রক্তে টর্নেডো তোলা স্লোগানের নাম

105

দীর্ঘ ৪৮ বছর পর আবার ফিরে আসছে মুক্তিযুদ্ধের অবিনাশী স্লোগান জয় বাংলা। যে স্লোগান ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রতিটি মুহূর্তে যুদ্ধ জয়ের একমাত্র হাতিয়ার। যে স্লোগান বলে বলীয়ান হয়ে বাঙালিমাত্রই ঝাঁপিয়ে পড়েছিল অসম যুদ্ধে এবং এই স্লোগানের অন্তর্নিহিত শক্তিতে বাঙালি জাতি মাত্র নয় মাসেরও কম সময়ে অর্জন করেছে স্বাধীনতার স্পর্শ মণি। আজ আমরা যে স্বাধীন, আমরা যে বুক ফুলিয়ে কথা বলতে পারছি তার মূলে রয়েছে জয় বাংলা। গত ১০ ডিসেম্বর মহামান্য হাইকোর্ট এ মর্মে অভিমত দিয়েছেন যে, সর্বস্তরে জাতীয় স্লোগান হিসেবে জয় বাংলা ব্যবহার করা উচিত। অভিমতে আদালত বলেছেন, ১৬ ডিসেম্বর থেকে জাতীয় দিবসে, রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে ও কর্মকাণ্ড জাতীয় স্লোগান হিসেবে জয় বাংলা ব্যবহার করা উচিত। বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহসান ও বিচারপতি এ এম কামরুল কাদেরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ সংক্রারু রুল শুনানিতে এই অভিমত দেন। ( প্রথম আলো, ১১/১২/২০১৯) মহামান্য হাইকর্টের এ অভিমত প্রদানের ফলে বাঙালির প্রাণের স্লোগান, ভালোবাসার স্লোগান, আন্দোলনে-সংগ্রামে রক্তে টর্নেডো তোলা স্লোগান আবার স্বমহিমায় ফিরে আসছে। এ অভিমতের ফলে একটি বিষয় দিবালোকের মতো স্পষ্ট হলো, জয় বাংলা কোনো দলের স্লোগান নয় এটি এদেশের প্রতিটি মানুষের প্রাণের স্লোগান। এখন থেকে এদেশের প্রত্যেক মানুষকে জাতীয় দিবসে এবং রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে এ স্লোগান দিতে হবে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করার পর খুনি খন্দকার মোশতাক আহমদ বাংলাদেশের ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের ভূখণ্ড থেকে জয় বাংলা স্লোগান নির্বাসনে পাঠিয়েছিলেন, জয় বাংলা’র জায়গায় তাঁরা আমদানি করেছিলেন বাংলাদেশ জিন্দাবাদ। তারপর দীর্ঘ একুশ বছরব্যাপী জাতির পিতার নামের সাথে এ শব্দটি কোথাও উচ্চারিত ও ব্যবহ্নত হয়নি। এ একুশ বছর বাংলাদেশের রাজনীতিকে যিনি যেভাবে পেরেছেন কলুষিত করেছেন। মানি ইজ নো প্রবলেম বলে নিজেদের স্বার্থে, নিজেদের ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করার জন্য এমন কোনো কর্মকাণ্ড নেই যা তারা করেননি। ব্যারাকে ফিরে যাওয়ার কথা বলে ক্ষমতায় আসলেও কারো ব্যারাকে ফিরে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়ে ওঠেনি। তাদের একজন যিনি দেশের প্রেসিডেন্টকে হত্যার খবর শুনে যেখানে হত্যাকারীদের নির্মূলে এগিয়ে যাবার কথা সেখানে তিনি তা না করে বলে উঠেছিলেন, সো হোয়াট।
পৃথিবীর ইতিহাসে জোর করে যারা ক্ষমতায় আসীন হয়েছিলেন তাদের কারো স্বাভাবিক প্রস্থান হয়নি। যেমন হয়নি সো হোয়াট, মানি ইজ নো প্রবলেম আর খাল কেটে কুমির আনা জেনারেলের। আরেক জেনারেল গণআন্দোলনে গদিচ্যুত হয়ে ঠাঁই পেয়েছিলেন কারাগারে। এই দুই জেনারেলের একজন রাজাকারকে বসিয়েছিলেন রাজাসনে। বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিদের রাজকুমারের হালে আশ্রয় প্রশ্রয় দিয়ে দুধে-ভাতে লালন করেছেন। রাজাকার, আলবদর, আলশামস নামক মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী, দেশের সাধারণ মানুষের রক্তে যাদের হাত রন্জিত ছিল তাদের বানিয়েছেন মন্ত্রী, এমনকি বসিয়েছেন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে। এভাবে যারা মুক্তিযুদ্ধের মহৎ অর্জনগুলোকে নিজেদের স্বার্থে ধ্বংস করে দিতে পারেন, তারা আর যা-ই হোক দেশপ্রেমিক কিংবা স্বদেশের প্রতি তাঁদের কোনো দায়বোধ ছিল তা কখনো বলা যাবে না।
আমরা সবাই জানি, জয় বাংলা সেøাগান এদেশের মুক্তিকামী মানুষের রক্তের স্পন্দন। প্রতিটি শিরা উপশিরায় যা ফুটরু গরম পানির মতো টগবগ করে ফুটতে থাকে। জয় বাংলা বাঙালির মুক্তির মন্ত্র-বিজয়ের মূলমন্ত্র। এ অবিনাশি স্লোগান বুকে ধারণ করে, সমস্বরে উচ্চারণ করে, মরণের ভয়কে জয় করে ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধা হয়ে ওঠেছিল সমগ্র জাতি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ শেষ করেছিলেন জয় বাংলা বলে। সেই থেকে এদেশের আবাল-বৃদ্ধ-জনতা ‘ যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলায় এই বাংলাকে জয় করার জন্য, শত্রুমুক্ত করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মরণপণ যুদ্ধে। তাঁদের বুকে ছিল জয় বাংলা, মুখে ছিল বজ্রকণ্ঠে জয় বাংলা স্লোগান। সবার বুকে স্পন্দিত ও মুখে উচ্চারিত আকাশ-বাতাসে প্রতিধ্বনিত এই জয় বাংলা স্লোগান ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রধানতম হাতিয়ার। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মারতে মারতে এবং মরতে মরতে মুক্তিকামী মানুষ বারবার উচ্চারণ করেছে জয় বাংলা স্লোগান। আক্রমণের মুখে, বিপদের মুখে, বিজয়ের মুখে, শেষ নিশ্বাস ত্যাগ না করা অবধি প্রত্যেক মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিকামী মানুষের মুখে ছিল এই জয় বাংলা স্লোগান- যা ছিল তাঁদের কাছে অমৃতের সমান। তাই এই জয় বাংলা বলতে বলতে মৃত্যুর মধ্যেও তাঁরা খুঁজে পেয়েছিলেন সুখ।
বাংলাদেশের স্বাধীকার আন্দোলনের প্রতিটি পর্যায়ে জয় বাংলা স্লোগান আমাদের কোনো না কোনোভাবে অনুপ্রাণিত করেছে। বাঙালিরা কোনো আন্দোলনেই হারেনি,হয়তো সময় লেগেছে, নির্যাতন -নিপীড়নের শিকার হতে হয়েছে কিন্তু জয় ঠিকই ঘরে তুলে নিয়েছে। বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনে রফিক, সালাম, বরকত, শফিউর, জব্বার আর কিশোর অহিউল্লাহর রক্তের বিনিময়ে আমরা জয় করে নিয়েছি মায়ের ভাষার দাবি, আ মরি বাংলা ভাষা। ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালে বাঙালির মুক্তির সনদ ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালে আইয়ুব বিরোধী ও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারের জোরালো আন্দোলন, বিভিন্ন সময়ে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে আন্দোলনে রাজপথ প্রকম্পিত করা অন্যান্য স্লোগানের সঙ্গে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান ছিল অনিবার্য ও অবিনাশী স্লোগান। ১৯৬৯ সালে আইয়ুব খান তুমুল আন্দোলন আর মুহুর্মুহু ‘জয় বাংলা স্লোগানের প্রবল প্রতাপে শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে আনীত সকল অভিযোগ প্রত্যাহার করে তাঁকে মুক্তি দিতে বাধ্য হন। জাতি একটি মিথ্যা ও সাজানো মামলার বিরুদ্ধে লড়ে জয়লাভ করে, জয় হয় বাংলার।
১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমানকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করা হলে জয় বাংলা‘র সাথে যুক্ত হয় জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগান। সত্তরের নির্বাচনে ঘরে ঘরে নৌকার সাথে প্রতিধ্বনিত হয় জয় বাংলা স্লোগান। উত্তাল মার্চে র প্রতিটা মুহূর্ত ছিল ‘জয় বাংলা স্লোগানে রাজপথ উত্তাল। জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে ভঙ্গ করা হয় কারফিউ। জয় বাংলা জয় বাংলা ধ্বনিতে উদ্বেলিত হয়ে উঠেছিল বাংলার প্রতিটি গৃহকোণ। যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সৈন্যরা রাজাকারদের সাথে নিয়ে জয় বাংলা র লোকদের খুঁজে ফিরত। তোম জয় বাংলা’র লোক হে বলে পাকিস্তানি সৈন্যরা কত নিরীহ মানুষকে রাইফেল দিয়ে পিটিয়েছে তার সঠিক হিসেব কেউ দিতে পারবে না।
যে স্লোগানের বলে আমরা দীর্ঘ নয় মাসব্যাপী যুদ্ধ করে তিরানব্বই হাজার পাকিস্তানি সৈন্যকে পরাজিত করে বাংলার জয় ছিনিয়ে এনেছি। যে স্লোগানের বলে সত্তরের নির্বাচনে ধস নামানো বিজয় অর্জন করেছি। যে স্লোগানের বলে বঙ্গবন্ধুকে বার বার জেল থেকে মুক্ত করে এনেছি। যে স্লোগানকে পাকিস্তানিরা ভয় করত যমের মতো। যে স্লোগান নিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘শেষ নিশ্বাস ত্যাগের সময়ও তিনি পবিত্র কলেমা পাঠের সাথে ‘জয় বাংলা’ উচ্চারণ করবেন। ‘(জয় বাংলা/ মোঃ রহমত উল্লাহ/ইত্যাদি গ্রন্হ প্রকাশ/ ঢাকা, ডিসেম্বর ২০১৬/ পৃষ্টা-১৬-১৭)। যে স্লোগান জাতীয় অস্থিমজ্জায় একাকার হয়ে আছে তা জাতীয় স্লোগান না হয়ে পারে না।
আমরা বাঙালি। আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। বাংলাদেশ আমাদের জন্মভূমি। জয় বাংলা আমাদের ঐক্যের বন্ধন। অগ্রগতির পাথেয়। জয়ের শক্তি। মুক্তিযুদ্ধের যাঁরা অকাতরে প্রাণ দিয়েছে তাঁদের মানসিক হাতিয়ার এই ‘জয় বাংলা। সুতরাং মুক্তিযুদ্ধে শহিদদের যথাযথ সম্মান জানাতে, দীর্ঘ তেইশ বছরে লাখো লাখো জনতার মুখে উচ্চারিত ধ্বনিকে সম্মান জানাতে, তুমি জয় বাংলা’র লোক বলে পাকিস্তানি হায়েনাদের হাতে নির্যাতিত লোকদের সম্মান জানাতে, ৭ মার্চের জনসমুদ্র ও দিক নির্দেশনামূলক ঐতিহাসিক ভাষণকে সম্মান জানাতে ‘জয় বাংলাই জাতীয় শ্লোগান হওয়া উচিত। আমরা মনে করি মহামান্য হাইকোর্টের এই অভিমতের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়রুী পরিপূর্ণ সফল ও অর্থবহ হয়ে উঠবে।