রবীন্দ্র-জীবনে নারী

707

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নারীভাগ্য নেহায়েত মন্দ নয়। বরং ঈর্ষা জাগানিয়া। বউভাগ্য যেমনই হোক বান্ধবীভাগ্যই ছিল দুর্দান্ত। বউভাগ্য নিশ্চয় ভালোই ছিল যদিও ভদ্রমহিলা অল্প বয়সে (মাত্র ত্রিশ, ১৯০২ খ্রি.) স্বর্গলাভ করেন, রবীন্দ্রনাথকে ৫ টি সন্তান বর দিয়ে যান। দুজন সন্তান যদিও কম বয়সে মারা যায়। রবীন্দ্রনাথের ভাগ্যে জুটেছিল দেশি-বিদেশি, বয়েসি-অবয়েসি, স্বধর্মী-বিধর্মী সব বান্ধবী। রবীন্দ্র পত্রসাহিত্যের বিশাল অংশজুড়ে এই নারীদের স্থান। চিঠি চালাচালি। গুরুদেবের সমগ্র পত্র ‘চিঠি-পত্র’ সংকলনে ১৯ খন্ডে ও অন্য ৪ টি গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে।
চিঠিপত্রের মধ্যে দিয়ে যে রবীন্দ্রনাথকে আমরা আবিষ্কার করি তিনি সম্পূর্ণ অন্য মানুষ। বিষয়ী, সংসারী, তিনি অনেক কাছের মানুষ। চিঠিতে অ¤�মধুর মন্তব্য, সরস টিপ্পনী, বিতর্ক, প্রত্যাখ্যানের মাধ্যমেই মনের কথা বলেন তিনি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিঠি লেখার তালিকায় যে ২৯ জন মহিলা আছেন, এরা হলেন স্ত্রী মৃণালিনী দেবী (৩৬ টি চিঠি), পুত্রবধূ প্রতিমা দেবী (১১৫ টি চিঠি), জ্যেষ্ঠা কন্যা মাধুরীলতা দেবী (৫ টি চিঠি), কনিষ্ঠা কন্যা মীরা দেবী (৮১ টি চিঠি), দৌহিত্রী নন্দিতা দেবী (১০ টি চিঠি), জ্ঞানদানন্দিনী দেবী (১ টি চিঠি), নন্দিনী দেবী (১৯ টি চিঠি), অবলা বসু (৮ টি চিঠি), কাদম্বিনী দেবী (৯৯ টি চিঠি), নির্ঝরিনী দেবী (২৪ টি চিঠি), হেমন্তবালা দেবী (২৬৪ টি চিঠি), বাসন্তী দেবী (৩২ টি চিঠি), লেডি রাণু মুখোপাধ্যায় (২৬৭ টি চিঠি), সরযূবালা অধিকারী (৫ টি চিঠি), আশা অধিকারী (৪ টি চিঠি), যাদুমতী মুখোপাধ্যায় (১ টি চিঠি), ভক্তি অধিকারী (২ টি চিঠি), ইন্দিরা দেবী (৩৩৬ টি চিঠি), নির্মলাকুমারী মহলানবীশ (৫৯ টি চিঠি), অনিন্দিতা দেবী (২ টি চিঠি), জ্যোৎস্নিকা দেবী (১ টি চিঠি), সীতা দেবী (৫ টি চিঠি), সুধারানী দাস (১ টি চিঠি), উমারানী দাস (১ টি চিঠি), মীরা চৌধুরী (৮ টি চিঠি), ঈষিতা দেবী (১ টি চিঠি), অরুন্ধতী চট্টোপাধ্যায় (৬ টি চিঠি), রমা দেবী (২ টি চিঠি), শান্তা দেবী (২১ টি চিঠি)।
হেমন্তবালা দেবীকে লিখিত পত্রে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন- “তোমাকে উপলক্ষ্য করে আমি অনেক কথা বলি কিন্তু তোমাকে বলি নে। দেশের অসীম দুর্গতির কথায় মন যখন উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে তখন চুপ করে থাকতে পারি নে। দেশের জন্যে আমি তোমাকেও ভাবাতে চাই।” রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কাদম্বিনী দত্তের পত্রব্যবহারের মূল বিষয় ছিল- এ সংসারে মানুষের সুখদুঃখের স্বরূপ। হেমন্তবালার সঙ্গে পত্রালাপের মুখ্য বিষয় মানুষের ধর্মমত, এবং ধর্মের দৃষ্টিকোণ থেকে কবির আত্মপরিচয়। ইন্দিরা দেবীকে লেখার বিষয়-বৈশিষ্ট্য কি, সেটা স্বয়ং লেখকের জবানি শোনা যাক- আমার অনেক সময় ইচ্ছা করে, তোকে যে সমস্ত চিঠি লিখেছি সেই গুলো নিয়ে পড়তে পড়েত আমার অনেক দিনকার সঞ্চিত অনেক সকাল দুপুর সন্ধ্যার ভিতর দিয়ে আমার চিঠির সরু রাস্তা বেয়ে আমার পুরাতন পরিচিত দৃশ্যগুলির মাঝখান দিয়ে চলে যাই। কত দিন কত মুহূর্তকে আমি ধরে রাখবার চেষ্টা করেছি- সে গুলো বোধ হয় তোর চিঠির বাক্যের মধ্যে ধরা আছেৃআমাকে একবার তোর চিঠিগুলি দিস- আমি কেবল ওর থেকে আমার সৌন্দর্যসম্ভোগগুলো একটা খাতায় টুকে নেবৃআমার গদ্যে-পদ্যে কোথাও আমার সুখ দুঃখের দিনরাত্রিগুলি এ রকম করে গাঁথা নেই।”
জীবনের শেষ দশকে নতুন ইনিংস শুরু করেন রবীন্দ্রনাথ। তার সৃজনশীলতা ভিন্ন দিকে বাঁক নেয়। কবিতার রঙ ক্রমশ ফিকে হয়ে জীবন্ত হয়ে উঠে ক্যানভাসে। ছবি আঁকতে শুরু করেন তিনি। শেষবার ইউরোপ সফরে কবিতা আর আসতে চায় না, দু-একটি যা-ও লিখছেন তাও অপরিণত গদ্যছন্দে। কিন্তু আঁকছেন প্রচুর। আর্টের নিয়ম না মেনে। তার এই পেইন্টিং ভারতে আদৌ মূল্যায়ন হবে কিনা কবি সন্দিহান। সংস্কৃতি ও স্থাপত্য-কলার তীর্থভূমি প্যারিসেই একটি প্রদর্শনী করতে চান তিনি। কিন্তু অনেক খরচার ব্যাপার। এগিয়ে এলেন তার দুই বান্ধবী ফ্রান্সের কঁতসো দানোঅই ও আর্জেন্টিনার সেই ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো। এমনকি বার্লিনেও প্রদর্শনী হয়েছিল আরেক বিদুষী মহিলা ড. সোলিনার উদ্যোগে। আর্জেন্টিনার মহিলা কবি, বুদ্ধিজীবী ও নারীবাদী ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর সাথে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সখ্যতা গড়ে ওঠে ১৯২৪ সালে। যখন পেরু যাবার প্রাক্কালে অসুস্থ হয়ে আর্জেন্টিনাতে কবি ওকাম্পোর ভাড়া করা বাসায় দুইমাস অবস্থান করেন। ওকাম্পোকে কবিগুরু ডাকতেন বিজয়া নামে। আর নোবেল জয়ের বছরেই রবীন্দ্র রচনায় মুগ্ধ হয়ে ফ্যান বনে যান ওকাম্পো।
রবীন্দ্রনাথের নারীসঙ্গকে ঢালাওভাবে নিষ্কাম প্রেম বলে তাকে দেবতার আসনে বসানো যেমন সুবিচার নয়, তেমনি তার চরিত্র হননের অপচেষ্টাও গর্হিত অপরাধ। হ্যাঁ, রবীন্দ্রনাথেরাও রক্তে-মাংসে মানুষ। সংসার বিবাগী সাধু-সন্ত নন। একজীবনে রবীন্দ্রনাথের দুঃখ-কষ্টের অন্ত নেই। আজকের ভাষায় তার প্রথম ক্রাশ বয়সে কিঞ্চিৎ অগ্রজ মারাঠীকন্যা আন্না তাড়খড়। যাকে সদ্যযৌবনে পৌঁছা রবীন্দ্রনাথ নাম দিয়েছেন নলিনী। পেয়েছেন প্রেমের প্রথমপাঠ। বম্বেতে আধেক ইংরিজি শিখে কলকাতা ফিরে এসে কিছুদিন বাদে বিলেত উড়াল দেওয়ায় সে সম্পর্ক চুকে যায়। বলা বাহুল্য, আজকের রবীন্দ্রনাথের স্থপতি কাদম্বরী বৌঠান। বয়ঃসন্ধির দিনগুলোতে, জেন্ডার আইডেনটিটির সময়গুলোতে জানালার ধারে, নিরালা বাগানে তাদের খুনসুটি, সংসার পাঠ, কবিতার আঁকিবুঁকি আরও কত কী! কাদম্বরী বৌঠানের প্রয়াণ রবীর অপূরণীয় ক্ষতি। হৃদয়ে স্থায়ী ক্ষত। এ নারীভক্তি কী শেষমেশ কবির জন্য কাল হয়েছিল? তা কী আর বলতে! বিলেতে পড়তে গিয়ে পেয়িং গেস্ট হিসেবে যে বিলিতি পরিবারে ওঠলেন। সে পরিবারের দুইমেয়ে ফ্যানি ও লুসির সাথে ভাব জমতে বেগ পেতে হয়নি এই ভারতীয় যুবাকে। হয়ত ত্রিভুজ সম্পর্কও তৈরি হয়ে থাকবে। দেশে লেখা চিঠিতে যখন ঘুরে-ফিরে, ইনিয়ে-বিনিয়ে ললনা দুজনের প্রসঙ্গ কিংবা অনুষঙ্গ টানছেন , তখন কলকাতার এক রক্ষণশীল ব্রাহ্মপরিবারের রাতের ঘুম হারাম হওয়া অস্বাভাবিক নয়।
ফলশ্রুতিতে, পাছে কোন অনাসৃষ্টি ঘটে যায় ভেবে শিক্ষা কার্যক্রম অসমাপ্ত রেখেই ঘরে ফিরতে হয় রবীন্দ্রনাথকে।