যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে রফিক মিয়া ও জহুর আহমদ চৌধুরী ‘মখিভার কাছে হস্তীর পরাজয়’

47

নাসিরুদ্দিন চৌধুরী

জহুর আহমদ চৌধুরীর বহু পরিচয়-যেমন তিনি আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, চট্টগ্রাম সিটি আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা, পথিকৃৎ শ্রমিক নেতা, ভাষাসৈনিক, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি (কমিশনার-চট্টগ্রাম পৌরসভা-৫২, এমএলএ/৫৪, এমপিএ/৭০, গণপরিষদ সদস্য/৭২, এমপি/৭৩), মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক (চেয়ারম্যান- লিবারেশন কাউন্সিল-ইস্টার্ন জোন/জোনাল এডমিনিস্ট্রেটিভ কাউন্সিল, সাউথ ইস্ট জোন-২), বঙ্গবন্ধু’র মন্ত্রিসভার সদস্য; কিন্তু এসব পরিচয় একটি সূত্রে গাঁথা, সেটি হলো রাজনীতি। এটাই তাঁর আদি এবং অকৃত্রিম পরিচয়। রাজনীতির সূত্রেই তাঁর যত প্রাপ্তি।

এই নিঃস্বার্থ জনসেবা ও পরোপকারের পুরস্কারও পেয়েছেন তিনি হাতে হাতে। মানুষ তাঁকে হৃদয় উজাড় করে ভালোবেসেছে, সমর্থন দিয়েছে। ভক্তি ও শ্রদ্ধার প্রকাশ এমন যে, তাঁর ভোটের বাক্স শুধু ব্যালট দিয়ে ভরিয়ে দেয়নি, সঙ্গে টাকাও দিয়েছে। ব্যালট নির্বাচনে বিজয়ী করার জন্য, টাকা তাঁর নির্বাচনের খরচ মেটানোর জন্য। এটা ১৯৫৪ সালের ঘটনা, যেবার হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর যুক্তফ্রন্ট পূর্ব বাংলার মাটি থেকে মুসলিম লীগের নাম নিশানা প্রায় মুছে ফেলেছিলো। জহুর আহমদ চৌধুরী সে নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছিলেন যুক্তফ্রন্টের টিকিটে। প্রতিদ্বন্দ্বী্ সেই সময়ের চট্টগ্রামের শীর্ষ ধনী, সর্বজনশ্রদ্ধেয় নেতা ও প্রভাবশালী সমাজপতি, রেয়াজউদ্দিন বাজারের মালিক শেখ রফিউদ্দিন সিদ্দিকী। জহুর আহমদ চৌধুরীও তাঁকে খুবই সম্মান করতেন ও সম্ঝে চলতেন। রফিউদ্দিন সিদ্দিকী মুসলিম লীগ থেকে প্রার্থী না হলে জহুর আহমদ চৌধুরী তাঁর বিরুদ্ধে নির্বাচন না করার কথাই ভেবেছিলেন। তিনি তাঁকে অনুরোধও করেছিলেন, কিন্তু রফিউদ্দিন সিদ্দিকী রাজি হননি। ফলে দু’জনের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হলো এবং রফিউদ্দিন সিদ্দিকী শোচনীয় পরাজয় বরণ করলেন।
এই ঘটনা বঙ্গীয় রাজনীতিতে এতটাই গুরুত্ব পায় যে, কলকাতার বিখ্যাত ইংরেজি দৈনিক ‘স্টেটসম্যান’ সম্পাদকীয় পর্যন্ত প্রকাশ করে। তাতে মন্তব্য করা হয় যে, জহুর আহমদ চৌধুরীর কাছে রফিউদ্দিন সিদ্দিকীর এই পরাজয় ‘মক্ষিকার কাছে হস্তীর পরাজয়ের সমতুল্য’।
জহুর আহমদ চৌধুরী ছিলেন রাজনীতির বরপুত্র। যখন যে কাজে হাত দিয়েছেন, তাতেই সফল হয়েছেন। দেশভাগের পর কলকাতা থেকে প্রথমে ঢাকা, তারপর জন্মস্থান চট্টগ্রামে এসে ঘোড়ার গাড়ি, গরুর গাড়ি চালক, দোকান কর্মচারীদের নিয়ে সেই যে আন্দোলন শুরু করেছিলেন, তারপর কর্ণফুলীর পানি যতই গড়িয়েছে জহুর আহমদ চৌধুরীর প্রতিষ্ঠা ও প্রতিপত্তি ততই বেড়েছে। একে একে সব সাফল্যের বরমাল্য যতই তাঁর গলায় উঠেছে, ততই তিনি উঁচুতে উঠতে উঠতে এমন উচ্চতায় উপনীত হন যে, জীবিতকালেই তিনি কিংবদন্তীতে পরিণত হন। খ্যাতির মধ্যগগনে থাকতেই, যখন তিনি একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছেন, তখন সেই অনিবার্য নিয়তি, যার কাছে আত্মসমর্পণ করা ছাড়া মানুষের গত্যন্তর তাকে না, তাঁর প্রতিপক্ষ হিসেবে আবির্ভূত হয় এবং তাঁর জীবনের ওপর যবনিকা টেনে দেয়। সেই অবধারিত পরিণতি বরণের কালেও তিনি ছিলেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পূর্ণমন্ত্রী। মৃত্যু তাঁর জীবনের গতি থামিয়ে দিয়েছিলো সত্যি, কিন্তু জহুর আহমদ চৌধুরীর উড্ডীন বিজয়ের পতাকা নমিত করতে পারে নি। বরং জাতীয় পতাকাই নমিত হয়ে মৃত্যুঞ্জয়ী বীরের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেছে। আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে জহুর আহমদ চৌধুরীই একমাত্র নেতা, যিনি পূর্ণ রাষ্ট্রীয় ও সামরিক মর্যাদায় সমাহিত হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছেন। মরেও তিনি অমর হয়ে থাকলেন ইতিহাস সৃষ্টি করে।
জহুর আহমদ চৌধুরী আদর্শিক রাজনীতির এক অত্যুজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ১৯৪৯ সালে জন্মলগ্ন থেকে আওয়ামী লীগের সাথে যুক্ত হয়ে চট্টগ্রাম শহরে এই দলকে সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা করেন; স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন এবং বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার সদস্য হিসেবে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনরত অবস্থায় যখন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন ১৯৭৪ সালে, তখনো তিনি আওয়ামী লীগেরই কেন্দ্রীয় নেতা। দল ও আদর্শের প্রতি এই অবিচল নিষ্ঠাই তাঁর জীবনকে অনন্য মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছে। জহুর আহমদ চৌধুরীর মৃত্যুতে জাতীয় সংসদে প্রদত্ত শোক বিবৃতিতে সংসদ নেতা, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁকে (জহুর আহমদ চৌধুরী) আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে সত্তরের নির্বাচনে বাংলার জনগণের নিরংকুশ রায়ে বাঙালির একমাত্র প্রতিনিধিত্বকারী দল হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত আওয়ামী লীগের বন্ধুর পথ পরিক্রমায় প্রতি পদে পদে বিছানো ছিলো ষড়যন্ত্র ও অত্যাচার-নির্যাতনের কাঁটা। আর এই কন্টকাকীর্ণ পথ বেয়ে পশ্চিম পাকিস্তানি শোষণের যাঁতাকল থেকে বাংলার মানুষের মুক্তির আন্দোলন পরিচালনা করতে গিয়ে আওয়ামী লীগ নেতারা জেল-জুলুম-হুলিয়া তথা অবর্ণনীয় নির্যাতনের শিকার হন। বাঙালির মুক্তিসনদ ৬ দফা দাবি উত্থাপন করায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলানোর জন্য ষড়যন্ত্রমূলক আগরতলা মামলায় গ্রেফতার করে বিচারের নামে প্রহসনের নাটক মঞ্চায়নের অপচেষ্টা চালিয়েছিলো। কিন্তু বাংলার জাগ্রত ছাত্র-জনতার প্রচন্ড গণঅভ্যুত্থানের মুখে পশ্চিমা শাসকদের সে ষড়যন্ত্র নস্যাৎ হয়ে যায়। তাসের ঘরের মতো উড়ে যায় আইয়ুবের তখ্তে তাউস। জহুর আহমদ চৌধুরীও আইয়ুব-মোনায়েমের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন। তাঁকে এক কারাগার থেকে আরেক কারাগারে বদলি করে করে হয়রানি ও নির্যাতন চালানো হয়। সিলেট জেলে অমানুষিক নির্যাতন চালানোর ফলে তাঁর শ্রবণশক্তি হ্রাস পায়। জহুর আহমদ চৌধুরীর জীবনের সবচেয়ে গৌরবজনক অধ্যায় মুক্তিযুদ্ধ-একাত্তর সালের ২৬ মার্চ (২৫ মার্চ মধ্যরাতে) বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার পর তা চট্টগ্রামে জহুর আহমদ চৌধুরীর কাছে পাঠিয়েছিলেন দেশে-বিদেশে প্রচারের জন্য। পরবর্তীকালে চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকেও বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা প্রচার করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধে আগরতলায় অবস্থান নিয়ে জহুর আহমদ চৌধুরী মুজিব নগর সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে গোটা দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই তিনি আগরতলা গিয়ে সাংবাদিকদের মাধ্যমে বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের সংবাদ বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছে দেন। তিনিই প্রথম বাংলাদেশের পক্ষে ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রীর মাধ্যমে ভারত সরকারের সাথে যোগাযোগ করেন এবং মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতার আহ্বান জানান। বাংলাদেশের এমএনএ-এমপিএ-দের নিয়ে বৈঠক করেন এবং মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য সাংগঠনিক কাঠামো গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন। আবার মুক্তিযুদ্ধ শেষে তিনিই প্রথম হানাদারমুক্ত বাংলার মাটিতে বিজয়ের পতাকা উত্তোলন করেন। ঢাকা গিয়ে বেতার কেন্দ্র থেকে জাতির উদ্দেশে ভাষণে মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের ঘোষণা দেন। পাশাপাশি মুক্ত স্বদেশে প্রশাসন চালু করেন।
১৯১৫ সালে কাট্টলীতেই জহুর আহমদ চৌধুরীর জন্ম। বৈপ্লবিক পরিবেশেই তাঁর বেড়ে ওঠা, মানস গঠন। ১৯৩২ সালে প্রীতিলতার নেতৃত্বে বিপ্লবীরা যখন কাট্টলী থেকে ইউরোপিয় ক্লাব আক্রমণের জন্য যান, তখন জহুর আহমদ চৌধুরী কাট্টলীরই তারুণ্যছোঁয়া সপ্তদশবর্ষীয় এক কিশোর। বিপ্লবী দলের সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন না, কিন্তু বিপ্লবীরা তাঁর আশেপাশেই ছিলো। বিপ্লবের আবহেই তিনি বেড়ে উঠছিলেন। শান্তি-প্রফুল্লরা যে বিপ্লবের আগুন নিয়ে খেলছিলেন তার কিছু আঁচ তো পাড়া-প্রতিবেশির গায়ে অনুভূত হবেই। বিশেষত রোমাঞ্চের জন্য উন্মুখ হয়ে থাকা কিশোর রক্তে সে যে তুমুল আন্দোলন উপস্থিত করবে, তাতে কোনো সন্দেহ থাকতে পারে না। পাহাড়তলীতে ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণের পর ঘটনা যখন জানাজানি হলো, সে খবর নিশ্চয়ই কিশোর জহুর আহমদ চৌধুরীও শুনে থাকবেন। দু’ বছর আগে ১৯৩০ সালে মাস্টারদা সূর্যসেনের নেতৃত্বে অস্ত্রাগার আক্রমণ ও জালালাবাদ পাহাড়ে বিপ্লবীদের হাতে ব্রিটিশ সৈন্যদের নাকাল হওয়া- নিকট দূরত্বে সংঘটিত দু’টি সাংঘাতিক ঘটনায় সেদিন চট্টগ্রাম কেন, গোটা ভারতবর্ষই কেঁপে উঠেছিলো, হয়তো সাত সমুদ্রের ওপারে বাকিংহাম প্রাসাদে ব্রিটেনের রাণীর সিংহাসনও টলে উঠেছিলো।
পাহাড়তলীরই অদূরে কাট্টলীতে বসবাসকারী জহুর আহমদ চৌধুরীর কিশোর চিত্তেও তার প্রভাব পড়া অস্বাভাবিক নয়। উত্তরকালে জহুর আহমদ চৌধুরীর সংগ্রামী জননেতা হয়ে ওঠার এটাই হয়তো পশ্চাৎপট। রাজনৈতিক জীবনে তাঁর মধ্যে যে সাহস ও আপসহীন মনোভাব পরিলক্ষিত হয়, হয়তো তিনি চোখের সামনে বিপ্লবী তৎপরতা প্রত্যক্ষ করার ফলেই তা লাভ করেছিলেন। তার সাথে মিশেছিলো পূর্বপুরুষের সাহসী নাবিকের রক্ত। ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ের সাথে পাঞ্জা লড়ে তাঁদেরকে জীবিকা নির্বাহ করতে হতো বলে তারা হতেন উদ্দাম, বেপরোয়া। সে কারণে তাদের উত্তরপুরুষ নির্ভীক হবেন এটাই তো স্বাভাবিক। আর কী আশ্চর্য সমাপতন! যে দুইজন সিংহপুরুষ চট্টগ্রামে মুসলিম লীগের দুর্গ গুঁড়িয়ে দিয়ে আওয়ামী লীগের বৈজয়ন্তী উড্ডীন করেছিলেন, তাঁরা উভয়েই একই সমুদ্র উপকূলের সন্তান। একজন তো কাট্টলীর জহুর আহমদ চৌধুরী। আর একজন হালিশহরের এম.এ আজিজ।
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, সিনিয়র সাংবাদিক