রপ্তানির নবদিগন্ত

36

মুশফিক হোসাইন

বাবার একখানা বাইসাইকেল ছিল। সম্ভবত ব্রান্ড নাম ছিল রেলি ব্রিটিশদের তৈরি। জন্ম থেকে দেখছি বারান্দায় তালাবদ্ধ অবস্থায় পড়ে আছে। বাবার মুখে শুনেছি ১৯৪৮ সালে আহসান উল্যা ইঞ্জিনিয়ারিং থেকে লেখাপড়া সমাপ্ত করে চিটাগাং পোর্ট কমিশনে যোগ দেন। চট্টগ্রাম বন্দর তখন আসাম রেলওয়ের অধীন ছিল। পাকিস্তান হওয়ার পর ১৯৬০ সালে ‘পোর্ট ট্রান্স’ নামকরণ হয়ে আলাদা সংস্থা হিসাবে একটি ট্রাস্টির অধীনে পরিচালিত হতো। তৎসময়ে বন্দরের কার্যালয় ছিল সদর ঘাটের নিজস্ব ভবনে। বাবা চাকুরি নেওয়ার প্রথম মাসে সাইকেলটি ক্রয় করেন। তাতে চড়ে নিয়মিত অফিস করতেন। এ প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো যে, তখন চট্টগ্রাম শহরের গরুর গাড়ি, ঘোড়ার গাড়ি বেশি চলাচল করতো। মটর গাড়ি ছিল হাতেগোনা। লোকজন পায়ে হেঁটে চলাচল করতেন। শারীরিক কারণে এক সময় বাবা তা চালানো ছেড়ে দেন। এস এস সি পরীক্ষা দেওয়ার পর সাইকেলটি মেরামত করে আমি চালাতে থাকি। প্রয়াত কবি কাসাহো সাকু আর আমি দুটো সাইকেল নিয়ে সমস্ত চট্টগ্রাম চষে বেড়াই। থাক সে অন্য কথা, অন্য ইতিহাস।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ভারত থেকে অবাধে সাইকেল আসতো। ১৯৭৫ সালে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর চীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় এবং ব্যবসাবাণিজ্য চালু করে। সম্ভবতঃ ১৯৭৬ সাল থেকে চীনা বাইসাইকেল বাংলাদেশি বাজার দখল করে। তারপর ও উত্তর বঙ্গ দিয়ে ভারতীয় সাইকেল চোরাপথে আসা বন্ধু হয় নি। চীন থেকে সমুদ্র পথে চট্টগ্রাম বন্দরে চালান আসতো। চট্টগ্রামের কালীবাড়ি এলাকা ছিল বাইসাইকেল, পার্টস ও টায়ার টিউবের পাইকারী কেন্দ্র। এখান থেকে সমগ্র বাংলাদেশে তা সরবরাহ হতো।
এই সহজলভ্যতার কারণে দেশে রিক্সা হু হু করে বেড়ে যায়। ফলে দেশের বিভিন্ন পৌরসভা রিক্সার লাইসেন্স প্রদান শুরু করে এবং রিক্সা বাণিজ্য ব্যাপকতা লাভ করে। এমনও দেখা যায় ব্ল্যাকেও রিক্সার লাইসেন্স বেচাকেনা হতো।
বিশ্বজুড়ে পরিবেশবান্ধব বাহন হিসাবে বাইসাইকেলের জুড়ি নেই। ইউরোপীয় ও দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশের সরকার বাইসাইকেল চালানোর জন্য উৎসাহ প্রদান করে থাকে। এমন কী বাইসাইকেল চালকদের জন্য আলাদা লেইনের ব্যবস্থাও আছে। দিন দিন উন্নত দেশ সমূহে বাইসাইকেল ব্যবহার বেড়েই চলছে। ফলে বাইসাইকেল পার্টস তৈরি এবং উৎপাদন বিশ্বে বাড়ছে।
দক্ষিণ এশিয়ার কতিপয় দেশ বাইসাইকেল উৎপাদন ও রপ্তানিতে প্রথম সারি দখল করে আছে। ক্রমবর্ধমান চাহিদা ও রপ্তানি সুযোগ বৃদ্ধি ইত্যাদি বিবেচনায় বাংলাদেশের কিছু প্রতিষ্ঠান বাইসাইকেল উৎপাদন, সংযোজনের প্রতি নজর দেয়। ফলে দেশে প্রতিষ্ঠা হয় বেশকিছু কারখানা। ইউরোপীয় ইউনিয়ন কমিশনের তথ্যানুয়ায়ী ইইউর বাইরের বিভিন্ন দেশ থেকে ২০১৭ সালে ১০৮ কোটি ইউরোর বাইসাইকেল ক্রয় করে ইইউভুক্ত ২৮টি দেশ। তাদের হিসাবে বাংলাদেশ থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো বাইসাইকেল ক্রয় করে সর্বমোট ৬ কোটি ৫৪ লাখ ইউরোর। বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৬৪২ কোটি টাকা। তার আগের বছর বাংলাদেশ ঐ সকল দেশসমূহে রপ্তানি করে ৬ কোটি ৫১ লাখ ইউরোর বাইসাইকেল। উক্ত তথ্যানুযায়ী বর্ণিত বছরে বাংলাদেশের রপ্তানি বেড়েছে দশমিক ৪৬ শতাংশ। যা প্রতি বছর বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী তার আগের ১০ বছরে বাংলাদেশের রপ্তানি ছিল মাত্র দুই কোটি ৫০ লাখ ইউরো। পরিসংখ্যান বলছে ২০০৯ সালে ইইউতে বাইসাইকেল রপ্তানিতে বাংলাদেশ ছিল ষষ্ঠ স্থানে। আর ২০১৭ সালে উঠে আসে তৃতীয় স্থানে। তাইওয়ান ও কম্বোডিয়া যথাক্রমে প্রথম ও দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। পাঠকের জ্ঞাতার্থে তুলনামূলক একটি চিত্র দেয়া যাক। ইউরোপীয় কমিশনভুক্ত দেশসমূহে বর্ণিত বছরে সর্বোচ্চ ৪৫ কোটি ৬৩ লাখ ইউরোর বাইসাইকেল রপ্তানি করে তাইওয়ান। আর দ্বিতীয় স্থানে থাকা কম্বোডিয়া রপ্তানি করে ছিল ২৮ কোটি ৮৩ লাখ ইউরোর। তৃতীয় স্থানে থাকা বাংলাদেশ রপ্তানি করে মাত্র ৬ কোটি ৫১ লাখ ইউরোর বাইসাইকেল। প্রথম ও দ্বিতীয় স্থানের দেশ দুটোর রপ্তানি ছিল ইউরোর হিসাবে দুই অংকের ঘরে। সেখানে বাংলাদেশ এক অংকে।
সাইকেল রপ্তানিতে প্রধান প্রধান দেশগুলোর রপ্তানির প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যনীয়। তাইওয়ান ২০১৬ সালে ৫৩.৩৩ কোটি এবং ২০১৭ সালে ৪৪.৬৩ কোটি ইউরোর রপ্তানি করে। তাদের প্রবৃদ্ধি মাইনাস ১৬.২৬ শতাংশ। কম্বোডিয়া ২০১৬ সালে ২৮.৮৪ কোটি এবং ২০১৭ সালে ২৮.৮৩ কোটি ইউরোর। প্রবৃদ্ধি মাইনাস ০.০১ শতাংশ। সে তুলনায় বাংলাদেশ ২০১৬ সালে রপ্তানি করে ৬.৫১ কোটি এবং ২০১৭ সালে ৬.৫৬ কোটি ইউরোর। প্রবৃদ্ধি ০.৪৬ শতাংশ। এই স্মরণি থেকে বোঝা যায় প্রথম সারির দেশগুলোর প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক। অন্যদিকে বাংলাদেশ প্রবৃদ্ধি ধনাত্মক। অর্থাৎ বাংলাদেশের রপ্তানি গতিধারা গতিময় এবং উৎসাহব্যঞ্জক। এক্ষেত্রে অন্য প্রতিযোগীরা হলো চীন ১৬ সালে ২.০৭ কোটি এবং ১৭ সালে ৫.৩৮ কোটি ইউরো। তার প্রবৃদ্ধি সর্বোচ্চ ১৫৯.৯০ শতাংশ এবং ফিলিপাইন ১৬ সালে ৩.৪১ কোটি এবং ১৭ সালে ৪.৫৮ কোটি ইউরো। প্রবৃদ্ধি ৩১.৩১ শতাংশ।
অন্যদিকে ইইউর প্রায় প্রতিটি দেশই বাইসাইকেল উৎপাদন করে থাকে। তারা ইইউর দেশসমূহে রপ্তানিও করে থাকে। সংশ্লিষ্ট বছরে জার্মানি সর্বোচ্চ ৫০ কোটি ইউরো, পর্তুগাল ২০ কোটি, বেলজিয়াম ১৮ কোটি, ইতালি ১৫ কোটি, বুলগেরিয়া প্রায় ১০ কোটি এবং স্পেন প্রায় ৯ কোটি ইউরোর এবং নেদারল্যাÐ প্রায় ৪৫ কোটি ডলারের বাইসাইকেল ইইউভুক্ত দেশসমূহে রপ্তানি করেছে। সে বিবেচনায় বাংলাদেশ শীর্ষ ১০ কোটি তালিকায় নেই।
ইইউ কমিশনভুক্ত দেশের বাইরে বিশ্বের বিভিন্নদেশ বাইসাইকেল আমদানি করে থাকে। বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যে জানা যায় ২০১৭ সালের অর্থ বছরে ৮ কোটি ৫৭ লাখ ডলারের বাইসাইকেল রপ্তানি করে। এই আয় তার আগের অর্থ বছরের চেয়ে ৩ দশমিক ৯৭ শতাংশ বেশি। বাংলাদেশে বাইসাইকেল রপ্তানিতে নেতৃত্ব দিচ্ছে মেঘনা গ্রæপ তারা ১৯৯৬ সালে সরকারি বাইসাইকেল তৈরির কারখানা কিনে নেয়। তার তিন বছর পর থেকে ঐ কারখানা থেকে রপ্তানি শুরু করে। হালে মেঘনা গ্রæপ ছাড়াও ট্রান্সওয়ার্ল্ড বাইসাইকেল ইউনিট, গেøারী ও মাহিন সাইকেল ইন্ড্রাট্রিজ নামে তিনটি প্রতিষ্ঠানে বাইসাইকেল উৎপাদন করছে মেঘনা গ্রæপ। এসকল কারখানার প্রতিটিতে প্রায় ৪০০ করে সর্বমোট ১২০০ শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়েছে। এছাড়া ইউনি গেøারী হুইলস নামের কারখানায় সিট, প্যাডেল, গ্রিপসহ সাইকেলের বিভিন্ন সরঞ্জাম এবং মেঘনা রাবার ইন্ড্রাস্ট্রিজে টায়ার টিউব উৎপাদন করে থাকে। বলা যায় মেঘনাগ্রæপ বাইসাইকেলের ৯০ শতাংশ যন্ত্রাংশ নিজেরা উৎপাদন করে থাকে। এই গ্রæপ ২০১৭-২০১৮ সালে চারকোটি ডলারের বাইসাইকেল রপ্তানি করে। এছাড়া তাদের কারখানায় উৎপাদিত টায়ার, টিউব বিশ্বের ১৮টি দেশে সরাসরি রপ্তানি করে থাকে। যার পরিমাণ প্রায় ২০ লাখ ডলার। এছাড়া দেশের অভ্যন্তরের বাজারে মেঘনাগ্রæপের বাইসাইকেলের চাহিদা ব্যাপক।
বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায় যে, বাইসাইকেল রপ্তানিতে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ খুবই উজ্জ্বল। প্রতি বছর দেশের রপ্তানি বাড়েছে। যদিও স্বয়ংসম্পূর্ণ অটোমেটিক কারখানা স্থাপন ব্যয়বহুল। এছাড়া সরঞ্জাম উৎপাদনের পশ্চাদমুখী কারখানা ছাড়া সাইকেল ব্যবসাটিকে থাকা মুশকিল।
সম্প্রতি বিশ্বে গ্রীন ইন্ড্রাস্ট্রিজ স্থাপনের দাবি ও গুরুত্ব বাড়ছেই। আবার জলবায়ু পরিবর্তন ও কভিট-১৯ এর অভিজ্ঞতা বিশ্বকে নানা সমীরণে উপস্থিত করেছে। গণপরিবহণে চলাচলের সতর্কতা বাড়ছে। জলবায়ু দূষণের হার কমানোর জন্য জীবাশ্ম জ্বালানি পরিহার বা কমানোর জন্য বিশ্ব নেতৃবৃন্দ কাজ করে যাচ্ছেন। কার্বন নিঃসরণের ঝুঁকি হ্রস করার জন্য পরিবেশ সচেতন মানুষ সোচ্চার। এ সকল বিষয় বিবেচনা করলে বাহন হিসাবে বাইসাইকেলের গুরুত্ব দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। শুধু ইউরোপ নয় বিশ্বের প্রায় সকল দেশ একদিন বাইসাইকেলনির্ভর হতে বাধ্য হবে।
এমতাবস্থায় বাংলাদেশ সরকার ও শিল্প উদ্যোক্তাদের নতুনভাবে বাইসাইকেল উৎপাদনে এগিয়ে আসতে হবে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে সস্তা মজুরি ও বিপুল পরিমাণ জনসংখ্যার সঠিক ব্যবহার বিবেচনায় বাংলাদেশ এই শিল্পে বিনিয়োগ বাড়ালে বৃথা যাবে না। প্রয়োজনে যৌথ উদ্যোগে আধুনিক ও স্বয়ং সম্পূর্ণ কারখানা প্রতিষ্ঠা করার জন্য সরকারের নমনীয় নীতিমালা গ্রহণ করা আবশ্যক। বিশ্বের উন্নত দেশ যারা জি এস পি সুবিধা দেয় না, তাদের সাথে দেনদরবার বা কূটনৈতিক পর্যায়ে মীমাংসা করলে বাইসাইকেলের রপ্তানি বাড়বে। বর্তমানে বাইসাইকেলের যন্ত্রাংশ আমদানিতে ৫৫ শতাংশ শুল্ক লাগে। রপ্তানির স্বার্থে শুল্ক কমালে প্রতিযোগিতা মূল্যে উৎপাদন সম্ভব। পাশাপাশি কম মূল্যে বহির্বিশ্বে বাইসাইকেল রপ্তানিও বেড়ে যাবে। সরকারের উচিত হবে পোশাক শিল্পের মতো এই শিল্পকে বিশেষ বিবেচনায় প্রণোদনা প্রদান করা। এতে করে বাংলাদেশের রপ্তানি খাতে নব দিগন্ত উন্মোচিত হওয়ার সম্ভাবনা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বাংলাদেশে মেঘনা গ্রুপ ছাড়াও প্রাণ, আর এফ এল, আলিটা ফায়ারর ফক্স, জার্মান-বাংলা কোম্পানি, রংপুর মেটালসহ বেশকিছু প্রতিষ্ঠান বাইসাইকেল উৎপাদন ও রপ্তানি করে থাকে। সরকারি প্রণোদনা পেলে আরো অনেক উদ্যোক্তা এগিয়ে আসবেন নিঃসন্দেহে।

লেখক : কবি ও ব্যাংক নির্বাহী (অব)