যুবলীগ নেতা সম্রাট ও আরমান গ্রেপ্তার

81

ক্যাসিনো চালানোর তথ্য প্রকাশের পর আত্মগোপনে থাকা ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট ও সহ সভাপতি এনামুল হক আরমানকে অবশেষে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব। শনিবার গভীর রাতে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম থানার আলকরা ইউনিয়নের কুঞ্জশ্রীপুর গ্রাম থেকে সম্রাট ও আরমানকে গ্রেপ্তার করা হয়।
গত ১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকার মতিঝিলের ক্লাবপাড়ায় র‌্যাবের অভিযানে অবৈধ ক্যাসিনো চলার বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার পর থেকে আলোচনায় ছিল যুবলীগ নেতা সম্রাটের নাম।
সেদিন যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূইয়া গ্রেপ্তার হওয়ার পর সদলবলে কাকরাইলে নিজের কার্যালয়ে অবস্থান নিয়ে রাতভর সেখানে ছিলেন সম্রাট। কিন্তু এরপর তিনি নিরুদ্দেশ হন।
র‌্যাবের অভিযানের সময় মুক্তিযোদ্ধা ক্রীড়া চক্রের ভেতরে সম্রাটের বিশাল ছবি দেখা যায়। ওই ক্লাবের ক্যাসিনো তিনিই চালাতেন এবং মতিঝিল ক্লাবপাড়ায় অন্য ক্যাসিনোগুলো থেকেও প্রতিদিন নির্দিষ্ট হারে চাঁদা তার কাছে যেত বলে গণমাধ্যমে খবর আসে।
সম্রাটের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত যুবলীগ নেতা আরমানও দীর্ঘদিন ধরে ক্যাসিনোর কারবারে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। সম্প্রতি তিনি ঢাকাই সিনেমাতেও টাকা খাটাচ্ছিলেন।
আরমানের প্রোডাকশন হাউস ‘দেশ বাংলা মাল্টিমিডিয়া’র ব্যানারে প্রথম সিনেমাটি মুক্তি পায় গত কোরবানির ঈদে। ‘মনের মতো মানুষ পাইলাম না’ নামের ওই সিনেমায় অভিনয় করেছেন শাকিব খান ও বুবলী।
চৌদ্দগ্রাম থানার আলকরা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গোলাম ফারুক হেলাল জানান, কুঞ্জশ্রীপুর গ্রামের যে বাড়ি থেকে সম্রাট ও আরমানকে ধরা হয়েছে, সেটি স্টার লাইন পরিবহনের মালিক আলাউদ্দীনের ভগ্নিপতি মনিরের বাড়ি। শনিবার সন্ধ্যা থেকেই বাড়িটি ঘিরে রেখেছিল র‌্যাব। তবে মনির কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত কিনা, সে বিষয়ে নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারেননি ইউপি চেয়ারম্যান হেলাল।
সহযোগী সংগঠন যুবলীগের নেতাদের চাঁদাবাজি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার অসন্তোষ প্রকাশ পাওয়ার পর জুয়ার আখড়া বন্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এই অভিযান শুরু হয়।
মতিঝিলের ইয়ংমেন্স ফকিরেরপুল ক্লাবে ক্যাসিনো চালানোর ঘটনায় ১৮ সেপ্টেম্বর গ্রেপ্তার করা হয় যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে। পরদিন কলাবাগান ক্লাব থেকে গ্রেপ্তার হন কৃষক লীগের নেতা শফিকুল আলম ফিরোজকে। দুদিন পর নিকেতন থেকে গ্রেপ্তার করা হয় ঠিকাদার জি এম শামীমকে, তিনিও যুবলীগ নেতা হিসেবে পরিচয় দিতেন।
‘অপকর্মকারীদের’ বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর মনোভাব অত্যন্ত কঠোর- এমন বার্তা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের কাছ থেকে আসার পর আত্মগোপনে যান সম্রাটসহ যুবলীগের বেশ কয়েকজন নেতা।
তাদের মধ্যে যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির দপ্তর সম্পাদক কাজী আনিসুর রহমান, মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মিজানুর রহমান বকুল এবং ঢাকা দক্ষিণ যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও মতিঝিলের ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোমিনুল হক সাঈদের নামও এসেছে।
সম্রাট নিরুদ্দেশ হওয়ার পর থেকে প্রায় প্রতিদিনই তাকে নিয়ে বিভিন্ন রকম খবর আসছিল সংবাদ মাধ্যমে। কিন্তু যুবলীগের অফিস কিংবা বাসা- কোথাও তাকে পাওয়া যাচ্ছিল না। এরই মধ্যে সম্রাটের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়, তার এবং তার পরিবারের সদস্যদের ব্যাংক হিসাব তলব করে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইনানশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট-বিএফআইইউ। ক্ষমতাসীন দলের যুব সংগঠনের এই নেতাকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী আটক করেছে বলে এর আগেও বিভিন্ন সমেয়ে শোনা গেছে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ তা স্বীকার করেনি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলে আসছিলেন, সম্রাট হোক আর যেই হোক, অপরাধ করলে তাকে আইনের আওতায় আনা হবে। খবর বিডিনিউজের
সম্রাটের অফিসে অস্ত্র, ইয়াবা, ক্যাঙ্গারুর চামড়া :
ক্যাসিনোকান্ডে গ্রেপ্তার যুবলীগ নেতা ইসমাইল চৌধুরী সম্রাটের কাকরাইলের কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ বিদেশি মদ, ইয়াবা, একটি পিস্তল ও দুটি ক্যাঙ্গারুর চামড়া উদ্ধার করার কথা জানিয়েছে র‌্যাব। স¤্রাটকে সঙ্গে নিয়েই একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে রোববার দুপুর থেকে প্রায় পাঁচ ঘণ্টা র‌্যাবের এই অভিযান চলে।
গ্রেপ্তারের পর তাদের ঢাকায় র‌্যাব সদরদপ্তরে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। পরে বেলা দেড়টার দিকে স¤্রাটকে সঙ্গে নিয়ে কাকরাইলের ভূঁইয়া ট্রেড সেন্টারে তার অফিসে ঢোকেন র‌্যাব সদস্যরা।
একই সময়ে শান্তিনগরে শেলটেক টাওয়ারের পঞ্চম তলায় এবং মহখালী ডিওএইচএসের ২৯ নম্বর সড়কে স¤্রাটের দুটি বাসায় এবং মিরপুর দুই নম্বর সেকশনে অভিযান শুরু করে র‌্যাব।
কাকরাইলের অফিসে অভিযান শেষে ২টি ক্যাঙ্গারুর চামড়া, এক হাজারের বেশি ইয়াবা, বেশ কিছু মদের বোতল এবং একটি পিস্তল উদ্ধার করা হয়।
এছাড়া সেখানে কিছু বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম পাওয়া গেছে জানিয়ে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল সারওয়ার-বিন-কাশেম জানান, সেগুলো নির্যাতন করার কাজে ব্যবহার করা হত বরে তাদের ধারণা।
মহাখালীতে অভিযান শেষে র‌্যাব-২ অধিনায়ক আশিক বিল্লাহ বলেন, সম্রাটের দ্বিতীয় স্ত্রী শারমিন চৌধুরী ছাড়াও শারমিনের ভাই, ভাইয়ের স্ত্রী ওই বাসায় থাকেন। তল্লাশি চালিয়ে অবৈধ কিছু সেখানে পাওয়া যায়নি।
শারমিন বলেছেন, সম্রাট গত কয়েক বছর ধরে এই বাসায় যান না। তবে প্রতিমাসে দেড় লাখ টাকা করে খরচ দিয়ে আসছিলেন।
বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে শন্তিনগরের অভিযান শেষ করে সেখানে ‘কিছু টাকা আর ক্রেডিট কার্ড’ পাওয়ার কথা জানিয়ে র‌্যাব- ৩ অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল শফিউল্লাহ বুলবুল বলেন, এর বাইরে সিগনিফিকেন্ট কিছু আমরা পাইনি।
কুমিল্লায় আত্মীয়র বাসায় সম্রাট ‘লুকিয়ে ছিলেন ৩ দিন ধরে’ :
ক্যাসিনোকান্ডে আলোচিত দুই যুবলীগ নেতা ইসমাইল চৌধুরী স¤্রাট ও এনামুল হক আরমানকে কুমিল্লায় যে বাসা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, সেখানে তারা ছিলেন গত তিন দিন ধরে।
তাদের গ্রেপ্তার করতে ‘অনেক কষ্ট করতে’ হয়েছে মন্তব্য করে র‌্যাব মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ বলেছেন, আত্মগোপনে থাকার জন্য সম্রাট বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করেছিল। মূলত ক্যাসিনো ব্যবসায় জড়িত থাকার অভিযোগে আমরা তাদের গ্রেপ্তার করেছি।
কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম থানার আলকরা ইউনিয়নের কুঞ্জশ্রীপুর গ্রামের ওই বাড়ি থেকে শনিবার গভীর রাতে গ্রেপ্তার করা হয় ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি স¤্রাট ও সহ-সভাপতি আরমান।
ওই বাড়ির মালিক মনির হোসেন স্টার লাইন পরিবহনের একজন পরিচালক, তিনি সম্রাটের দূর সম্পর্কের খালাতো ভাই। সম্রাট আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন যুবলীগের নেতা হলেও মনির জামাত সমর্থক হিসেবে পরিচিত বলে আলকরা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গোলাম ফারুক হেলাল জানান।
তিনি বলেন, মনিরের স্ত্রীর ভাই হাজী আলাউদ্দিন স্টার লাইন পরিবহনের মালিক এবং ফেনী পৌরসভার মেয়র। আলাউদ্দিন এক সময় জাতীয় পার্টি করলেও এখন আওয়ামী লীগের সঙ্গে আছেন।
ওই বাসায় মনির বা তার পরিবারের কেউ থাকত না। সেখানে যে সম্রাট বা আরমান আছে, এটাও আমরা জানতাম না। তবে ফেনী পৌরসভার মেয়র আলাউদ্দিনকে গত ২/৩দিন ঘনঘন ওই বাড়িতে যাতায়াত করতে দেখা গেছে।
আলাউদ্দিন বলেছেন, মনিরের বাসায় সম্রাটের অবস্থান করার খবর তারও ‘আগে জানা ছিল না’।
শনিবার র‌্যাবের অভিযানের খবর জানার পর রাত ১১টার দিকে মনিরকে ফোন করেছিলাম। সম্রাট কেন তার বাসায়, তা জানতে চেয়েছিলাম। মনির আমাকে বলেছে, তিন দিন আগে তারা (সম্রাট ও আরমান) ওই বাসায় গেছে। রোববার সকালেই তারা ঢাকা ফিরে যাবে বলে জানিয়ে রেখেছিল। তার আগেই র‌্যাব তাদের গ্রেপ্তার করে।
এক প্রশ্নের জবাবে আলাউদ্দিন বলেন, ওই বাসা অধিকাংশ সময় ফাঁকাই থাকে। মনিরের পরিবার থাকে ঢাকায়।
সম্রাট বা আরমানের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই দাবি করে আলাউদ্দীন বলেন, গত বৃহস্পতিবার আমি বিদেশ থেকে দেশে ফিরেছি। আমি তাদের বিষয়ে কিছু জানি না।
গত ১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকার মতিঝিলের ক্লাবপাড়ায় র‌্যাবের অভিযানে অবৈধ ক্যাসিনো চলার বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার পর থেকেই আলোচনায় ছিলেন সম্রাট ও আরমান।
তাদের গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদ করেন র‌্যাব কর্মকর্তারা। পরে তাদের নিয়ে আসা হয় ঢাকায়। কাকরাইলে সম্রাটের অফিস, শান্তিনগর ও মহাখালীতে তার দুই বাসায় এবং মিরপুর ২ নম্বরে আরমানে বাসায় রোববার দুপুর থেকে শুরু হয় র‌্যাবের অভিযান।
র‌্যাব মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ দুপুরে নিজের কার্যালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ক্যাসিনোতে অভিযান শুরুর দুই দিনের মধ্যে সম্রাট আত্মগোপনে চলে যায়। ক্যাসিনোর সাথে আরও যারা জড়িত, তাদের খুঁজে বের করতে র‌্যাব কাজ করছে। যেই এর সাথে জড়িত হোক, তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।
সম্রাট ও আরমানকে ভ্রাম্যমাণ আদালতে ৬ মাস করে সাজা :
কুমিল্লা থেকে গ্রেপ্তার ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী স¤্রাট ও সহ-সভাপতি এনামুল হক আরমানকে ছয় মাস করে কারাদন্ড দিয়েছে ভ্রাম্যমাণ আদালত।
এর মধ্যে সম্রাটের সাজা হয়েছে বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ) আইনে, তার কাকরাইলের অফিসে দুটি ক্যাঙ্গারুর চামড়া পাওয়ার কারণে।
আর কুমিল্লায় গ্রেপ্তারের সময় আরমান ‘মদ্যপ’ থাকায় তাকে সেখানেই ভ্যাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে সাজা দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়েছে বলে র‌্যাবের নির্বাহী হাকিম সারওয়ার আলম জানিয়েছেন।