যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাপিটাল হিলে উচ্ছৃঙ্খল জনতার হামলা : প্ররোচনায় স্বয়ং আমেরিকার প্রেসিডেন্ট!

39

শাহাবুদ্দীন খালেদ চৌধুরী

১৭৮৯ সালের ৩০ এপ্রিল জর্জ ওয়াশিংটন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথবাক্য পাঠ করেন। স্থানটি ছিল ওয়াল স্ট্রিটে অবস্থিত ফেডারেল হল। অনুষ্ঠানটি ছিল অত্যন্ত গুরুগম্ভীর এবং সংক্ষিপ্ত। নতুন রাষ্ট্র, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক অবস্থা এতই নাজুক ছিল, সর্বসাকুল্যে ফেডারেল সরকারের কর্মচারী এবং কর্মকর্তাদের মধ্যে ছিল মাত্র ডজনের মতো কেরানি আর ৬৭২ জনের মতো সামরিক জাওয়ান এবং সেনাবাহিনীর অফিসার। নৌবাহিনীর কোন অস্তিত্বই ছিল না। এই পর্যন্ত বিশ্বের কোন বিপ্লবের নেতা ওয়াশিংটনের মতো কপর্দক-শূন্য অবস্থায় ছিল বলে ইতিহাসে দেখা যায় না। যেহেতু আমেরিকার নতুন ফেডারেল সরকার তখন পর্যন্ত ঐ পর্যায়ে কোন বিচার ব্যবস্থার আয়োজন করতে পারে নাই, কাজেই সেই সময়ে আমেরিকাতে ফেডারেল পর্যায়ে কোন আদালতের অস্তিত্বই ছিল না। যদিও তখন ওয়াশিংটন ধনাঢ্য লোক বলে খ্যাতি ছিল,কিন্তু সেই সময়ে নব-নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের নিউইয়র্ক যাওয়া এবং অন্যান্য খরচ মেটানোর জন্য ৩০০০ ডলার ঋণ করতে হয়েছিল।
অবশ্য তিনি ৪ বৎসর করে দুই দফায় ৮ বৎসর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে শাসনতান্ত্রিক পন্থায় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন। তাঁর ৮ বৎসরের ক্ষমতাকালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সরকারের অবর্ণনীয় দক্ষতা এবং প্রজ্ঞার সহিত সংগঠিত করতে প্রশংসনীয়ভাবে সক্ষমতার পরিচয় দিয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে তাঁর দক্ষতা, দূরদর্শিতা এবং দেশপ্রেমের কথা স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। তিনি ছিলেন বিনয়ী এবং নম্র স্বভাবের তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব মেধার চাইতে ও চরিত্রেই বেশি বিরাজ করত।
তিনি যাই বলতেন অকপটে বলতেন, ছল, চাতুরীর আশ্রয় নিতেন না। তিনি ভীষণভাবে পরিশ্রমী ছিলেন দীর্ঘ ৮ বৎসর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট থাকাকালে মাত্র ১৮১ দিন ছুটি কাটিয়েছেন। হৃদয় দিয়ে তিনি তাঁর অধীনস্তদের ভালোবাসতেন। তাঁর অধীনস্থরা ও প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি সফল হওয়ার জন্য নিজেদের প্রাণ বিসর্জন দিতে প্রস্তুত ছিলেন। স্বাধীন যুক্তরাষ্ট্রের গোড়াপত্তনের পর, বর্তমানে সর্বমোট ২৩১ বৎসর হতে চলছে। এই দীর্ঘ সময়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প সহ ৩৫ জন প্রেসিডেন্ট দেশটির শাসনকার্য পরিচালনা সুযোগ পেয়েছেন। এর মধ্যে বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০২১ সালের ২০ জানুয়ারি ক্ষমতা হস্তান্তর করতে বলেছেন।বর্তমানে এবং ভবিষ্যতের ঐতিহাসিকেরা নিশ্চয় এক বাক্যে স্বীকার করবেন যুক্তরাষ্ট্রের ২৩১ বৎসরের জাতীয় জীবনে বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মত একজন অ-রাজনৈতিক, আত্মকেন্দ্রিক, ঝগড়াটে এবং খিটখিটে মেজাজ বিশিষ্ট প্রেসিডেন্ট আমেরিকানদের তথা বিশ্ববাসীদের আর কোন সময় দেখার সুযোগ হয় নাই। বিশ্বের বড় বড় পাগলাগারদের নিয়ন্ত্রণে এ জাতীয় লোক সফলতা লাভ করতে পারে, কিন্তু বিশ্বের একটি সেরা দেশকে এই শ্রেণির নেতৃত্ব দিয়ে পরিচালনা করার চিন্তা করাও বিধাতার কাছে পাপ বলে গণ্য হবে।
জানুয়ারী মাসের ৬ তারিখ রীতি অনুযায়ী আমেরিকান কংগ্রেস যখন বাইডেনকে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হিসেবে লিখিত ঘোষণা দেওয়ার ব্যবস্থা নিতে, বৈঠক বসেছিল তখন আমেরিকার বর্তমান প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের উচ্ছৃঙ্খল সমর্থকেরা যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসির ক্যাপিটাল বিল্ডিং এ সমবেত হয়ে জোর করে হাউজ চেম্বারে বে-আইনিভাবে এবং উচ্ছৃঙ্খলভাবে ঢোকার জন্য পুলিশের সাথে ব্যাপক সংঘর্ষে লিপ্ত হয় এবং হাউজ চেম্বারে ব্যাপকভাবে পাথর নিক্ষেপ করতে থাকে। ক্ষয়ক্ষতি যাই হোক আসল সত্য হলো ইহা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের আপামর জনগণের, সরকার এবং বিরোধীদলের প্রায় ২৩১ বৎসরের অক্লান্ত পরিশ্রম এবং ত্যাগ তিতিক্ষার ফলে গড়ে ওঠা যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ গুলির আমেরিকাকে সারা বিশ্বের সামনে গৌরবান্বিত করেছিল তা মুহূর্তের মধ্যে ধুলিসাৎ হয়ে গেল। গণতান্ত্রিক বিশ্ব এই ঘটনায় নিদারুণভাবে মর্মাহত হয়েছে। সারাবিশ্বে যারা গণতন্ত্রকে চিরতরে উৎখাত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত, তাঁরা দারুণভাবে এই ঘটনায় উৎসাহিত হয়েছে। এই ঘটনার আগে ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেই তাঁর সমর্থকদের নিয়ে ক্যাপিটাল বিল্ডিং এর সামনে সভা করে নতুন প্রেসিডেন্ট জন্য কংগ্রেসের সমস্ত আনুষ্ঠানিকতা বানচাল করার জন্য উদাত্ত আহŸান জানিয়েছিলেন। আমেরিকার ইতিহাসে যত প্রেসিডেন্ট এসেছেন, এই জঘন্য কাজ কোন প্রেসিডেন্ট এর পক্ষে কল্পনা করাও অসম্ভব। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স এবং রিপাবলিকান দলের বিশিষ্ট সিনেটের ম্যাক কনেল ট্রাম্পের এই অগণতান্ত্রিক এবং ধ্বংসাত্মক কাজে তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন।
রিপাবলিকান পার্টি থেকে নির্বাচিত আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ এর তীব্র নিন্দা জানিয়ে বলেছেন, This is how election results are disputed in a banana Republic not our democratic Republic. অর্থাৎ কলাতুল্য প্রজাতন্ত্রে এইভাবে নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করা যায় কিন্তু আমাদের গণতন্ত্রের তা সম্ভব নয়। এবং ট্রাম্পের একই রিপাবলিকান পার্টির প্রভাবশালী সদস্য এবং বর্তমানে সিনেটের মিট রমনী বলেছেন,what happened here today was an insurrection incited by the president of United States.অর্থাৎ আজকে এখানে যা ঘটেছে তাকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের উস্কানির ফলে একটি বিদ্রোহ বলা যায়।ট্রাম্পের নিজের দল রিপাবলিকান পার্টির আর ও অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিনেটরেরা এই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার জন্য ট্রাম্পকে দায়ী করে তীব্র নিন্দা জানানো অব্যাহত রেখেছেন। অনেকদিন থেকে ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠজন ভাইস-প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স এবং সিনেট নেতা ম্যককোন্যল সহ আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ রিপাবলিকান সিনেটর ট্রাম্পের এই বেআইনি, উস্কানিমূলক কর্মকাÐে প্রত্যাখ্যান করেছেন।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্র দুইশত ত্রিশ বৎসর সময়ব্যাপী সারা বিশ্বে যে মর্যাদা ও সম্মানের আসন অলংকৃত করেছিল তা ট্রাম্পের আমেরিকার জনগণের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টির ফলে হারাতে থাকে। অথচ একই রিপাবলিকান দলের মনোনীত প্রার্থী রোনেল্ড রিগ্যান আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে বলেছিলেন, we have to move ahead, but we’re not going to leave anyone behind, I ask to you to trust that American spirit which knows no ethnic, religious, social, political or economic boundaries, the spirit that burned with zeal in the hearts of millions of immigrants from every corner of the earth who came here in search of freedom.অর্থাৎ আমাদের কে সামনে এগিয়ে যেতে হবে কিন্তু আমরা কাউকে ও পিছে ফেলে যাবো না আমি আপনাদেরকে আমেরিকার চেতনায় বিশ্বাস রাখতে বলছি যা কোন জাতীয়, ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ভেদাভেদে বিশ্বাস করে না।
ডোনাল্ড ট্রাম্প সারা জীবন ব্যাপী একজন দক্ষ্য ব্যবসায়ী। বর্তমান বিশ্বে সর্বশ্রেণীর মানুষের মানব মূল্যবোধ দ্রুত কমে যাচ্ছে। সবচাইতে বেশি কমছে ব্যবসায়ী শ্রেণীর। কাজেই স্বাভাবিকভাবে ট্রাম্প সাহেবের মানবিক মূল্যবোধ একজন ত্যাগী রাজনীতিবিদদের সমান হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। কাজেই যুক্তরাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং আমেরিকায় বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের মধ্যে সমমর্যাদার দাবী কত গভীরতা ট্রাম্প সাহেবের বুঝে নাও আসতে পারে। মার্কিন রাজনীতিবিদদের একথা বুঝতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের শুধু পেশাগত পার্থক্য গ্রহণযোগ্য আর বাকি সর্বপ্রকার পার্থক্যকরণকে ঘৃণার চোখে দেখা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ‘সুযোগের সাম্য’ বলতে বুঝায় ‘শিক্ষার সমান সুযোগ’ অন্য কিছু নয়। আমি আর দুটো উদ্ধৃতি দিয়ে আমার লেখার ইতি টানতে চাই। একটি হলো আব্রাহাম লিংকনের, যিনি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তিনিও রিপাবলিকান পার্টির মনোনীত প্রার্থী ছিলেন তিনি বলেছেন,you can fool all the people some of the time, and some of the people all the time but you cannot fool all the people all the time. অর্থাৎ আপনি সব লোককে কিছু সময়ের জন্য বোকা বানাতে পারেন এবং কিছু লোককে সব সময়ের জন্য বোকা বানিয়ে রাখতে পারেন কিন্তু আপনি সব সময়ের জন্য সব মানুষকে বোকা বানিয়ে রাখতে পারবেন না।
ভারতের স্বাধীনতার প্রধান মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন, Stoning prophets and erecting churches to their memory afterward had been the way of the world through the ages. Today we worship christ but christ in the flesh we crucified. গান্ধীজী বলেছিলেন যুগে যুগে পয়গম্বর বা রাসুলদেরকে পাথর নিক্ষেপ করা হয়েছিল কিন্তু পরে তাদের স্মরণে গির্জা তৈয়ার করা হয়েছে। যুগে যুগে এইভাবে চলে আসছে। আজকে যিশুখ্রিস্টের এর বন্দনা করা হচ্ছে, অথচ তাকে ক্রুশবিদ্ধ করে বধ করা হলো।
লেখক: কলামিস্ট