যে গল্প আলোয় আসেনি

124

আলোয় না আসা এক বিজয়ের গল্প। সত্যগল্প।
দিনটি কুমিল্লা জেলার কোনো অজগাঁয়ের এক বীরগর্ভা জননীর বুকছেড়া ধনের জীবন দিয়ে ইতিহাসগড়ার দিন। স্বাধীনতার স্বপ্নআঁকা বিভোর চোখের এক তরুণের রক্তে রাঙানো সূর্যোদয়ের দিন।
‘রেমা-কালেঙ্গা রিজার্ভ ফরেস্ট’। দেশের অন্যতম এক বৃহৎ গহীন বনাঞ্চল।
হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলার পুর্বদিকে সীমান্তবর্তী, বর্তমানবিজিবি ক্যাম্প সংলগ্ন সড়কের পার্শ্ববর্তী এক টিলা। বনবিভাগের বিট অফিসের কাছেই।
মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাঞ্চলীয় ৩ নম্বর সেক্টরের আওতাধীন আশ্রমবাড়ি-বাঘাইবাড়ি সাব-সেক্টর এলাকার ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ইতিহাসে এক স্মরণীয় দিন। একই সাথে এইদিনের সাথে জড়িয়ে রয়েছে বাংলাদেশের বীরমুক্তিযোদ্ধা ও জাতির শ্রেষ্ঠ সাহসীসন্তান, একজন বীরউত্তম শহীদ আবদুল মান্নানের বীরত্বকাহিনী; দেশের জন্য, লাল-সবুজের পতাকার জন্য জীবন উৎসর্গের কাহিনী।
দেশের অন্যতম বৃহৎ এই জঙ্গল মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের ভেতরে হানাদারদের ওপর হামলা চালাতে মুক্তিযোদ্ধারা প্রবেশদ্বার হিসেবে, অ্যামবুশ পাতাতে ও আত্মগোপনের নিরাপদ স্থান হিসেবে ব্যবহার করতেন। এপথে এসে মুক্তিযোদ্ধারা বহু সফল অপারেশন সম্পন্ন করেছেন। আলোচ্য অপারেশনটিও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন।
এই অ্যামবুশের মূল পরিকল্পনাকারী বাঘাইবাড়ি সাব-সেক্টরের কমান্ডার ক্যাপ্টেন (মেজর জেনারেল ও বীরউত্তম) আজিজুর রহমান। তার দলে ছিলেন কুমিল্লা জেলার এক অসীম সাহসী ও অদম্য স্পৃহার পুলিশ থেকে আগত সৈনিক নায়েক আবদুল মান্নান। যার সারাক্ষু নেশাই ছিল কোনো পাকিস্তানী অফিসারের মুন্ডু কর্তন। ঘটনার দুতিনদিন আগে নায়েক মান্নান সহ কয়েকজন রেকি করার সময় একদল পাকিস্তানি সৈন্যের গতিবিধি লক্ষ্য করেন। ফিরে গিয়ে কমান্ডারের কাছে বিস্তারিত রিপোর্ট করেন এবং একটি অ্যামবুশ পরিচালনার দাবী করেন। জানা যায় কিছুদিন ধরেই পাকিস্তানি সেনারা বিনাবাঁধায় কালেঙ্গাতে টহল দিচ্ছে এবং অত্যন্ত সাহসিকতায় মুক্তিযোদ্ধাদের গোপনঘাঁটির অনুসন্ধান করছে। মুক্তিযোদ্ধাদের পুতে রাখা মাইনবিস্ফোরণে একটি গরু মারা যাওয়ার পরও তারা আনাগোনা বন্ধ করেনি। কমান্ডার আজিজ স্বয়ং রেকি করে ও গোয়েন্দা খবর নিয়ে ঐদিন হানাদারদের আসার নিশ্চিত সংবাদে অ্যামবুশের পরিকল্পনা নেন। সম্ভাব্য অপারেশনের জন্য বাছাইকৃত ২০ জনের একটি শক্তিশালী টিম গঠন করে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রে ও গোলাবারুদে সজ্জিত করে তিনটি সেকশনে ভাগ করে পাঠানো হয়। ব্রিফিং শেষে আবদুল মান্নানের নেতৃত্বে দলটি সীমান্ত অতিক্রম করে গভীর জঙ্গলে পায়ে হেঁটে আনুমানিক ভোর ৫ টায় পৌঁছে যায় কালেঙ্গা বিট অফিসের সামনে। পূর্ব পরিকল্পনা মত তিনরাস্তার মোড়ে জঙ্গলের গাছপালায় আচ্ছাদনযোগ্য স্থানে অ্যামবুশ পাতানো হয়। কাভারিং ফায়ারের জন্য একটি মুক্তিফৌজ দল ও একটি শক্তিশালী ভারতীয় সেনাবাহিনীর দল প্রস্তুত থাকে।
২৪ সেপ্টেম্বর তারিখ দুপুর ১ টার দিকে রশিদপুর রাস্তারদিক থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বড় একটি দল অ্যামবুশস্থলের দিকে আসতে থাকে। অনেক দূর থেকে দূরবীন দিয়ে দেখে দেখে সাবধানে আসছে। তাদের সামনে দিয়েছিল কিছুনিরীহ চা শ্রমিক কে এবং মধ্যের সারিতে একদল রাজাকার বাহিনী। চাশ্রমিক ও রাজাকাররা যখন মুক্তিযোদ্ধাদের ফাদঁ এলাকার মধ্যে চলে আসে, তখন মুক্তিযোদ্ধাগন চুপ করেথেকে অপেক্ষায় থাকেন শুধু পাকিস্তানীসেনাদের জন্য। পাকসেনাদের ছোট একটা দলও অ্যামবুশ অতিক্রম করে। পাকিস্তানী সেনাদের বড় একদল যখন মুক্তিযোদ্ধাদের ফাঁদের ভেতর ঢুকে পড়ে, তখন একযোগে গর্জেওঠে তাঁদের সব অস্ত্র, চারদিকথেকে তাঁরা পাকিস্তানী সেনাদের ওপর অবিরাম গোলাগুলি শুরু করলো। পাকিস্তানি সেনারা চকিত আক্রমণে হতচকিত হয়ে পজিশন নেয়ার আগেই মধ্যবর্তী দলটি প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। পাকিস্তানী সেনাদের অগ্রবর্তী ও কাভারিং দল আক্রমণ জোরদার করেও তেমন কিছু করতে পারলোনা। মুক্তিযোদ্ধাদের সফল অ্যামবুশে পড়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে অসংখ্য পাকিস্তানিসেনা নিহত হয়েছে। ফাঁদের ভেতরে পড়ে পাকিস্তানি সেনা যারা বেঁচে গেছে, তারাবেশির ভাগ আহত। কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হয়নি। তারা ছোটাছুটি করছে। ফাঁদেরবাইরে থাকা পাকিস্তানি সেনারা পজিশননিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের লক্ষ্য করে গুলিকরছে। তীব্র গোলাগুলিতে গোটা এলাকা প্রকম্পিত। মুক্তিযোদ্ধারা বেশ নিরাপদ অবস্থানে থেকে গুলি করছেন।পাকিস্তানিদের গুলি তাঁদের ক্ষতি করতেপারছে না। মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মান্নানের গুলিতেই নিহত হয় বেশ কয়েকজন পাকিস্তানিসেনা। এ সাফল্যে তিনি আনন্দে আত্মহারা। এমন সময় দেখলেন তাঁর অবস্থানের সামনে বহুসংখ্যক পাকিস্তানিসেনা ও কর্মকর্তার লাশ পড়ে আছে। এক অফিসারের লাশ দেখে আনন্দের আতিশয্যে আবদুল মান্নান ট্রেঞ্চ থেকে লাফ দিয়ে উঠে গোলাগুলির মধ্যেই ‘জয় বাংলা’ স্লোগানদিয়ে তিনি এগিয়ে যান সেদিকে, সম্ভবত অফিসারের মুন্ডপাত করার উদ্দেশ্যে। কিন্তু তাঁর দূর্ভাগ্য যে, তখনই কাভারিং দলের ছূড়া গুলিতে বিদ্ধ হয়ে আবদুল মান্নান নিজেই ‘জয়বাংলা’ ধ্বনিতে বনের বাতাসে তরঙ্গ তুলে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। বেপরোয়াভাবে নিজের নিরাপদ অবস্থান থেকে উঠে পাকিস্তানি সেনার কাছে যাওয়ার সময় মেশিনগানের একঝাঁক গুলি এসে লাগে তাঁর বুক ও মাথায়। ঝাঁজরা হয়ে যায় তাঁর বুক। সঙ্গে সঙ্গে শহীদ হন এই বীরযোদ্ধা। কেউ কেউ বলেন, তিনি ছুটাছুটি করা এক পাক অফিসারকে জীবিত ধরতে চেয়েছিলেন। জীবিত ধরা অথবা লাশের মুন্ডপাত, যে কারণেই হোক, মান্নানের চোখে ছিল দেশমাতৃকার স্বাধীন সার্বভৌম লাল-সবুজের পতাকার স্বপ্ন। এ ঘটনায় মুক্তিযোদ্ধাদের হাতেপাকিস্তানি সেনাবাহিনীর এক অফিসারসহ মোট ৬১ জন নিহত ও অনেক আহত হয়। পাকিস্তানি কাভারিং দলের প্রচন্ড আক্রমণের মুখে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। হানাদার সেনারা নিজেদের দলের লাশ গাড়িবোঝাই করে এবং নায়েক মান্নানের লাশের একটি হাত ও একটি পা কেটে লাশের নীচে মাইন পুতে চলে যায়। পরদিন স্থানীয়রা লাশ উঠালেও মাইন বিষ্ফোরিত হয়নি। বিট অফিসের কাছেই তাঁকে সমাহিত করা হয়।
শহীদ আবদুল মান্নানের বাড়ি কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার পশ্চিম ডেকরাগ্রামে। তিনি অবিবাহিত ছিলেন। দুইভাই ও তিন বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। তাঁর বাবার নাম আবদুল জব্বার খন্দকার। মা আসকিরের নেছা।শহীদ আবদুল মান্নানের ছবি পাওয়াযায়নি। আব্দুল মন্নানের জন্ম- ১জানুয়ারি, ১৯৪০ ।
আবদুল মান্নান পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে চাকরি করতেন। কর্মরত ছিলেন দ্বিতীয় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টে। তখন তাঁর পদবি ছিল নায়েক। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনিতাঁর ইউনিটের সঙ্গে প্রতিরোধযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। পরে ৩ নম্বর সেক্টরের আশ্রমবাড়ি/বাঘাইবাড়ি সাব-সেক্টরএলাকায় যুদ্ধ করেন।
রেমা-কালেঙ্গা বনেরভেতরে বিজিবি ক্যাম্প থেকে কাছেই মুক্তিযুদ্ধে শহীদ নায়েক আব্দুল মান্নান বীরউত্তমের সমাধিসৌধ।তার কবরের পাশের বিশাল সেগুনগাছটির শরীরে এখনো দেখা মেলে হানাদারদের সেদিনের গুলির চিহ্ন।বর্তমানে সমাধি সৌধ এলাকার নতুন নামকরন করা হয়েছে ‘মান্নান নগর’।
মুক্তিযুদ্ধে অসীম সাহসও বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য আবদুল মান্নানকে মরণোত্তর বীরউত্তম খেতাবেভূষিত করা হয়েছে। তাঁর গেজেট নম্বর ৪৪।
রাষ্ট্রীয় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মর্যাদার খেতাবপ্রাপ্ত বীরযোদ্ধা আব্দুল মান্নান বীর উত্তম এর সমাধী দেশের এককোনে গহীন জঙ্গলে অনাদরে পরে আছে। দূর্ভাগ্যজনক ভাবে এই বীরসন্তানের বীরত্বকাহিনী খুব আলোচিত হয়নি। সে-ই ২৪ সেপ্টেম্বর, যেদিন এই বীর সন্তান দেশের জন্য বুকেররক্ত জমিনে ঢেলে দিয়েছিলেন। এই দিনেও আর কেউ তাঁকে স্মরণ করেনা। সত্যই তা অনুতাপের। আমাদের উচিত তাঁকে শ্রদ্ধায় স্মরণ করা, নতুন প্রজন্মের কাছে দেশমাতৃকার জন্য তাঁর জীবন উৎসর্গের কাহিনি তুলেধরা। এ প্রজন্মের কাছে জানানো দরকার যে, এই বীরের চোখে স্বপ্ন ছিল ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য এক টুকরো অন্যের আধিপত্যহীন ভূখন্ড রেখে যাওয়ার। স্বপ্ন ছিল আমাদের অন্নবস্ত্র কেড়ে নিয়ে মোটাতাজা হওয়া বর্বর হানাদারদের প্রতি চরম প্রতিশোধের। মা আর মাটির অধিকারে কারো অন্যায় হস্তক্ষেপ কখনো মেনে নেয়া যায়না, তা তিনি জীবন দিয়ে শিখিয়ে গেছেন।