যুববিদ্রোহের মহানায়ক মাস্টারদা সূর্যসেন ও বীর তারকেশ্বর দস্তিদারের ফাঁসি

212

ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের মহানায়ক মাস্টারদা সূর্য সেন ভারতবর্ষের স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছিলেন। সে-ইতিহাসের পড়তে পড়তে আমরা দেখতে পাই-তাঁরই নেতৃত্বে বিপ্লবীরা ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন করে চট্টগ্রামের ব্রিটিশ শক্তিকে কাবু করে ফেলে। শক্তিধর ব্রিটিশ কর্মকর্তারা সেদিন কর্ণফুলীতে ভাসমান জাহাজে অবস্থান নিয়ে প্রাণরক্ষা করেছিলেন। চট্টগ্রামের আকাশে ১৮ এপ্রিল মধ্যরাত থেকে ২২ এপ্রিল, চারদিন চট্টগ্রামের আকাশে উড়েছিল স্বাধীনতার পতাকা। অস্ত্রাগার আক্রমণ শেষে বিপ্লবীরা অবস্থান নেয় জালালাবাদ পাহাড়ে। অতঃপর চট্টগ্রামের ব্রিটিশ সৈনিকরা পুনরায় সংঘটিত হয়ে ২২ এপ্রিল জালালাবাদ আক্রমণ করলে উভয় পক্ষে ভয়াবহ যুদ্ধ সংগঠিত হয়। এ-যুদ্ধে ১২ জন বিপ্লবী শহীদ হয়। পরবর্তীতে মাস্টারদা সূর্য সেন বিপ্লবীর রক্তের প্রতিশোধ গ্রহণ ও সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ ফৌজের সঙ্গে গেরিলা কায়দায় দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু ১৬ ডিসেম্বর ১৯৩৩ সালে গৈরলা যুদ্ধে মাস্টারদা বন্দী হন। মাস্টারদার গ্রেপ্তারের পর চট্টগ্রাম বিপ্লবী দলের নেতৃত্বভার পড়ে তারকেশ্বর দস্তিদারের উপর। মাস্টারদার পর ইন্ডিয়ান রিপাবিøকান আর্মি (চট্টগ্রাম শাখার) দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন তারকেশ্বর দস্তিদার। জেলে মাস্টারদার সঙ্গে যোগাযোগ করে তাঁকে মুক্ত করে আনার প্রচেষ্টা করেছিলেন এবং বিপ্লবী দলের বোমা তৈরি বিশেষজ্ঞ হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। আনোয়ারা উপজেলার গহিরা আত্মগোপন কেন্দ্রে তাঁর লিখিত ‘ড. রমন’ ছদ্মনামে বিভিন্ন ধরনের বোমা তৈরির ফরমুলা সম্বলিত একটি খাতা পাওয়া গিয়েছিল যেটি বিচারের সময় ‘এক্সিবিট’ করা হয়েছিল। ১৮ মে, ১৯৩৩ গহিরা যুদ্ধে গ্রেপ্তারের পর মেজর কিম তারকেশ্বর দস্তিদারকে বুটজুতা পরিহিত পা দিয়ে চোখে লাথি মারলে তাঁর চোখের ভিতর থেকে ফিন্কি দিয়ে রক্ত বেরোতে থাকে।
মাস্টারদা ও তারকেশ্বর দস্তিদার চট্টগ্রাম কারাগারের বন্দী। যুব বিদ্রোহের কাজ যেমন চলছিল, তেমনই চলবে। বিপ্লব কোনদিনও থামতে জানে না। এগিয়ে চলাই তার সহজাত ধর্ম। ওদিকে বিচার শুরু হল সবার অগোচরে, জেলখানার অভ্যন্তরে। মাস্টারদা এবং তারকেশ্বর দস্তিদার দু’জনকেই দেওয়া হল প্রাণদন্ড। কল্পনা দত্তের যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর। ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ সর্বদা এই ভয় করত যে, বিপ্লবীরা হঠাৎ আক্রমণ করে হয়ত তাদের নেতা সূর্য সেনকে জেল থেকে ছিনিয়ে নেবে। তাই দিনরাত কড়া পাহারায় যেমন তাঁকে নির্জন কুঠুরীতে রাখা হত, তেমনি তাঁর ফাঁসির সঠিক তারিখও কঠিন গোপনীয়তায় রক্ষা করা হয়।
যতই বাইরের জগতের কাছে কর্তৃপক্ষ ফাঁসির খবর গোপন রাখুক, কিন্তু সেদিন চট্টগ্রাম জেলের মধ্যে এই খবর গোপন ছিল না। কারণ জেলে যখনই কোন ফাঁসির সিদ্ধান্ত করা হয়, তখন থেকে বেশ কয়েকদিন ঐ সম্পর্কে অনেকগুলো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়। যাদের ফাঁসি হবে, তাদের ওজন নিয়ে ঐ ওজনের নকল মানুষ বা ইটপাথরের বস্তা তৈরি করা হয়। নূতন শক্ত শণপাটের দড়ি প্রত্যেকবার ফাঁসির সময় কেনা হয়। ঐ দড়ি দিয়ে ওজন করা ইটপাথরের বস্তা টেস্ট কেইস হিসেবে জল্লাদ ঝুলায়। বারবার ঝুলিয়ে দড়ির শক্তি পরীক্ষা করা হয়। দড়িতে চর্বি, পাকাকলা ইত্যাদি মাখিয়ে তাকে মসৃণ করা হয়। ফাঁসির ৬/৭ দিন আগে থেকে এই আয়োজন চলার সময়ই জেলের মধ্যে খবর ছড়িয়ে যায় এবং মৃত্যুদÐপ্রাপ্ত বন্দীকে নিয়ে আসা হয় ফাঁসিকাষ্ঠের নিকটস্থ নির্জন কুঠুরীতে। জেলের অভ্যন্তরে বন্দীদের মাঝে জানা হয়ে গেল মাস্টারদা আর তারকেশ্বরের ফাঁসির খবর। তাদের কারো চোখে ঘুম নেই, কখন হঠাৎ চুরি করে তাদের প্রিয়তম নেতাকে শত্রæরা শেষ করে ফেলে। জেলের সাধারণ কয়েদী ও কারাবন্দীরা এবং জেলডাক্তারসহ অন্যান্য কর্মচারীরাও বিপ্লবী এই দুই নেতার প্রতি পরম শ্রদ্ধা পোষণ করতেন। তারা অনেকেই ফাঁসির নানা ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত, তাই কঠোর গোপনীয়তা সত্তে¡ও, তাদের কাছ থেকেই ফাঁসি কার্যকর করার সময় রাজবন্দীরা জানতে পারেন। জেলে রাজবন্দীরা ১১ জানুয়ারি (১৯৩৪) সন্ধ্যা থেকে নিজ নিজ বদ্ধ ঘরে চুপচাপ বসে আছে, কারো মুখে কোন কথা নেই— পরম বেদনায় ক্ষণটির জন্য গভীর ব্যথা বুকে নিয়ে সবাই অপেক্ষা করছে, খবর পাওয়া গেছে বিপ্লবী নেতা তারকেশ্বর দস্তিদারের সেদিন বেশ জ্বর। তার ফলে সামান্য একটুখানি আশাও জাগছে, কারণ ডাক্তার যদি সুস্থ বলে সুপারিশ না করে তাহলে সেদিন অন্ততঃ একজনের ফাঁসি স্থগিত থাকতে পারে। রাত প্রায় দশটায় ফাঁসির কুঠুরীর দিক থেকে শোনা গেল মাস্টারদার গলা :
“বন্ধুগণ, বিদায়, চিরবিদায়।
বিপ্লবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস আছে
বন্দে মাতরম – ইনকিলাব জিন্দাবাদ।”
গলা এক একবার থেমে যায়। বোঝা যায় রক্ষীরা বাধা দিচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে জেলখানার সব ওয়ার্ড থেকে প্রতিধ্বনি ওঠেÑ ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’, ‘স্বাধীন ভারত কি জয়’- ‘মাস্টারদা জিন্দাবাদ’, ‘ফুটুদা জিন্দাবাদ (তারকেশ্বর দস্তিদার)।’
জেলের মহিলা ওয়ার্ডে আলাদা করে রাখা হয় বিপ্লবী কল্পনা দত্তকে। সেখান থেকে সবল নারীকণ্ঠে আওয়াজ ভেসে এল, ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ, মাস্টারদা জিন্দাবাদ, তারকেশ্বর জিন্দাবাদ।’ এমন সময় জেলের বড় ফটক খুলে গেল। ইংরেজ পুলিশ কর্মচারী, বাঙালি গোয়েন্দা আর অস্ত্র ও বড় লাঠিধারী সিপাহির বড় একদল জেলের ভিতর প্রবেশ করে। তারা গিয়ে সম্পূর্ণ বে-আইনীভাবে যেসব ওয়ার্ডে রাজবন্দী ও রাজনৈতিক বন্দীরা ছিল, তার তালা খুলে তাদের উপর নির্মমভাবে লাঠি চালাতে শুরু করে। সেই নিষ্ঠুর লাঠি চালনার মধ্যেও এই দেশপ্রেমী বন্দীরা তাঁদের ধ্বনি দেওয়া বন্ধ করেন নি।
গভীর রাতে জেলগেটে এসে একখানা মোটর গাড়ি থামল। সেই গাড়ি থেকে নামল গোটা আট জন ইংরেজ অফিসার। তারা ঢুকল জেলের ভিতর। মাস্টারদা এবং তারকেশ্বর দস্তি-দার যে দুটি কক্ষে আবদ্ধ ছিলেন সে দুটি কক্ষ খুলে সকলে মিলে মৃত্যুপ্রতীক্ষারত দেশপ্রেমিক বিপ্লবী বীরদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারপর তাদের ওপর যে দৈহিক নির্যাতন চলে তা অবর্ণনীয়। তারা উভয়েই সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন এবং তাঁদের অচৈতন্য দেহ ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেয়া হয়, এইভাবে মধ্যরাতে মাস্টারদা ও তারকেশ্বর দস্তিদারকে হত্যা করে ঐ রক্তপিপাসু ইংরেজ নরপশুর দল। পরদিন সকালে উভয়ের নি®প্রাণ দেহ সে সময়ে চট্টগ্রাম বন্দরে অবস্থিত একখানা ব্রিটিশ জাহাজযোগে নিয়ে বঙ্গোপসাগরের জলে নিক্ষেপ করা হয়েছিল। মাস্টারদা ও তারকেশ্বর দস্তিদারের মরদেহ লুকিয়ে ফেললেও মৃত্যুঞ্জয়ী বিপ্লবী সূর্য সেনের আদর্শকে, কীর্তিকে কোনদিন বিনষ্ট করা যাবে না। রাহুমুক্ত সূর্যের মতোই তিনি ভাস্বর।
ফাঁসির ৫ ঘণ্টা পূর্বে মাস্টারদার শেষ বাণী : আমার শেষ বাণী – আদর্শ ও একতা। ফাঁসির রজ্জু আমার মাথার উপর ঝুলছে। মৃত্যু আমার দরজায় করাঘাত করছে। মন আমার অসীমের পানে ছুটে চলেছে। এই তো আমার মৃত্যুকে বন্ধুর মত আলিঙ্গন করার সময়। হারানো দিনগুলোকে নূতন করে স্মরণ করার সময়।
আমার ভাইবোনগণ, তোমাদের সবার উদ্দেশ্যে বলছি, আমার এই বৈচিত্র্যহীন জীবনের একঘেয়েমিকে তোমরা ভেঙে দাও, আমাকে উৎসাহ দাও। এই আনন্দময়, পবিত্র ও গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে আমি তোমাদের জন্য কী রেখে গেলাম? শুধু একটিমাত্র জিনিস, তা হ’ল আমার স্বপ্ন। এক শুভমুহূর্তে আমি প্রথমে এই স্বপ্ন দেখেছিলাম। উৎসাহভরে সারা জীবন তার পেছনে উন্মত্তের মতো ছুটেছিলাম। জানি না, এই স্বপ্নকে কতটুকু সফল করতে পেরেছি। আমার মৃত্যুর শীতল স্পর্শ যদি তোমাদের মনকে এতটুকু স্পর্শ করে, তবে আমার এই সাধনাকে তোমরা তোমাদের অনুগামীদের মধ্যে ছড়িয়ে দাও— যেমন আমি তোমাদের দিয়েছিলাম। বন্ধুগণ, এগিয়ে চলো। কখনো পিছিয়ে যেও না। দাসত্বের দিন চলে যাচ্ছে। স্বাধীনতার লগ্ন আসন্ন। ওঠো, জাগো। জয় আমাদের সুনিশ্চিত।
মাস্টারদা চট্টগ্রাম জেল থেকে ১ জানুয়ারি, ১৯৩৪ সালে লেখা এক চিঠিতে তাঁর ছোটভাই কমল সেনকে ফাঁসির পূর্বে তাঁর সঙ্গে একবার দেখা করতে অনুরোধ করেন। কিন্তু ফাঁসির দু’দিন পর মাস্টারদার এই সহোদর জানতে পারেন যে, তাঁর ভারতখ্যাত বিপ্লবী বড়ভাইয়ের ফাঁসি হয়ে গেছে। কমল সেন চট্টগ্রাম জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে তাঁর দাদার মৃতদেহ সম্পর্কে দরখাস্ত দিলে, তাঁকে জানানো হয়Ñ ১২ জানুয়ারি (১৯৩৪) তাঁকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে এবং মৃতদেহ দাহ করা হয় নি। দুনিয়া সভ্য ও ভদ্র বলে যারা গর্ব করে, সেই ইংরেজ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মহাবিপ্লবী মাস্টারদার ফাঁসির খবর তাঁর নিকট আত্মীয়দের জানালেন না। দাহ না করলেও, ঐ মৃতদেহের সৎকার কিভাবে কোথায় হয়েছিল তাও জানালেন না। তার একমাত্র কারণ, প্রতিহিংসায় উন্মুক্ত ব্রিটিশ শাসককুল জানত যে, এই মহাবিপ্লবীর সমাধিস্থল একদিন ভারতবাসীর কাছে এক পরম শ্রদ্ধা ও গৌরবময় স্থান হিসেবে প্রতিভাত হবে। তাই বিশেষ তৎপরতার সঙ্গে এই দুই বিপ্লবী নেতার মৃতদেহ অত্যন্ত সুকৌশলে গোপন করে।
চট্টগ্রাম কারাগারে ১৯১৮ সালে নির্মিত ফাঁসির মঞ্চে ১৯৩৪ সালের ১২ জানুয়ারি মাস্টারদা সূর্যসেন ও তারকেশ্বর দস্তিদারকে ফাসি কার্যকর করা হয়েছিল, সে ফাসির মঞ্চে মাস্টারদার স্মৃতি ধরে রাখা হলেও তাঁরই সহযোদ্ধা বিপ্লবী তারকেশ্বর দস্তিদারের কোন স্মৃতিচিহ্ন নেই।
লেখক : গবেষক, লেখক ও প্রকাশক