যে কারণে এবার মিলছে বড় সাইজের ইলিশ

116

সরকারের কঠোর নজরদারি, তদারকি ও বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে এবছর দেশের সাগর ও নদনদীতে বড় সাইজের ইলিশের দেখা মিলেছে। রাজধানীর বাজারগুলোয় যেকোনও সময় চাইলেই এক বা দেড়কেজি ওজনের ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে। দেশের বাজারগুলোয় দু’কেজি সাইজের ইলিশও তেমন দুষ্প্রাপ্য নয়। অতীতে এমনটা সচরাচর দেখা যায়নি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দেশের নদনদীতে পানির উচ্চতা বেড়েছে, তাই সাগর থেকে প্রচুর ইলিশ নদীতে আসতে শুরু করেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ইলিশের মৌসুমে কিছু পরিবর্তন হওয়ায় এবার নদীতে ইলিশ আসতে কিছুটা দেরি হয়েছে। পুরো সেপ্টেম্বর জুড়েই নদীতে বড় সাইজের ইলিশ আসা অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়েছেন জেলেরা।
বছরে তিনদফায় ৩২৮ দিন নদীতে ও সাগরে ইলিশ মাছ ধরার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি করে সরকার। এবছর ইলিশ মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করায় ইলিশের সাইজ বড় হওয়ার সুযোগ পেয়েছে বলে জানান সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। খবর বাংলা ট্রিবিউনের
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সূত্রে জানা গেছে, প্রথম দফায় ডিম ছাড়ার জন্য ২২ অথবা ২৩ দিন ইলিশ মাছ ধরার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি করে মৎস্য মন্ত্রণালয়। দ্বিতীয় দফায় ইলিশের বাচ্চা অর্থাৎ ছোট ইলিশ যা জাটকা (২৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত দৈর্ঘ্যের ইলিশ) নামে পরিচিত, সেই জাটকা ইলিশকে বড় হওয়ার সুযোগ দিতে বছরের ১ নভেম্বর থেকে পরবর্তী বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত এই ৮ মাস বা ২৪০ দিন জাটকা ধরা নিষিদ্ধ করা হয়। বছরের তৃতীয় দফায় সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদের উন্নয়নে প্রতিবছর ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত এই ৬৫ দিন বঙ্গোপসাগরে বন্ধ থাকে সব ধরনের মাছ ধরা। এসময় ইলিশের ট্রলারও সাগরে যাওয়ার ক্ষেত্রে নিষেধজ্ঞা থাকে। এর বাইরেও ইলিশের প্রজনন মৌসুমের কারণে দেশের ছয়টি অভয়াশ্রমে ১ মার্চ থেকে ৩০ এপ্রিল মাছ ধরার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।
এই নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়নে ইলিশের অভয়াশ্রমসহ নদীগুলোয় জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়। সাগরে টহল দেয় কোস্টগার্ড। এই সময় সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে খাদ্য সহায়তা দেওয়া হয় তালিকাভুক্ত জেলেদের। গত তিনবছর মা-ইলিশ সংরক্ষণের সময় সরকারের পক্ষ থেকে ভিজিএফ সহায়তা বাবদ ৩ লাখ ৯৫ হাজার ৭০৯টি জেলে পরিবারকে ২০ কেজি হারে মোট ৭ হাজার ৯১৪ মেট্রিক টন চাল দেওয়া হয়েছে। চলতি বছরের ‘জাটকা সংরক্ষণ সপ্তাহ-২০১৯’ পালনের সময় সরকার ভিজিএফ খাদ্য সহায়তার পরিমাণ বাড়িয়ে ২ লাখ ৪৮ হাজার ৬৭৪টি জেলে পরিবারের জন্য ৪০ কেজি হারে মোট ৩৯ হাজার ৭৮৮ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দিয়েছে। এসময়ে জাটকার সম্প্রসারিত নদী তীরবর্তী ১৩টি জেলার ৫১ উপজেলায় মোট ৪৭ হাজার ৪৮০ প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়।
এছাড়াও সরকার ইলিশের জন্য মোট ৬টি অভয়াশ্রম ঘোষণা করেছে। সেগুলো হচ্ছে- ভোলার চর ইলিশার মদনপুর থেকে ভোলার চরপিয়াল পর্যন্ত মেঘনা নদীর ৯০ কিলোমিটার, ভোলার ভেদুরিয়া থেকে চররুস্তম পর্যন্ত তেঁতুলিয়া নদীর ১০০ কিলোমিটার, পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় আন্ধারমানিক নদীর ৪০ কিলোমিটার, চাঁদপুরের ষাটনল থেকে চর আলেকজান্ডার পর্যন্ত মেঘনার ১০০ কিলোমিটার, শরীয়তপুরের নড়িয়া থেকে ভেদরগঞ্জ পর্যন্ত পদ্মার ২০ কিলোমিটার, বরিশাল সদরের কালাবদর নদীর হবিনগর পয়েন্ট থেকে মেহেন্দীগঞ্জের বামনীরচর পয়েন্ট পর্যন্ত ১৩ কিলোমিটার, মেহেন্দীগঞ্জের গজারিয়া নদীর হাটপয়েন্ট থেকে হিজলা লঞ্চঘাট পর্যন্ত ৩০ কিলোমিটার এবং হিজলার মেঘনার মৌলভীরহাট পয়েন্ট থেকে মেহেন্দীগঞ্জ সংলগ্ন মেঘনার দক্ষিণ-পশ্চিম জাঙ্গালিয়া পয়েন্ট পর্যন্ত ২৬ কিলোমিটার। এছাড়া আড়িয়াল খাঁ, নয়নভাংগুলী ও কীর্তনখোলা নদীর আংশিক অভয়াশ্রমটির অন্তর্ভুক্ত। বরিশালের আশপাশের ৮২ কিলোমিটার নদীপথকে নিয়ে নতুন অভয়াশ্রম ঘোষণা করেছে সরকার।
ইলিশ আশ্বিনের ভরা পূর্ণিমায় ডিম ছাড়ে। ইংরেজি মাস হিসেবে অক্টোবর হলেও বাংলা আশ্বিন মাসটাকেই গুরুত্ব দেওয়া হয়। এসময় ইলিশ ডিম ছাড়তে সাগর থেকে আসে নদীতে। এই আশ্বিনের পূর্ণিমার আগে ও পরের সঠিক সময় নির্ধারণ করা খুবই জটিল বিষয়। ভরা পূর্ণিমার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে তারিখের হেরফের হয় বলেও জানিয়েছে মন্ত্রণালয় সূত্র। আগে এই সময়টি ৭ দিন থাকলেও পরবর্তীতে তা ১৪ দিন এবং এবছর তা আরও বাড়িয়ে ২৩ দিন করা হতে পারে।
জানা গেছে, এবছর ইলিশের ডিম ছাড়ার জন্য ৯ অক্টোবর থেকে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত নদীতে ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ থাকবে।
জানতে চাইলে পিরোজপুরের জেলে ইদ্রিস আলী, বরগুনার জেলে সোবাহান হাওলাদার, ভোলার জেলে মোবারক হোসেন, পটুয়াখালীর জেলে আরমান সিকদার জানান- তারা ইলিশ সংরক্ষণে সরকারের সব উদ্যোগকেই স্বাগত জানিয়েছন। ডিসিদের মিটিংয়ে অংশ নিয়ে তার নির্দেশনা মেনেছেন। সরকারের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে অথবা সরকারের চোখ ফাঁকি দিয়ে কেউই নদীতে যায়নি। ফলে ইলিশ বড় হওয়ার সুযোগ পেয়েছে, যা এখন ধরা পড়ছে।
এ প্রসঙ্গে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী আশরাফ আলী খান খসরু বলেন, ইলিশ সংরক্ষণে সরকারের উদ্যোগ শতভাগ বাস্তবায়নে আমরা চেষ্টা করেছি। জেলা প্রশাসনের সহায়তায় বাংলাদেশ পুলিশ, কোস্টগার্ড, জনপ্রতিনিধি এবং জেলেরা সরকারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সরকারকে সহযোগিতা করেছে। এসব কারণেই মূলত এবছর ইলিশ বড় হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। আশা করছি আগামী বছরও ভালো সাইজের ইলিশ পাবো।