লাগতো।
চট্টগ্রামের উত্তর পতেঙ্গার ব্যবসায়ী আহমেদ হোসাইন (৪৫) এসেছেন ৭০ সদস্য নিয়ে। তিনি বলেন, রাঙামাটি অনন্য। এশিয়ার সবচেয়ে বড় হ্রদ। কিন্তু নতুন কোন অবকাঠামো নাই। তবে পর্যটন স্পটগুলোর সংস্কার করা হলে আরও ভালো লাগতো।
চট্টগ্রামের ইপিজেড’র একটি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মী শেখ সোহেল (২৬) এসেছেন ৯০ জন সহকর্মীর সাথে। তিনি বলেন, দেশে আর কোথাও এমন পাহাড়, ঝর্না আর হ্রদের সম্মিলন নাই। অসাধারণ প্রকৃতি। তবে আরও আধুনিক স্থাপনা ও সুযোগ-সুবিধা যুক্ত করলে পর্যটক সংখ্যা বাড়বে।
হোটেল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মঈন উদ্দিন সেলিম বলেন, বর্তমানে এখানে প্রচুর পর্যটক এসেছেন। মৌসুমের শুরুতেই ভালো সাড়া পাচ্ছি। আগে থেকেই বুকিং হয়ে থাকায় প্রতিটি হোটেল-মোটেল পূর্ণ পর্যটকে’।
রাঙামাটি ট্যুরিস্ট পুলিশের এএস আই মো. কামাল উদ্দিন বলেন, পর্যটকরা যাতে নির্বিঘেœ ঘুরে বেড়াতে পারেন, সেজন্য সার্বিক নিরাপত্তার জন্য পর্যটন পুলিশ সার্বক্ষণিক নজর রাখছে। সড়ক ও নৌ-পথে সার্বক্ষণিক টহল রাখা হয়েছে।
রাঙামাটি পর্যটন কর্পোরেশনের ব্যবস্থাপক সৃজন বিকাশ বড়–য়া বলেন, নতুন বছরের শুরুতেই ভালো সাড়া পাচ্ছি। বেশ ভালো একটি মৌসুম কাটাতে পারবো বলে আশা করছি। পর্যটন স্পটগুলোকে আরও আকর্ষণীয় করতে সংস্কার কাজ শুরু করা হবে। ঝুলন্তব্রিজের আধুনিকায়নের ব্যাপারে আমরা পদক্ষেপ নিয়েছি। শিগ্গিরই এ বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা দেখতে পাবো।
জেলা প্রশাসক একেএম মামুনুর রশিদ বলেন, রাঙামাটিকে বিশ্ববাসীর কাছে সুন্দর ও পর্যটনবান্ধব জেলা হিসেবে উপস্থাপন করতে পর্যটন খাতে যেসব প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, তা দ্রুতই দূর করা হবে। এছাড়া পর্যটকদের সুবিধার জন্য অচিরেই রাঙামাটি-কক্সবাজার বাস সার্ভিস চালু করা হবে।