যে ভাষণ দিয়েছে-আমাদের মুক্তির সংগ্রাম

757

কবীর চৌধুরী তন্ময়

আজ থেকে ঊনপঞ্চাশ বছর আগের কথা। ধর্মীয় চিন্তা, সা¤প্রদায়িকতার মানসিকতা আর তথাকথিত দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে গঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের শোষণ, নির্যাতন, নিপীড়ণের বিরুদ্ধে ২৩ বছরের আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্যদিয়ে বাঙালি জাতিসত্তা, জাতীয়তাবোধ ও জাতিরাষ্ট্র গঠনের যে ভিত রচিত হয়েছিল তারই চূড়ান্ত পর্যায়ের দিন ৭ই মার্চ। ১৯৭১ সালে পরাধীনতার দীর্ঘ প্রহর শেষে পুরো জাতি তখন স্বাধীনতার জন্য অধীর অপেক্ষায়। শুধু প্রয়োজন একটি ঘোষণার, একটি আহ্বানের। অবশেষে ৭ই মার্চ এলো সেই ঘোষণা। অগ্নিঝরা একাত্তরের এইদিনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা নামক মহতী কাব্যের মহাকবি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বজ্রগম্ভীর কণ্ঠ থেকে ধ্বনিত হয়েছিল স্বাধীনতার ঘোষণা, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’।
বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ হয়ে উঠে বাঙালির স্বাধীনতা-মুক্তি ও জাতীয়তাবোধ জাগরণের মহাকাব্য, বাঙালি তথা বিশ্বের সকল লাঞ্চিত-বঞ্চিত নিপীড়িত-নির্যাতিত মানুষের মুক্তির সনদ। ইতিহাসের ম্যাগনাকার্টার ৭ই মার্চের ভাষণ বাঙালির পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচনের চূড়ান্ত অনুপ্রেরণা।
সেদিন বিকাল ৩টা ২০ মিনিটের সময়। সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি আর হাতাকাটা কালো কোট পরে বাঙালির প্রাণপুরুষ দৃপ্তপায়ে মঞ্চে এসে দাঁড়ালেন, দাঁড়ালেন মাইকের সামনে। চারপাশে আকাশ-কাঁপানো স্লোগান- ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা, তোমার আমার ঠিকানা’। মুহুর্মুহু করতালি যেন মুক্তির নৃত্য সংগীতের আভাস। হাত নেড়ে অভিনন্দন জানালেন অপেক্ষমান মুক্তিকামী জনতার উদ্দেশে। শুরু করলেন তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণ।
এ যেন স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করতে শুরু করলেন। যে কবিতার প্রতিটি পঙতিমালায় গাঁথা আছে বাঙালি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামের রূপরেখা। উদ্দীপ্তকন্ঠে উচ্চারণ করতে লাগলেন, ‘আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়, তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো।’ নিরস্ত্র মানুষকে সাহস আর উদ্দীপ্ত করতে বঙ্গবন্ধু তাঁর কবিতার ভাষায় বললেন, ‘তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রæর মোকাবেলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে, সবকিছু, আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে।’
মাত্র ১৯ মিনিটের ভাষণ। এই স্বল্প সময়ে তিনি ইতিহাসের পুরো ক্যানভাসই যেন তুলে ধরলেন। তিনি তাঁর ভাষণে সামরিক আইন প্রত্যাহার, জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তাস্তর, গোলাগুলি ও হত্যা বন্ধ করে সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেয়া এবং বিভিন্ন স্থানের হত্যাকান্ডর তদন্তে বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠনের দাবি জানালেন।
১০ লক্ষেরও অধিকা জনসমুদ্রের সামনে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘ভাইয়েরা আমার, আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাই না, মানুষের অধিকার চাই। প্রধানমন্ত্রীত্বের লোভ দেখিয়ে আমাকে নিতে পারেনি। ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলিয়ে দিতে পারেনি। আপনারা রক্ত দিয়ে আমাকে ষড়যন্ত্র-মামলা থেকে মুক্ত করে এনেছিলেন। সেদিন এই রেসকোর্সে আমি বলেছিলাম, রক্তের ঋণ আমি রক্ত দিয়ে শোধ করবো। আজো আমি রক্ত দিয়েই রক্তের ঋণ শোধ করতে প্রস্তুত।’
ঊনিশ মিনিটের ভাষণটি এতোটাই শক্তিশালী ছিল যে, স্বাধীনতাবিরোধী ও তাদের দোসররা ১৯৭৫ সালে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যা করে দীর্ঘ ২৬ বছর বাঙালি জাতি ও তার প্রজন্মের কাছে ধামাচাপা দিয়েও রাখতে পারেনি, সফল হয়নি বিকৃতি করেও এ জাতিকে ভিন্নখাতে পরিচালিত করতে। বাঙালি জাতি তার মোক্ষম সময়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। আর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষন আজ শুধু বাংলার ঘরে ঘরেই নয়, বিশ্বের প্রামাণ্য দলিল হিসেবেও স্বীকৃতি পেয়েছে। ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে জাতিসংঘের শিক্ষা বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো।
মহাকালের রাজনীতির মহাকবি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষণ নিয়ে এখন গবেষণা হচ্ছে। ১৯ মিনিটের অলিখিত ওই ভাষণ দিয়ে কীভাবে বাঙালি জাতিকে মহা ঐক্যের দিকে নিয়ে গেছে, কীভাবে একটি ভাষণ একটি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছে, ওই ভাষণে কী মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে ৩০ লাখ মানুষ তাঁদের তাজা লাল টকটকে রক্ত বাংলার সবুজ জমিনে ঢেলে দিয়েছে, কীভাবে ২ লাখেরও বেশি নারী তাঁদের সর্বস্ব ত্যাগ সম্ভ্রম বিনাশের মাধ্যমে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছে-বিষয়গুলো নিয়ে।
অনেকে আবার বিশ্বের অন্যান্য বিশ্বখ্যাত ভাষণের সাথে তুলনা করেও মিল খোঁজে পায়নি। যেমন, বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ১৯ মিনিটের অলিখিত ভাষণের শব্দ সংখ্যা ছিল ১৩০৮টি। যা তিনি ধারণ করতেন, যা বাঙালির মুক্তির সংগ্রামের পথ বলে মনে করতেন; এক এক করে হৃদয়ের গহীন থেকে উপলব্দি করা অলিখিতভাবে সুন্দর শব্দ চয়ন সাজিয়েছেন, বলেছেন-যা আজও নতুন প্রজন্মের মাঝে শিহরণ সৃষ্টি হয়, উদ্দীপ্ত হয়ে সকল অন্ধকারের বিরুদ্ধে ঘুরে দাঁড়াতে সাহসী করে তোলে।
১৮৬৩ সালের ১৯ নভেম্বর আমেরিকার চরম দুঃসময়ে পেনসিলভেনিয়ার গেটিসবার্গে আমেরিকার ১৬তম প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের লিখিত এবঃঃুংনঁৎম অফফৎবংং-এর বক্তব্যের শব্দ সংখ্যা ২৭২টি আর সময় ছিল ৩ মিনিটেরও কম। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক অধিকার আন্দোলনের নেতা মার্টিন লুথার কিং-এর নেতৃত্বে কালো মানুষ পেয়েছে সাদা মানুষের সমান অধিকার, আর সাদা নাগরিকেরা পেয়েছে বর্ণবাদের অভিশপ্ত থেকে মুক্তি। ১৯৬৩ সালের ২৮ আগস্ট প্রায় আড়াই লাখ মানুষের সামনে মার্টিন লুথার কিং-এর লিখিত ভাষণ ‘Jacob F. Field’ বক্তব্যের ১৭ মিনিট সময়ের শব্দ সংখ্যা ১৬৬৭টি। আব্রাহাম লিংকন গণতন্ত্র আর মার্টিন লুথার কিং মার্কিন রাজ্যে সভ্যতার জন্য খ্যাতি অর্জন করলেও একমাত্র বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে বাঙালি জাতি মন-মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র বিশ্বের মানচিত্রে প্রতিষ্ঠিত করেছে। অপরদিকে, বিশ্বের কোনও নেতার ভাষণ শত্রæর বুলেটের মুখে এমন সংগ্রামমুখর ১০ লক্ষেরও বেশি মুক্তিকামী নিরস্ত্র মানুষের সামনে আর হয়নি।
বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ বিশ্ব ঐতিহ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রামাণিক দলিল এবং বিশ্বে সর্বাধিকবার প্রচারিত ও শ্রবণকৃত ভাষণ।
বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিকে যুদ্ধের রণকৌশল বলার মাঝেও প্রশাসনকে ভালোবাসায় সতর্ক করে বলেন, ‘…সৈন্যরা, তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাকো, কেউ তোমাদের কিছু বলবে না। কিন্তু আর আমার বুকের উপর গুলি চালাবার চেষ্টা করো না। সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবাতে পারবে না।’
ওই ভাষণের কিছু অংশে দেখা যায়-সেদিন যুদ্ধের ঘোষণা পরোক্ষভাবে প্রদান করার সাথে সাথে স্বাধীন রাষ্ট্রের বৈধ সরকারপ্রধানের মতো এক পর্যায়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘২৮ তারিখে কর্মচারীরা গিয়ে বেতন নিয়ে আসবেন।’
আইএসআই-এর রিপোর্ট থেকে জানা যায়, ৭ই মার্চের ভাষণের সময় বঙ্গবন্ধু ছিলেন অত্যন্ত সতর্ক-সাবধান। চারপাশে পাকিস্তানিদের পাতানো ফাঁদ ছিঁড়ে বের হয়ে তিনি উল্টো শত্রæদেরই ঘায়েল করেন। ৮ মার্চ আইএসআই রিপোর্ট করলো, ‘চতুর শেখ মুজিব চতুরতার সাথে বক্তৃতা করে গেল। একদিকে স্বাধীনতা ঘোষণা করলো, আরেকদিকে ৪টি শর্ত আরোপ করে বিচ্ছিন্নতাবাদী আখ্যায় আখ্যায়িত হলো না এবং পাকিস্তান ভাঙার দায়িত্ব নিলো না। আমাদের নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করা ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না। আমরা যে প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিলাম সেটা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলো।’
৭ই মার্চের উত্তাল দিনটিতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকা ছিল মিছিলের শহর। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দলে দলে মানুষ পায়ে হেঁটে, বাস-লঞ্চে কিংবা ট্রেনযোগে রেসকোর্স ময়দানে সমবেত হয়েছিল। ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে লাখ লাখ জনতার মিছিল এসে সয়লাব হয়ে গিয়েছিল বিশাল সে ময়দান। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনতে আসা মানুষের ভিড়ে সেদিন রেসকোর্স ময়দান রূপ নিয়েছিল জনতার সমুদ্রে। মুহুর্মুহূ গর্জনে ফেটে পড়েছিলেন উত্থিত বাঁশের লাঠি হাতে সমবেত লাখ লাখ বিক্ষুব্ধ মানুষ। বাতাসে উড়ছিল বাংলার মানচিত্র আঁকা লাল সূর্যের পতাকা আর পতাকা।
বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যময় ঘটনা। তাঁর এ ভাষণই দ্বিধা-দ্বন্দ্বে থাকা বাঙালি খোঁজে পেয়েছিল স্বপ্নের অমর জ্যোতি। পরাধীনতার দীর্ঘ প্রহর শেষে স্বাধীনতার জন্য এমন একটি মাহেন্দ্রক্ষণের জন্যই যেন অধীর অপেক্ষায় ছিল বাঙালি জাতির আপামর জনতা। এই ভাষণের আহ্বানেই কৃষক-শ্রমিক জনতার সর্বস্তরের মানুষ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ২৫ মার্চের কালরাতে পাকবাহিনীর নৃশংস গণহত্যার পর ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু দেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। ৯ মাসের যুদ্ধ শেষে ১৬ ডিসেম্বর অর্জিত হয় চূড়ান্ত বিজয়। অভ্যুদয় ঘটে বাংলাদেশ নামের একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের।
বিখ্যাত লেখক ও ইতিহাসবিদ Jacob F. Field-এর বিশ্বসেরা ভাষণ নিয়ে লেখা ‘We Shall Fight on the Beaches: The Speeches That Inspired History’ গ্রন্থে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ স্থান পেয়েছে। আবার অসংখ্য ভাষায় অনুদিত হয়েছে এই ভাষণ। আর ১৯৭২ সালের ৫ এপ্রিল মার্কিন সাময়িকী ‘News week’ ম্যাগাজিনে বঙ্গবন্ধুকে ‘Poet of politics’ খেতাবে আখ্যায়িত করে একটি কাভার স্টোরি করে। রাজনীতির কবির ৭ই মার্চের সেই ভাষণ আজও অনুরণিত হয় সর্বত্র। তবে একে বিশ্লেষণে আজও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী গবেষকরা বিস্মিত হয়ে পড়েন। একটি সামরিক সরকারের বন্দুকের নলের মুখেও অসাধারণ কৌশল, বক্তেব্যের শব্দের ব্যবহার, নান্দনিকভাবে যুদ্ধের দিকনির্দেশনা ও স্বাধীনতার ঘোষণা; একমাত্র জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই দেখিয়েছেন যা যুগ-যুগান্তর ধরে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মকে সংকট সংগ্রাম থেকে উত্তরণের পথনির্দেশক হয়ে বিশ্বের সকল অধিকার বঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়াতে অনুপ্রাণিত করবে।

লেখক : কলামিস্ট, সভাপতি, (বোয়াফ)