রণদা প্রসাদ সাহা (১৮৯৬-১৯৭১)

59

সমাজসেবক ও শিল্পানুরাগী। আর.পি সাহা নামেই তিনি অধিক পরিচিত। ১৮৯৬ সালের ১৫ নভেম্বর সাভার উপজেলার শিমুলিয়া ইউনিয়নের কাছৈড় গ্রামে মাতুলালয়ে তাঁর জন্ম। পিতার নাম দেবেন্দ্রনাথ পোদ্দার এবং মাতার নাম কুমুদিনী দেবী। দেবেন্দ্রনাথ টাঙ্গাইল জেলার মির্জাপুর গ্রামের অধিবাসী। দেবেন্দ্রনাথের তিন পুত্র ও এক কন্যার মধ্যে রণদা প্রসাদ দ্বিতীয়। দেবেন্দ্রনাথের পূর্ব পুরুষ ক্ষুদ্র ব্যবসার সাথে জড়িত থাকলেও দেবেন্দ্রনাথের নির্দিষ্ট কোন পেশা ছিলনা। তিনি দলিল লেখক হিসেবে কাজ করতেন, কখনও কখনও তিনি লগ্নি ব্যবসাতেও জড়িত থাকতেন। রণদা মাত্র সাত বছর বয়সে মাতৃহারা হন। তৃতীয় শ্রেণির পর রণদার পড়াশুনা বন্ধ হয়ে যায়। কিশোর রণদা বাড়ী থেকে পালিয়ে কলকাতা যান এবং তিনি বিভিন্ন ধরনের কায়িকশ্রম যেমন- কুলি, শ্রমিক, রিক্সা চালক, ফেরিওয়ালার প্রভৃতির কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। এক পর্যায়ে রণদা জাতীয়তাবাদী বা স্বদেশী আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে পড়েন ও কিছুদিন হাজতবাসও করেন। ১৯১৪ সালের ২৮ জুলাই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। ভারত থেকেও অসংখ্য তরুন যুদ্ধের জন্য সেনাবাহিনীতে নাম লিখায়। রনদা প্রসাদ সাহা বাঙালিদের প্রথম সামরিক সংগঠন বা ইউনিট ‘বেঙ্গল এ্যম্বুলেন্স কোর’-এ যোগ দেন। রণদা ১৯১৫ সালের ১ এপ্রিল থেকে আলিপুর সেনানিবাসে ১৬ রাজপুত রেজিমেন্টের তত্ত¡াবধানে প্রশিক্ষন গ্রহণ করেন এবং প্রশিক্ষণ শেষে ১৯১৫ সালের ২৬ জুন মেসোপটেমিয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করে মুম্বাই ও বসরা হয়ে ১৫ জুলাই আমারা শহরে পৌঁছেন। সেখানে তাঁরা বেঙ্গল স্টেশনারি হসপিটাল চালু করেন। ১৯১৫ সালের ৮ সেপ্টেম্বর রণদা ৬ ডিভিশনের ২ ফিল্ড এ্যাম্বুলেন্সের সাথে সংযুক্ত হয়ে বাগদাদ দখলের জন্য ক‚ট আল আমারা (সংক্ষেপে ক‚ট)-এর উদ্দ্যেশ্যে রওনা হন। কূট দখলের পর ২ ফিল্ড এ্যম্বুলেন্স বাগদাদ অভিমুখে রওনা হয়। বাগদাদের পথে টেসিফোন অঞ্চলে পৌঁছানোর পর ২২ ও ২৩ নভেম্বর বৃটিশ বাহিনীর সাথে তুর্কী বহিনীর যুদ্ধ হয় এবং রণদা এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। বৃটিশ বাহিনী এ যুদ্ধে পরাজিত হয়ে কূটে ফিরে যায়। তুর্কী বাহিনী কূট অবরোধ করলে, ১৯১৬ সালের ২৯ এপ্রিল বৃটিশ বাহিনী তুর্কী বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে ও রণদা প্রসাদ সহ অন্যান্যদের যুদ্ধবন্দী হিসেবে বাগদাদ নিয়ে যাওয়া হয়। ১৯১৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম দিকে যুদ্ধবন্দী বিনিময়ের সুবাদে ২৬ সেপ্টেম্বর রণদা প্রসাদ সাহা কলকাতা ফেরৎ আসেন।
১৯৪২ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে সরকার প্রচুর খাদ্য সংগ্রহ ও মজুদের জন্য সারা বাংলায় ৪ জন প্রতিনিধি নিয়োগ করে। রণদা প্রসাদ ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। এ ব্যবসায়ও তিনি প্রচুর মুনাফা অর্জন করেন। এভাবে দেশ বিভাগের পূর্বেই রণদা বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান ব্যবসায়ী এবং শিল্প উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পান। ১৯৪৩ সালে রণদা টাঙ্গাইলে মেয়েদের জন্য কুমুদিনী কলেজ স্থাপন করেন। ১৯৪৬ সালে তিনি পিতার নামে মানিকগঞ্জে দেবেন্দ্র কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। এ ছাড়াও তিনি দেশের বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করেন। বাংলাদেশে ট্রাস্টের আওতায় বর্তমানে কুমুদিনী হাসপাতাল, নার্সিং বিদ্যালয়, মহিলা চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়, ভিলেজ আউটরিচ প্রোগাম, ভারতেশ্বরী হোমস, ট্রেড ট্রেনিং বিদ্যালয়, কুমুদিনী হেন্ডিক্রাফ্টস, জুট বেলিং ও ওয়্যার হাউস, বেঙ্গল রিভার সার্ভিস, ফার্মাসিউটিক্যালস ও বিভিন্ন ব্যবসা পরিচালিত হচ্ছে।
রণদা শৌখীন অভিনেতা হিসেবে সুনাম অর্জন করেন। সৈনিক অবস্থায় করাচীতে তার নাট্য জীবন শুরু। ১৯৬৯ সালে ‘আলমগীর’ নাটকের মূল চরিত্রে অভিনয় করে তিনি বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। ব্রিটিশ সরকারকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে সহযোগিতা প্রদানের জন্য রণদা ১৯৪৪ সালে ‘রায় বাহাদুর’ খেতাব প্রাপ্ত হন। ১৯৬৯ সালে পাকিস্তান সরকার সমাজ সেবার জন্য তাঁকে ‘হেলাল এ পাকিস্তান’ খেতাব প্রদান করে। ১৯৭৮ সালে রণদা বাংলাদেশের সর্বোচ্চ খেতাব স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার পান। ১৯৮৪ সালে ‘কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট’ ও সমাজ সেবায় অসামান্য অবদানের জন্য ‘স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার’ লাভ করে। বাংলাদেশ সরকারের ডাক বিভাগ ১৯৯১ সালে রণদা প্রসাদের স্বরণে একটি ডাকটিকিট প্রকাশ করে।
১৯৭১ সালের ৭ মে পশ্চিম পাকিস্তানের হানাদার বাহিনী সহযোগীরা মির্জাপুর থেকে রণদা প্রসাদ সাহা ও তার পুত্র ভবানী প্রসাদ সাহাকে ধরে নিয়ে যায়। পরবর্তীতে তাঁদের কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। সূত্র : বাংলাপিডিয়া