রাঙাপাখি মাছরাঙা

121

ছোট্ট মাছরাঙাটি যখন চুপটি করে বসে থাকে, দেখতে কত্ত মায়া লাগে! রাঙাপাখি মাছরাঙাটি জলাশয়ের আশে পাশে যখনই রঙিন ডানা মেলে উড়ে চলে, সেই দৃশ্যে বড়ই অপূর্ব। বিশাল জলাশয়ের পাড়টি সবুজের সমারোহ। আম, জাম, কাঁঠাল, সুপারি, নারিকেল, গাবসহ আরো কত শত গাছের সারি সারি আকাশের দিকে চেয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে,তার কোন ইয়ত্তা নেই। বাতাসের সাথে যখন গাছের শাখা প্রশাখাগুলো দোল খায়,তখন যে কারো মনে জাগবে সবুজের সাথে সবুজের যেন মহা আলিঙ্গনে নৃত্য খেলা করছে। সন্ধ্যার আগমনে কিচিরমিচির শব্দে মুখরিত হয়ে উঠে জলাশয়ের চারিদিক। ভোরের আকাশে যখন রাত পেরিয়ে আলো ফুটে, পাখিগুলো খাবারের সন্ধানে উড়াল দেয় দূর অজানার পথে। দিনের শেষে আবারো ফিরে আসে জলাশয়ের সবুজের সমারোহে। ব্যতিক্রম শুধু রাঙাপাখি মাছরাঙা। মাছরাঙাটি জলাশয়ের আশে পাশেই বিচরণ করে সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি। শিকারের প্রত্যাশায় কখনো আমের ডালে, কখনো কাঁঠালের ডালে চুপটি করে বসে থাকে। শিকার ভেসে উঠলেই ঝাঁপিয়ে পড়ে জলাশয়ের পানিতে। কখনো সফল হয়, কখনো ব্যর্থ হয়। সফল হোক আর ব্যর্থ হোক মাছরাঙাটি এই জলাশয়ের ধারে কাছে থাকতে পছন্দ করে। কখনো কখনো দুষ্ট কিশোরেরা দল বেঁধে ঢিল ছুঁড়ে তাড়িয়ে দিতে চেষ্টা করে। ভয়ে মাছরাঙাটি খানিকক্ষণ আড়াল হয়ে থাকে। কিশোরেরা যখন আর দেখতে না পায় মাছরাঙাটিকে, ঢিল ছোঁড়া থেকে বিরত থাকে তখন ফিরে যায় জলাশয়ের পাড় থেকে। দুষ্ট কিশোরেরা চলে গেলে, মাছরাঙাটি আবারো শিকারের আশায় অবস্থান নেয় গাছের কোন ডালে। এভাবেই চলে মাছরাঙাটির জীবন জলাশয়ের আশে পাশে। এবার মাছরাঙাটির সাথে জুটি বাঁধল আরেকটি মাছরাঙা এসে। এখন দুটি মাছরাঙায় একই সাথে কাছাকাছি থাকে এবং শিকার ধরে। জলাশয়ের পাড় ঘেষে একটু আড়ালে মাটির গর্তে নিজেরা বাসা তৈরী করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। কিছু দিনের মধ্যে সেরে ফেলল বাসা তৈরীর কাজ। এখন মাছরাঙাটির ডিম পাড়ার সময়। যখন মাছরাঙা দুটি একই সঙ্গে জলাশয়ের আশে পাশে উড়ে বেড়াই, দেখতে মনোরম দৃশ্য ঝরে। আর কিছু দিন পর মা মাছরাঙাটি চারটি ডিম দিল বাসায়। পালা করে ডিমে তা দেয় মাছরাঙা দুটিই। চারটি ডিমের মধ্যে তিনটি ডিম ফুটে বাচ্ছা বের হলো। একটি ডিম নষ্ট হয়ে বাচ্ছা ফুটেনি। এখন মা-বাবা দুজনেই খুব ব্যস্ত হয়ে পড়ল বাচ্ছাগুলোর জন্য খাবার জোগার করতে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্র্যন্ত একটুও জিরোন দেবার ফুসরত নেই। বাচ্ছাদের নিয়ে এক রকম আনন্দে সময় কাটাচ্ছে মাছরাঙা দুটি। একদিন এক দুষ্ট কিশোর মাছরাঙাটির বাসা দেখে ফেলল, অনেকক্ষণ চেষ্টা করল গর্তে হাত দিয়ে বাচ্ছাগুলোকে নেবার। গর্ত ছোট হবার কারণে বিফল হলো কিশোরের সেই চেষ্টা। ক্ষোভের বশে যাবার সময় গর্তে মুখে একটি মাটির ঢিল দিয়ে আঁটকিয়ে দিল গর্তেও মুখ। ফলে মাছরাঙা দুটি আর বাসায় ঢুকে বাচ্ছাদের খাবার দিতে পারছেনা। দুষ্ট কিশোরটি এতে ভীষণ মজা পাচ্ছে। এদিকে মা-বাবা মাছরাঙা দুটি পাগলের মতো ছুটোছুটি করছে বাসার আশে পাশে। তা দেখে কিশোরটির কত না খুশি লাগছে। বাচ্ছাগুলো খাবারের জন্য মা-বাবার অপেক্ষায় কাতরাচ্ছে ভীষণ। খাবার দিতে না পারলে মারা যাবে বাচ্ছাগুলো। মা মাছরাঙাটি রাগে ক্ষোভে দুষ্ট কিশোরকে অভিশাপ দিচ্ছে, তোমার জন্যও তোমার মা-বাবা আমার মতো কষ্ট অনুভব করুক।
তখনই তোমার মা’র উপলব্ধি হবে কত বেদনা। দুষ্ট কিশোরের খুশিতে তারই সাথি অন্যজন দেখলো মাছরাঙা দুটি গর্তের ভিতর ঢুকতে পারছেনা। দয়া হলো সেই কিশোরটির। সেই গিয়ে দ্রুত গর্তেও মুখের ঢিলটি ফেলে দিল। মাছরাঙাটি দুটি গিয়ে বাচ্ছাগুলোকে অনেক ক্ষণ আদর করল। বাচ্ছাগুলোও অনেকক্ষণ পর মা-বাবাকে পেয়ে কত না খুশি হলো। মা মাছরাঙাটি ঢিল সরিয়ে দেওয়া কিশোটির জন্য অনেক মঙ্গল কামনা করল। যেন তাকেও কোন বিপদ থেকে অন্যজনে রক্ষা করে। এদিকে দুষ্ট কিশোরটি সকালবেলা আবারো গেল গর্তেও মুখে ঢিল দিতে। দুষ্ট কিশোরটি কিন্তু সাঁতার জানেনা। মাছরাঙার বাসাতে দ্বিতীয় বার ঢিল দিয়ে বন্ধ করার সময় পা পিছলে পড়ে গেল জলাশয়ের পানিতে। এমন সময় আশে পাশে অন্য কেউ ছিলনা। অনেকক্ষণ হাবুডুবু খেল। জলাশয়ের পানি খেয়ে পেটটা ধানের ডোল হয়ে গেল। ঠিকই ঢিল সরিয়ে দেওয়া কিশোরটি পুনরায় দেখতে পেল দুষ্ট কিশোরটি পানিতে পড়ে হাবুডুবু খাচ্ছে। তার চিৎকারে সকলে এসে উদ্ধার করে দুষ্ট কিশোরটিকে। দ্রæত ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়ে সুস্থ করে তুলল। জলাশয়ে কেমনে পড়ল, কারণ জানতে পেল মাছরাঙা পাখির বাসাটি ঢিল দিয়ে বন্ধ করতে গিয়ে তার এই গতি। ডাক্তর যখন চিকিৎসা শেষে জানতে পারল, তার এই দুষ্টুমির কাহিনী। ধমকের সুরে উপদেশ দিল, দেখ তুমি যেমন পাখির বাচ্ছাগুলোকে কষ্ট দিয়েছ, পাখির মা-বাবাও কষ্ট পেয়েছে। পাখির অভিশাপে তোমার এই অবস্থা। তোমার মা বাবাও তোমার জন্য কষ্ট পেয়েছে। পেয়েছো তুমিও। পশু হোক, পাখি হোক কাউকে কষ্ট দিতে নেই। কাউকে কষ্ট দিলে ,সেই কষ্ট আমাকেও ভোগ করতে হবে। দুষ্ট কিশোর নিজের ভুল বুঝতে পেরে লজ্জিত হলো। পরক্ষণে বলল, আমি আর কোন দিন কাউকে কষ্ট দেব না। পাখিকে কষ্ট দেওয়ার ফল আমি পেলাম। আর ঢিল সরিয়ে দেয়া কিশোরটিকে ডাক্তার খুশি হয়ে একটি কলম উপহার দিল দুষ্ট কিশোরের সামনেই। পার্থক্য এখানেই, কেউ পেল পুরুস্কার, কেউ পেল তিরস্কার।