যেসব কারণে চ্যালেঞ্জে মেয়র নাছির

72

এক প্রবীণ নেতা গেলেন নেত্রীর দুয়ারে। সাথে নিয়ে গেলেন পুত্রকে। নিজপুত্রকে চট্টগ্রামের মেয়র পদে মনোনয়নের জন্য নিজের শেষ ইচ্ছার কথা জানান দলীয় প্রধানকে। কিন্তু নেত্রী সায় দিলেন না। সহাস্যেই এড়িয়ে যান। এরও কিছুদিন পরের কথা। চট্টগ্রামের আরো দুই এমপি তাদের দুই পুত্রকে নিয়ে আরেক এমপি’র সহায়তায় গেলেন নেত্রীর দুয়ারে, টার্গেট ক্যাসিনো কেলেঙ্কারিতে জড়িত এক এমপির পক্ষে মনভোলানো ও চট্টগ্রামের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের বিরুদ্ধাচরণ। কিন্তু না। বঙ্গবন্ধু কন্যা তাদের সুযোগই দিলেন না। পাল্টা এক এমপি ও তার পুত্রকে বললেন মানুষের সাথে ভালো ব্যবহার করতে।
চসিক নির্বাচনকে সামনে রেখে এমন অনেক ঘটনাই ঘটে চলেছে অন্তরালে। এসবে বোদ্ধা মহলে আলোচনার খোরাক থাকলেও মাঠের কর্মী ও সাধারণের কাছে এসবের কোনো বার্তা নেই। বরং অনেকেই বুঝে হোক না বুঝে হোক অন্যের চোরা ফাঁদে পা দিচ্ছেন । বঙ্গবন্ধু কন্যার এমন অনঢ় অবস্থানের বার্তা যখন চট্টগ্রামের রাজনীতি সচেতন নাগরিকদের মনে স্বস্তির শ্বাস তুলছে, তখন ভাবী ইস্যুতে মেয়র নাছিরকে বেকায়দায় ফেলতে শুরু হয়েছে নতুন ষড়যন্ত্র।


চট্টগ্রাম মহানগরীতে ব্যাপক গণমুখী নেতা এবিএম মহিউদ্দিন জমানার পর অনেকটা আওয়ামী লীগের ‘সবেধন নীলমণি’ আ জ ম নাছির উদ্দীন -একথা দলীয় ফোরামে কিছু অন্ধ বধির ছাড়া দলের বাইরেও অস্বীকার করার জো নেই। তবুও কেন চসিক নির্বাচন অত্যাসন্ন হতেই একের পর এক চ্যালেঞ্জে পড়ছেন মেয়র নাছির? এবার পর্যবেক্ষণের আলো ফেলা যাক দলটির চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন-এর কার্যক্রমের দিকে। তাঁর পদক্ষেপগুলো তাঁকে বিপদে ফেলছে নাতো ?
সিটি করপোরেশনকে সার্বজনীন করে তোলা, দল-মত নির্বিশেষে সবার সাথে সম্পর্কের উন্নয়ন, আলোকায়ন, পরিচ্ছন্নতা, সড়ক সংস্কার, সবুজায়ন নানা খাতেই শুরু থেকেই প্রত্যাশিত বরাদ্দ না পেলেও প্রাণান্তর চেষ্টা করেছেন মেয়র নাছির। মুক্তিযোদ্ধাদেরও সম্মান দিয়েছেন তিনি। এভাবে এক মেয়াদেই তাঁর সাফল্যের সীমানা বিস্তৃত। তাঁর সাফল্যে খোদ বিরোধীদল বিএনপিও যেন বিস্মিত !
বিএনপির মহানগর মহিলা দলের সভানেত্রী ও চসিক কাউন্সিলর মনোয়ারা বেগম মনির প্রকাশ্য গণমাধ্যমে ‘মেয়র নাছিরকেই যখন মেয়র পদে আবারো দেখতে চান’ বলে দেয়া বক্তব্য ভাইরাল হওয়ার পরেই খোদ আওয়ামী লীগের মহিলা সংগঠনের নেত্রী হাসিনা মহিউদ্দিনকে ঘিরে সৃষ্ট ইস্যুটি আসলে কতটুকু যৌক্তিক বা দলের জন্য ইতিবাচক, তাও বিবেচনার দাবি রাখে।
মেয়র হিসেবে শুরুতেই অন্তত পাঁচ হাজার কোটি টাকার বিলবোর্ড বাণিজ্যের লোভ উপেক্ষা করে চট্টগ্রাম শহরকে বিলবোর্ডের ঝুঁকিমুক্ত করেন মেয়র নাছির।
মহিউদ্দিন পতিœকে মঞ্চ থেকে নামিয়ে দেওয়ার ইস্যুতে মহানগর যুবলীগের আহŸায়ক মহিউদ্দিন বাচ্চু প্রতিবাদ করেছেন বলে একাধিক গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হওয়ায় তার সাথে বিলবোর্ড বাণিজ্যের ক্লেশের বিষয়টিও ভাবছেন অনেকেই।
স¤প্রতি ঢাকায় যুবনেতা সম্রাট ব্যাপক আলোচিত হলেও আরো অন্তত এক যুগ আগেই চট্টগ্রামে চসিকের একচেটিয়া বিলবোর্ড বাণিজ্যে আলোচিত হন এই যুবনেতা। মহিউদ্দিন জমানায় ব্যাপক প্রভাবশালী এই যুবনেতা পরবর্তীতে বিএনপি সমর্থিত মেয়র মনজুর আলমের কার্যালয়ে ঢুকে মেয়রকে ঘেরাও করে টেবিল চাপড়েও বিতর্কিত হন। এর ওপরে আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়র নাছির এসে বন্ধ করে দেন সেই বিলবোর্ড বাণিজ্য, যা নগরবাসীর খুব প্রশংসা পায়। এই কারণেই হাসিনা মহিউদ্দিনকে মঞ্চ থেকে নামিয়ে দেওয়া নিয়ে যে বিতর্ক, তাতে মহিউদ্দিন বাচ্চুর অবস্থান প্রশ্নবিদ্ধ হতেই পারে রাজনীতি সচেতনদের মাঝে।
চট্টল রাজনীতিকে আমরা যারা পর্যবেক্ষণে রাখি, আমরা দেখেছি, আওয়ামী লীগের মহিউদ্দিন জমানায় সংগঠনের বর্ধিত সভা ও নিয়মিত সভাগুলো প্রায়ই তার চশমা হিলের বাসভবনেই হত। দলের কার্যালয়ের থেকে চশমা হিলের বাড়িটিতেই দল কেন্দ্রীভূতকরণের তাবেদার ছিলেন একটি পক্ষ। মেয়র নাছির সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পরে তারই কমিটির সভাপতি মহিউদ্দিন চৌধুরীর সেই বাড়ি থেকে দলের সভাগুলোকে দলীয় কার্যালয়, রীমা কনভেনশন সেন্টার, ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সেন্টারসহ মিলন কেন্দ্রগুলোতে নিয়ে যান। এটিও আ জ ম নাছির উদ্দীনের সাফল্য।
এদিকে চট্টগ্রাম বন্দরকেন্দ্রিক মহলবিশেষের মনোপলি ব্যবসার সিন্ডিকেটটি মেয়র নাছিরের অন্তত তিন দশক আগেকার ব্যবসায়িক অবস্থানের কারণেই সুবিধা করতে পারছিলেন না। বিতর্কিত হুইপের মদদপুষ্ট সেই গ্রæপটির বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন সাবেক মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরীও। আবার সেই গ্রæপটি মেয়র নাছিরের উপর ক্ষিপ্ত হয়ে মেয়র পদে বিকল্প আনতে মরিয়া হয়ে ওঠেন। তারাই পরিকল্পিতভাবে আলোচনায় আনতে চান একাধিক ব্যবসায়ী ও চেম্বারকেন্দ্রিক শিল্পপতি একাধিক নেতাকেও।
এক পর্যায়ে তারা যখন হালে পানি পাচ্ছিলেন না, তখন বিতর্কিত এক ‘জাতীয় যুবনেতা’কেই মনোনয়ন দেওয়ার পরিস্থিতি তৈরির চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু তাদের কপাল মন্দ ! নেত্রীর সিদ্ধান্তের বাইরে হুংকার দিয়ে পদচ্যুত বহুল নিন্দিত, কেসিনো কেলেঙ্কারিতে বিতর্কিত সেই যুবনেতার স্বপ্নও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জিরো টলারেন্সের কারণে ভেঙে খানখান হয়ে যায়।
চট্টগ্রামের মেয়র পদে মনোনয়ন দেয়ার জন্য আদাজল খেয়ে নামা পক্ষের সাথে ক্যাসিনোর কালো টাকার মালিক ও চট্টগ্রাম বন্দর কেন্দ্রিক মাফিয়া সিন্ডিকেটে জড়িত দুই এমপি’র মিশন ব্যর্থ হয় বঙ্গবন্ধু কন্যার অনঢ় অবস্থানের কারণে ।
পদচ্যুত সেই যুবনেতার চট্টগ্রামের ক্যাশিয়ারসহ সুবিধাভোগীরায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অনৈক্য তৈরি করছে না তো ! – এমন প্রশ্নে মন উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, পেশাজীবী-নাগরিক সংগঠক