রহস্যময় এক জাদুকর হুমায়ূন আহমেদ

119

বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হুমায়ূন আহমেদ। আমার কাছে একজন শব্দের জাদুকর। নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলায় কুতুবপুর গ্রামে ১৯৪৮ সালের ১৩ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন এই রহস্যমানব। যার প্রতিটি লেখার পরতে পরতে আছে রহস্য। হুমায়ুন আহমেদের ডাক নাম ছিল কাজল। বাবা প্রথমে শামসুর রহমান নাম রেখেছিলেন এই জনপ্রিয় লেখকের। পরে আবার তিনিই ছেলের নাম বদলে রাখেন হুমায়ূন আহমেদ।
হুমায়ূন আহমেদের সম্পর্কে কমবেশি আমরা সকলেই জানি। তার লেখক হয়ে উঠা এবং জীবনের শুরু থেকে শেষ সবটুকুই হুমায়ূন প্রেমীরা জানেন। তিনি সমানভাবে জনপ্রিয় ছিলেন ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, গীতিকার, নাট্যকার, চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে।
লেখকের ব্যাক্তিগত জীবন নিয়ে আলোচনা করার পক্ষে আমি নই। তার সৃষ্টি নিয়ে একজীবন তাঁকে ভালোবাসা যায়। তাঁর সৃষ্টি হিমু, মিসির আলী, বাকের ভাই চরিত্রগুলো কার বুকে দাগ কাটে নি? হ্যাঁ, যারা হুমায়ূন সম্পর্কে জানেন না তারা তাঁর সৃষ্টি সম্পর্কেও জানবেন না, বুঝবেন না। তবে জীবনে একবার হুমায়ূনকে যিনি পড়েছেন তিনি তাঁর প্রেমে পড়ে যাবেন এটা আমি নিশ্চিত।
আমি একটা আমার নিজস্ব অভিজ্ঞতা বলি। সপ্তম-অষ্টম শ্রেণী থেকেই হুমায়ূন আহেমেদের নাম শুনতাম। তবে তিনি কি লিখতেন সে সম্পর্কে জানতাম না। নবম-দশমে এসে জানতে পারি তিনি একজন নাস্তিক। এবং তাঁর লেখা পড়া ভালো নয়। তখনও জানতাম না তিনি কেন নাস্তিক, কি কারণে নাস্তিক বলতো এরা।
তখনও হুমায়ূনের বই পড়া হয়নি। এরপর কলেজে উঠলাম। আর হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে আগ্রহটা কমে গেলো। তবে আমার তখন লেখা-লেখি এবং বই পড়া বেড়ে যায়। একসময় বেশকিছু হুমায়ূন প্রেমী আর ভালো বই পড়–য়া আমি আবিষ্কার করলাম। তাদের সবার বই পড়ার সংখ্যা বেশি হুমায়ূন আহমেদের। এরপর যেটা আবিষ্কার করলাম সেটা হচ্ছে হুমায়ূন আহমেদকে না পড়লে তারা বই পড়ার জগতেই আসতো না। হতো না প্রকৃত বই প্রেমিক। সেদিনই প্রথম রকমারি থেকে হুমায়ূন আহমেদের হিমু বইটি অর্ডার করি। ৪/৫ দিন পর বইটি হাতে পাই। এরও দুইদিন পর বইটি পড়া শুরু করি। আর্শ্চযের বিষয় বইটি সন্ধ্যা ছয়টায় পড়া শুরু করি এবং রাত নয়টার আগেই শেষ করি।
সেদিনই প্রথম আমি এক বসায় একটি বই শেষ করেছিলাম। এর আগ পর্যন্ত আমার একটা ছোট্ট বই শেষ করতেও দুদিন-তিনদিন লেগে যেতো।
শুধু তা-ই নয়। এরপর আমি হুমায়ূন আহমেদের লেখা পড়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠলাম। হিমু নিয়ে আরও বই পড়লাম। মিসির আলী পড়লাম এবং অন্যান্য গল্প উপন্যাস পড়লাম। যত পড়ি ততই পড়তে ইচ্ছে করে। এই যে বই পড়ার প্রতি আকর্ষণ সেটা হুমায়ূন আহমেদের বই না পড়লে কখনও সৃষ্টি হতো না।
এরপর হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে চর্চা করলাম। কোথাও পেলাম না তার নাস্তিকতার উদাহারণ। অথচ কিছু ধর্মান্ধ এই শব্দ সৃষ্টির কারিগরকে নাস্তি বলে আখ্যা দেয়।
তাঁর অপরাধ হয়তো মানুষকে বইয়ের দিকে ধাবিত করা। তাঁর অপরাধ হয়তো মানুষকে শব্দ এবং গল্পের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া। তার অপরাধ মানুষকে জীবন উপভোগ করার সুযোগ করে দেওয়া। এসব যদি অপরাধ না হয় তাহলে এই সৃষ্টিশীল মানুষের আর কি অপরাধ থাকতে পারে আমার জানা নেই।
তিনি লেখালেখির প্রতি এতোটাই আসক্ত ছিলেন, নব্বই দশকের মাঝামাঝি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করে লেখালেখিতে পুরোপুরি মনোযোগ দেন।
বাংলা সাহিত্যে এই অসামান্য অবধানের জন্য তিনি পেয়েছেন অনেক সম্মান এবং পুরস্কার। বাংলা সাহিত্যে অবদানের জন্য ১৯৯৪ সালে একুশে পদক লাভ করেন তিনি। এছাড়া বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৮১), হুমায়ূন কাদিও স্মৃতি পুরস্কার (১৯৯০), লেখক শিবির পুরস্কার (১৯৭৩), জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (১৯৯৩ ও ১৯৯৪), বাচসাস পুরস্কারসহ (১৯৮৮) অসংখ্য সম্মাননা পেয়েছেন নন্দিত এই কথাসাহিত্যিক।
তিনি যে শুধু বাংলায় জনপ্রিয় তাও নয়। তাকে নিয়ে আলোচনা ছিলো বিশ্বেও অনেক দেশে। জাপান টেলিভিশন ‘এনএইচকে’ হুমায়ূন আহমদকে নিয়ে নির্মাণ করে ১৫ মিনিটের তথ্যচিত্র ‘হু ইজ হু ইন এশিয়া’। যেখানে হুমায়ূন সম্পর্কে সবকিছু তুলে ধরেন টেলিভিশনটি। ২০১২ সালের ১৯ জুলাই মারণব্যাধি ক্যান্সারের কাছে হার মানতে হয় বাংলা সাহিত্যের এই মহাতারকাকে।
১৩ নভেম্বর এই নন্দিত লেখকের ৭২ তম জন্মদিন। জন্মদিনে তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা জ্ঞাপন করছি। যদি তিনি আজ বেঁচে থাকতেন তবে হয়তো তাঁর অনেক পাগল ভক্তকে দেখতে পেতেন।