রাঙামাটিতে দ্বিমুখী লড়াইয়ের সমীকরণ

79

রাত পোহালেই ভোট। কুয়াশাচ্ছন্ন শীতল আবহে সাধারণ মানুষ যাবেন তার ভোট প্রয়োগ করতে। নানান অঘটন-ঘটন, আলোচনা-সমালোচনা আর অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগের উত্তাপ ছড়ানো প্রচারণা শেষ হয়েছে গতকাল শুক্রবার। এখন কোন প্রার্থী হাসবেন শেষ হাসি কিংবা কার গলায় ঝুলবে বিজয়ের মালা সেই হিসেব কষছেন সাধারণ ভোটাররা। অফিস পাড়া থেকে চায়ের দোকান, বাস্ট স্টেশন-লঞ্চঘাট কিংবা ঘরের মধ্যে সর্বত্রই চলছে নির্বাচনের আলাপন। কাকে ভোট দিবেন, কেনো ভোট দিবেন- সেই হিসেবেই ব্যস্ত সকল ভোটার।
এতোদিন ত্রিমুখী লড়াইয়ের কথা শোনা গেলেও দিন যত গড়ালো সেই হিসেবও যেনো পাল্টে গেলো। শেষোবধি লড়াই হবে দ্বিমুখী। ম্যাজিক দেখাবেন মনি স্বপন দেওয়ান-এমনটাই শোনা গিয়েছিল প্রার্থী নিশ্চিত হওয়ার পর। মনি স্বপন নিজেও দলীয় কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত প্রথম মতবিনিময় সভায় বেশ আত্মবিশ্বাসের সাথে বলেছিলেন- সব কৌশল বলতে পারব না; ভোটের হিসেব পাল্টে দিতে যে কোনো সময় যে কোনো কিছু হতে পারে। প্রতীক পেয়ে জোর প্রচারণা শুরু করেছিলেন তিনি।
মনোনয়ন বঞ্চিত কেন্দ্রীয় নেতা দীপেন দেওয়ান ও মনীষ দেওয়ানও যোগ দেন প্রচারণায়। প্রথমদিকে প্রচারণায় জোয়ার দেখা গেলেও ভোটের কাছাকাছি সময়ে এসে কেমন যেনো তাতে ভাটা নেমেছিল। মনি স্বপনের সাথে জেএসএস’র গোপন আঁতাতের গুঞ্জন শোনা গেলেও শেষোবধি গোপন আঁতাত হলো বিএনপি নেতার সাথে আওয়ামী লীগের। আর তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটলো প্রচারণার শেষ দিকে এসে। কেন্দ্রীয় বিএনপি’র সদস্য ও সাবেক জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান রবীন্দ্র লাল চাকমা (সুজন)’র নেতৃত্বে তিন শতাধিক নেতা-কর্মী আওয়ামী লীগে যোগ দেয়ার সবচেয়ে বড় চমকটা দেখলো রাঙামাটিবাসী।
এছাড়াও কাপ্তাই-কাউখালী-লংগদু ও বাঘাইছড়িতে শত শত নেতা-কর্মীর আওয়ামী লীগে যোগদানে একদিকে যেমন বিএনপি’র শক্তি ক্ষয় হতে থাকে অপরদিকে আওয়ামী লীগের পাল্লাও ভারি হতে থাকে। অন্যদিকে কোনো দলের সাথে জেএসএস’র সমঝোতার বিষয়টি যখন উড়িয়ে দেন ঊষাতন তালুকদার; তখন বিএনপি’র চাঙ্গা ভাবেও নেমে আসে ভাটা। অপরদিকে বিএনপি’র দূর্গ হিসেবে পরিচিত লংগদু, কাপ্তাই, বাঘাইছড়িতেও শত শত নেতা-কর্মীর আওয়ামী লীগে যোগদানে বেশ ফুরফুরে মেজাজে আছে আওয়ামী লীগ। বিএনপি’র বিভিন্ন স্তরের নেতা-কর্মীর আওয়ামী লীগে যোগদানে মাঠের কর্মীদের মধ্যেও নেমে আসে এক ধরণের বিষাদ। তবে এই ঘটনাক্রমগুলোকে মোটেই পাত্তা দিতে প্রস্তুত নয় বিএনপি- এমনটাই দাবি বিএনপি ও তাদের মিত্রদের।
এদিকে মনি স্বপন দেওয়ানের প্রার্থী হওয়ায় রহস্যজনকভাবে নীরব ভূমিকা পালন করেন জেলা বিএনপি পরিবারের অন্যতম নেতা সাবেক পৌর মেয়র সাইফুল ইসলাম চৌধুরী। অভিমানী এই নেতারও নির্দিষ্ট একটি ভোট ব্যাংক রয়েছে শহরে। তিনি মনি স্বপন সম্পর্কে বলেন, ‘মনি স্বপনতো বিএনপি পরিবারের কেউ নয়। যে বেগম জিয়া ও তারেক রহমানের বিরুদ্ধে বলতে পারেন তিনি আবার কি বিএনপি করবেন। আমি যখন পৌরসভা নির্বাচনে প্রার্থী হই তখন মনি স্বপনের কাছে গিয়েছিলাম। কিন্তু তিনি ধানের শীষের প্রার্থীর জন্য ভোটতো চাননি। কোনো প্রকার সহযোগিতাই করেননি’। তিনি বলেন, ‘মনি স্বপনতো হারবে আর ভোটের পরে তাকে আর পাওয়াও যাবে না’। জেলা বিএনপি’র কলকাটি নাড়া এই নেতার ভোটগুলোও যে মনি স্বপনের বাক্সে পড়ছে না; তা অনেকটাই নিশ্চিত। তবে এই ভোট নানা কারণে যোগ হচ্ছে নৌকায়।
তাছাড়া বরকলের ভূষণছড়া আর লংগদুর ৩৫ কাঠুরিয়া হত্যার নায়ক হিসেবে এককালের গেরিলা নেতা মনি স্বপন দেওয়ানের নাম শোনা যায়। হত্যাকান্ডের শিকার ক্ষতিগ্রস্ত এসব এলাকার পরিবার ও স্বজনদের ভোট স্বাভাবিকভাবেই ব্যক্তি মনি স্বপনের বাক্সে পড়বে না। পাশাপাশি সেখানকার বাস্তবতায় ঊষাতনের পক্ষে যাওয়ারও সুযোগ নেই। তাই এসব ভোট স্বাভাবিকভাবেই নৌকার পক্ষেই পড়তে পারে বলে মনে করছেন স্থানীয় লোকজন।
গত বৃহস্পতিবার রাতে নৌকার পক্ষে খন্ড খন্ড মিছিল এসে জড়ো হতে থাকে পৌরসভা চত্বরে। খন্ড খন্ড সেসব মিছিলেও বিএনপি সমর্থিত অনেক পরিচিত মুখেরও দেখা মিলে। তাছাড়া সারাদেশের মতো রাঙামাটিতেও দৃশ্যমান উন্নয়ন হয়েছে। উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে ইতোমধ্যে ছোট ছোট অনেক রাজনৈতিক দল, বিভিন্ন সমিতি, সংগঠনও নৌকার পক্ষেই সমর্থন দেন। মূলত এসব কারণে ৩০ ডিসেম্বর নৌকার বিজয়টা অস্বাভাবিক নয়।
পাহাড়ের প্রত্যন্ত যেসব গ্রামে জেএসএস’র প্রভাব রয়েছে সেসব এলাকায় সিংহের পক্ষেই ভোট পড়বে স্বাভাবিক। আওয়ামী লীগ প্রার্থীর অভিযোগ- গত নির্বাচনে জেএসএস ৫৩ টি কেন্দ্রে ভোট ডাকাতি করেছে। আবার ইতোমধ্যেই নির্বাচন কমিশন থেকে ঘোষণা হয়েছে- প্রত্যেকটা ভোট কেন্দ্রে সেনাবাহিনীর উপস্থিতি থাকবে। ফলে এসব কেন্দ্রে স্বাভাবিকভাবেই গায়েবী ভোট পড়ার সুযোগ থাকছে না। ভোটের মাঠে জেএসএস’র জন্মশত্রু ইউপিডিএফও তাদের সাথে আছে এমনটা শোনা গেলেও জেএসএস (এমএন লারমা) ও ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) অবস্থান নিয়েছে বিপরীতে। ফলে জেএসএস’র ভোট ব্যাংকে কিছুটা চিড় ধরতেও পারে। তবে সবমিলিয়ে ভোটারদের অভিমত- ত্রিমুখী নয়, দ্বিমুখী অর্থাৎ নৌকা-ধানের শীষের মধ্যে হবে ভোটের লড়াই।
তবে দিন বদলের সাথে সাথে মানুষের চিন্তা ভাবনারও পরিবর্তন ঘটেছে। একটা সময় চায়ের কাপে ভোট বিক্রি হলেও সেই দিন এখন আর নেই। মার্কা দেখেও ভোট দেন না লোকজন। বিগত স্থানীয় নির্বাচনেও সাধারণ লোকজন মার্কা বা ব্যক্তি দেখে নয়; উন্নয়ন দেখেই ভোট দিতে দেখা গেছে। সংসদ নির্বাচনে সেই হিসেবটাও করছেন ভোটাররা। শেষোবধি কে হাসে বিজয়ের হাসি সেজন্য অপেক্ষা করতে হবে আগামিকাল রবিবার মধ্যরাতঅব্দি।