রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতৃপুরুষেরা

233

আমাদের মাতৃভাষা- বাংলাভাষা আজকের মধুময় রূপে বিকশিত হলো যে ক’জন ক্ষণজন্মা পুরুষের হাতধরে, তাঁদের অন্যতম একজন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
বাংলার অন্যতম প্রভাবশালী, প্রচন্ড ক্ষমতাধর জমিদার ও শিল্পপতি দ্বারকানাথ ঠাকুর। তাঁর দৌহিত্র ও দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কনিষ্ঠ পুত্র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এশিয়া মহাদেশে সাহিত্যে প্রথম নোবেল পুরষ্কার বিজয়ী।
সেই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পূর্বপুরুষের পরিচিতি বিষয়ক আলোচনা অনেকেই করে থাকলেও আমাদের মতো সাধারণ পাঠকের কাছে তা অনেকটা অজানাই আছে। তাই বিভিন্ন তথ্যসূত্রের আলোকে তাঁর বংশ পরিচয় খানিকটা তুলে ধরার চেষ্টা করবো।
তাঁর পিতৃপুরুষেরা বাংলাভাষার মতোই গৌরবময় ঐতিহ্যের অধিকারী। আর তা যখন থেকে জানাযায়, সে সময়টা অষ্টম শতাব্দীর। সূচনা হয়েছিল কনৌজ থেকে, যার চূড়ান্ত পরিণতি বিশ্বময় বিকশিত হয়েছিল কলকাতার জোড়াসাঁকো থেকে।
এক সময় বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাবে বঙ্গদেশের পূর্বাংশ ব্রাক্ষণশ‚ন্য হয়ে পড়ে। খ্রিষ্টীয় অষ্টম শতাব্দীতে হর্ষবর্ধনের পুত্র জয়ন্ত গৌড়ের সিংহাসনে বসেন। তিনি পূজা অনুষ্ঠান পালনের জন্য সুদূর কনৌজ থেকে ‘পঞ্চব্রাক্ষণের’ আমদানি করেছিলেন। পঞ্চ-ব্রা²ণের মধ্যে ক্ষিতীশের পুত্র ছিলেন ভট্টনারায়ণ। তাঁর রচিত বেণীসংহার নামক ষড়ঙ্ক নাটকটি সংস্কৃত সাহিত্যে প্রসিদ্ধ। ভট্টনারায়ণই ঠাকুর পরিবারের আদি পুরুষ ছিলেন।
ভট্টনারায়ণ ও তাঁর পাঁচপুত্র একটি করে গ্রামের অধিকারী হন। ব্রাক্ষণগণ যে যে গ্রাম পেয়ে বসতি স্থাপন করেন, কালক্রমে সেই গ্রামের নাম তাঁদের বংশীয় উপাধিতে পরিণত হয়। এভাবে ভট্টনারায়ণের এক পুত্র কুশারী গ্রাম পেয়ে কুশারী হিসেবে পরিচিত হলেন। ঠাকুর পরিবার এই কুশারী অংশ থেকেই এসেছে। জগন্নাথ কুশারী হচ্ছেন কুশারীদের বিশতম অধঃস্তন পুরুষ।
দক্ষিণডিহির জমিদার শুকদেব রায়চৌধুরী কন্যাদায়গ্রস্থ ছিলেন। জগন্নাথ কুশারী যশোরের বর্ধিষ্ণু বংশের সন্তান। তিনি বিশেষ কার্যোপলক্ষে বজরায় করে নদীপথে যাচ্ছিলেন, পথে রাতে হঠাৎ ঘূর্ণিঝড়ে বিপদে পড়লে শুকদেব রায় চৌধুরীর গ্রামে তার পরিবারে আশ্রয় গ্রহণ করেন। শুকদেব কন্যাদায়গ্রস্ত ছিলেন। তিনি জগন্নাথ কুশারীর সম্ভ্রান্ত ব্রাক্ষণ বংশের পরিচয় পেয়ে নিজ কন্যার সঙ্গে বিবাহ দেন। এই পরিবারে বিবাহের জন্যই জগন্নাথ কুশারী পীরালী ব্রাক্ষণ হয়ে যান। এ বিয়ের পরে পীরালী ব্রাক্ষণ সমাজচ্যুত জগন্নাথ কুশারী নিরুপায় হয়ে চেঙ্গুটিয়া পরগনার অধীনে শ্বশুরালয়ের আশেপাশেই বসবাস করতে থাকেন। ঘটনাটি ঘটেছিল ষোড়শ শতাব্দীর শেষের দিকে।
অষ্টাদশ শতাব্দীতে জগন্নাথ কুশারীর নবম ও দশম পুরুষ পঞ্চানন কুশারী আর তার পুত্র জয়রাম প্রথম ভাগ্যান্বেষণে গোবিন্দপুর এসে বসতি স্থাপন করেন। প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়ের ‘প্রভাত কথা’ গ্রন্থে আছে, ‘গঙ্গারধারে গোবিন্দপুর গাঁয়ে যশোহর থেকে নৌকাকরে এলো কয়েকজন ব্রাক্ষণ। সে গাঁয় ব্রাক্ষণ নেই একঘরও… জয়রাম ঠাকুর থেকেই অর্থাগমের শুরু হয়!’ তাদের প্রতিবেশী সবাই ছিল নিম্নশ্রেণির হিন্দু। তারা পঞ্চানন কুশারী ও তার পুত্রকে তাদের ঠাকুর বলে সম্বোধন করে। ক্রমে ‘ঠাকুর’ তাদের বংশীয় পদবী হয়ে যায়। পঞ্চানন ও জয়রাম ঠাকুর কোম্পানীর আমলাদের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তুলে আমিনের চাকুরী নেন। ওই অঞ্চলে পরিবারটি উত্তরোত্তর উন্নতির পথে এগিয়ে যেতে থাকে। জয়রামের চারপুত্র। আনন্দীরাম, নীলমণি, দর্পনারায়ণ ও গোবিন্দরাম। ১৭৫৬খ্রিঃ জয়রাম মৃত্যু বরণ করেন, তার প্রথম পুত্র আনন্দী রামও অকালে মারা গেলে পরিবারের প্রধান হন পুত্র নীলমণি ঠাকুর।
১৭৫৬ সালে নবাব সিরাজউদ্দৌলা কলকাতা আক্রমণ করে দখল করলে নীলমণির পরিবার বিশেষ ক্ষতিগ্রস্ত হন এবং পালিয়ে প্রাণ রক্ষা করেন। পরের বছর ১৭৫৭ খ্রিঃ পলাশীর যুদ্ধে সিরাজের পতন হয়। অতঃপর কলকাতা ধ্বংসের জন্য সিরাজউদ্দৌলার পক্ষথেকে মীর কাসিমের মাধ্যমে ক্ষতিপূরণ বাবদ যে বিপুল অর্থ কোম্পানীকে দেয়া হয়, তা থেকে নীলমণি বেশ কিছু অর্থ পান। নীলমনি আর তার ভাই দর্প নারায়ণ উত্তর সুতানটিতে জমি কিনে নতুন বাসস্থান নির্মাণ করেন। সেটাই বর্তমানে পাথুরিয়াঘাটার ঠাকুরবাড়ি নামে পরিচিত।
১৭৬৪ সালে নীলমণি কোম্পানীর দেওয়ান নিযুক্ত হন। সেই সুবাদে প্রচুর অর্থ উপার্জনের পথ সুগম হয়। তার তৃতীয় ভাই দর্পনারায়ণ ইংরেজি ও ফরাসী ভাষায় সুপন্ডিত ছিলেন। জীবনের প্রথমদিকে চন্দন নগরে ফরাসী সরকারের অধীনে চাকুরী করেন, পরবর্তীতে চাকুরী ত্যাগ করে ব্যবসায় মনোনিবেশ করেন এবং প্রচুর অর্থসম্পদের অধিকারী হন। আনুমানিক ১৭৮৪ সালে নীলমণি ঠাকুর কোম্পানীর চাকুরী থেকে অবসর গ্রহণ করে পাথরঘাটার এজমালি বাড়িতে বসবাস করতে আসেন। কিন্তু অচিরেই বিষয়সম্পত্তি নিয়ে দুই ভাইয়ের মধ্যে দ্ব›দ্ব দেখা দিলে নীলমণি ঠাকুর ঘরত্যাগ করেন এবং দর্পনারায়ণ নীলমণিকে একলক্ষ টাকা দিয়ে পাথরঘাটার বাড়ি ও অন্যান্য সম্পত্তি নিজের কবলায় আনেন। সেই সময়ে বৈষ্ণবদাস শেঠ নামে এক সম্ভ্রান্ত তন্তুবায় নীলমণি ঠাকুরকে মেছুয়াবাজারে বাড়ি নির্মাণের জন্য কয়েক বিঘা জমি প্রদান করেন। নীলমণি ঠাকুর ওই জমির উপর বাড়ি নির্মাণ করে বাস করতে লাগলেন। এই মেছুয়া বাজারের নাম পরবর্তীকালে হয়, ‘জোড়াসাঁকো’।
নীলমণির পাঁচ পুত্র- রামতনু, রামরত্ন, রামলোচন, রামমনি ও রাম বল্লভ। তারা জোড়াসাঁকোর পৈত্রিক ভিটায় একান্নভুক্ত ভাবে বসবাস করতেন। ১৭৯১ সালে নীলমণি মৃত্যুবরণ করেন। রামতনু ও রামরতেœর অকাল মৃত্যু হলে তৃতীয় পুত্র রামলোচন পরিবারের কর্তা হন। রামলোচন ও চতুর্থভাই রামমনি দুই ভাই একই পরিবারের দুই সহোদর ভগ্নীকে বিবাহ করেন। রামলোচনের স্ত্রীরনাম অলকা দেবী আর রামমনির স্ত্রীর নাম মেনকা দেবী। রামলোচন অপুত্রক ছিলেন, তাঁর একটামাত্র কন্যা। রামমনির এক কন্যা জাহ্নবী ও দুই পুত্র রাধানাথ এবং দ্বারকানাথ। দ্বারকানাথ ১৭৯৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন। দ্বারকানাথের একবছর বয়সে মাতা মেনকাদেবীর হঠাৎ মৃত্যু হলে তাঁকে মাসী লালনপালন করেন।
রামলোচন ১৮০৭ সালের ১২ই ডিসেম্বর মৃত্যু বরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর সময় দ্বারকা নাথের বয়স ছিলো মাত্র ১৩ বছর। রামলোচন তাঁর যাবতীয় বিষয়সম্পত্তি দ্বারকানাথের নামে উইল করে তা তত্ত¡াবধানের ভার অলকাদেবী ও দ্বারকানাথের বড়ভাই রাধানাথ ঠাকুরের হাতে ন্যস্ত করে যান।
দ্বারকানাথ বাল্যকাল থেকেই অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। তৎকালীন রীতি অনুযায়ী তিনি প্রথমে আরবী ও ফার্সি ভাষা শেখেন। অতঃপর শেরবোর্ন স্কুল থেকে ইংরেজি ভাষায় বুৎপত্তি লাভ করেন এবং আপন প্রতিভায় ইংরেজ কোম্পানীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে ভাল চাকুরী লাভ করেন। ১৫ বছর বয়সে যশোর নরেন্দ্রপুর গ্রামের মেয়ে দিগম্বরীকে বিবাহ করেন। ১৮১৮ সালে ২৪ বছর বয়সে চব্বিশ পরগনার কালেক্টর অফিসের সেরেস্তাদার পদে নিযুক্ত হন। ১৮৩২সালে কোম্পানীর নেমক মহলের দেওয়ান হন। ১৮২৯ সালের ১৭ই আগস্ট নিজ চেষ্টায় ইউনিয়ন ব্যাংক স্থাপন করেন। দ্বারকানাথ উচ্চপদস্থ ইংরেজদের সাথে যেমন সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন, তেমনি এদেশীয় উচ্চ গন্যমান্য ব্যক্তিদের সাথেও সু- সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ১৮৩০খ্রিঃ ২৩শে জানুয়ারি রাজা রামমোহনের সাথে মিলিতভাবে ৫৫নং চিৎপুর রোডে ব্রাক্ষ্ণ সমাজের নিজস্ব বাড়ি স্থানান্তরিত করেন। ১৮৩৪ সালের ১লা আগস্ট কোম্পানীর চাকুরীতে ইস্তফা দিয়ে স্বাধীনভাবে ব্যবসা শুরু করেন। অজিত কুমার চক্রবর্তীর বর্ণনায়- “তিনি ‘কার-ঠাকুর কোম্পানী’ নামক এক কোম্পানী খুলিলেন। কয়েকজন অংশীদার মিলিয়া ‘ইউনিয়ন ব্যংক’ নামে এক ব্যংকও গঠন করিলেন। শিলাইদহে নীলকুঠি, কুমারখালিতে রেশমের কুঠি, রাণীগঞ্জের সমস্ত কয়লাখনি এবং রাম নগরের সমস্ত চিনির কারখানা কিনিয়া তাহা যোগ্যতার সহিত চালাইয়া তখন হু- হু- করিয়া রাজশাহীতে, পাবনায়, রংপুরে, যশোহরে জমিদারী কিনিয়া তিনি বাঙ্গালাদেশের একজন সর্বশ্রেষ্ঠ জমিদার হইয়া বসিলেন।”
১৮৪০ সাল হতে ঠাকুর পরিবার জমিদারি, সরকারি চাকরি এবং সৃষ্টিশীল কাজে আত্মনিযোগ করেন। দেবেন্দ্রনাথের পুত্র অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাই সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথম ভারতীয় সিভিলিয়ান। তিনি ১৮৬৪ সালে লন্ডনে অনুষ্ঠিত প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের সদস্য হন। ১৮৫৭ সালে সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও তাঁর ভাই জ্ঞানেন্দ্রনাথ ঠাকুর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রথম ছাত্র। যতীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন একাধারে লেখক, শিল্পী, সুরকার, গীতিকার এবং নাট্য ব্যক্তিত্ব। তিনি অসংখ্য নাটক লিখেছেন, পরিচালনা করেছেন এবং অনেকগুলোতে তিনি অভিনয় করেছেন। তিনি মূলত একজন চিত্রশিল্পী হিসেবে সমধিক পরিচিত। ১৯১৪ সালে লন্ডনে তাঁর নির্বাচিত চিত্রকর্মের একটি প্রদর্শনী হয়। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর নাট্যকার, সঙ্গীতজ্ঞ, সুরকার, সম্পাদক ও চিত্রকর।
বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবদান অপরিসীম। গীতাঞ্জলি কাব্যের ইংরেজি অনুবাদের জন্য নোবেল পুরষ্কার প্রাপ্তি বাংলা ভাষার জন্য বড় অর্জন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা গান ভারত ও বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে পরিবেশন করা হয়। ঠাকুর বংশের অষ্টম শতাব্দীর আদিপুরুষ ভট্টনারায়ণ রচিত ‘বেণীসংহার’ সংস্কৃত সাহিত্যের আদিনিদর্শন। তাহলে বলা যায়, ‘বেণীসংহার’ থেকে ‘গীতাঞ্জলি’- একই সূঁতোয় গাঁথা। শতশত বছর পেরিয়ে বহুপথ পরিক্রমায় অবশেষে কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি থেকে যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বেরিয়ে আসেন বিশ্বময় পরিচিতি নিয়ে, সেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতৃপুরুষেরা কনৌজ থেকে এসেছিলেন রাজসিক আহŸান পেয়ে। তাই, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বংশগত আভিজাত্যতাও কখনো মলিন হতে পারেনি।