যায় দিন ভালো, আসে দিন খারাপ!

611

অনাদিকাল ধরে জনশ্রæত এই প্রবাদটা আমাদের অবচেতন মনে নিজের মস্তিষ্কের হিপ্পোক্যাম্পাসকে গ্রাস করে রেখেছে বলেই আমাদের অপেশাদার চেতনা জগতে পুরনো ধ্যান ধারণা দিব্যি অক্টোপাসের শৃঙ্কলের মতো জঁটলা পাঁকিয়ে রাখে, যেখানে উঠেনা আর নতুনত্বের আলোড়ন, জাগেনা নবজয়ের উচ্চাশা! নির্মোহ ঘুমেরঘোরে রঙিন স্বপ্ন বুনতে বুনতে বাস্তবায়নের যুদ্ধে ব্রত হওয়ার আগেই যেনো চোখের পলকে বিলীন হলো ২০১৯, আর পঞ্জিকার পাতায় ঠাঁই নিলো ২০২০! নতুন দিনে জীবনের জন্য নতুনত্ব আনতে চাই সবাই, চাই বিনিদ্র স্বপ্নগুলোকে উষ্ণ দুহাতে ছুঁয়ে দেখতে; অথচ সীমিত এ জীবনটায় স্বপ্ন দেখার সময়টা দীর্ঘ করে ধরার সময়টাকে আমরা এতোবেশি ক্ষীণ করে ফেলি যে অপ্রস্তুত- কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ি বছরের শেষ সময়টায় এসে। কেননা ফেলে আসা সময়ে সব প্রাপ্রি-অপ্রাপ্তি, সফলতা কিংবা ব্যর্থতা, আশা-নিরাশার হিসেব মিলাতে মিলাতেই ভুলে বসি আমরা আমাদের নতুন বছরের কর্মপরিকল্পনা; পুরনো নিয়ে মত্ত চিন্তাজগত নিরাশার জড়তা কাটিয়ে উঠতেই চলে যায় নতুন বছরের অর্ধেকটা সময়, ফলে বছরশেষে আবারো সেই অপ্রাপ্তির পুরনো ক্রোনিক হতাশারা ঝেঁকে বসে পুরোটা চিন্তাজগত জুড়ে! তাই বছর শেষে এই ক্রোনিক ডিপ্রেশন রোধ করতে নতুন বছরের প্রথম দিন থেকেই ভাবতে হবে, পরিকল্পনা সাজাতে হবে কীভাবে কাটাতে চান নতুন বছরটা, তৈরী করতে হবে নিজের কর্মপঞ্জিকা। তবে নতুন বছরের সব পরিকল্পনা খুব সহজেই বাস্তবায়িত হবে এমন ভাবার কারণ নেই; বাধা-বিপত্তি আসবেই, তা প্রতিরোধ করার জন্যেও তৈরি থাকতে হবে আগে থেকেই, রাখতে হবে দৃঢ় মনোবল। মনে রাখা জরুরি, দশটা সাফল্যের চেয়ে একটা ব্যর্থতাই আমাদের বেশি পীড়া দেয়, তাই সেই ব্যর্থতার জায়গাগুলোকে সফলতায় ট্রান্সফর্ম করতে অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে প্ল্যান বি রাখাটা অত্যন্ত জরুরি। এখন যদি প্রশ্ন আসে, এই নতুন বছরে আমার কর্মপন্থা কি হতে পারে?
নিশ্চয় বলবেন গতানুগতিক ধারায় নিজেকে বদলানোর জন্য একাধিক সংকল্প করবো, সুস্বাস্থ্য অর্জন, অপচয় রোধ কিংবা হ্যান্ডসাম ইনকাম অথবা কোনো বদভ্যাস বর্জনের প্রচেষ্টা? ভুল কিছু নয়, তবে সাথে এটাও মনে রাখতে হবে যুগের পালে হাওয়া লেগেছে বহু আগেই; পৃথিবী এগিয়েছে বহুদূর, শুধু পিছিয়ে আছি আমি-আপনি। কেন? খুব সহজ, সময়ের চাহিদাগুলো নিজের মাঝে ধারণ করার অক্ষমতার কারণে! শুধুমাত্র আমাদের ক্যারিয়ার প্ল্যানিং এর দিকেই দেখুন না, প্রজন্মের সিংহভাগ পার্সোনাল প্রোফাইল রিচ করা কিংবা সময়োপযোগী স্কিল ডেভেলাপমেন্টের পরিবর্তে এখনো বইয়ের অক্ষরে আর মুখস্থ বিদ্যায় নিজের স্বপ্ন বুনে! শিক্ষাব্যবস্থায় গ্রেডিং পদ্ধতি আমাদের করে রেখেছে সমাজ হতে বিচ্ছিন্ন, জাতিগতভাবে বিভক্ত! তাই ইন্টারপার্সোনাল কিংবা পেশাগত দক্ষতা অর্জনের চেয়েও সিজিপিএ অর্জনেই কাটিয়ে দিই আমরা পুরোটা ছাত্রজীবন। সম্প্রতি ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম ‘ফোর্বস ম্যাগাজিন’-এ একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। তাতে উল্লেখ করা হয়েছে ২০২০ এ ক্যারিয়ার কিংবা নানা উদ্যোগে আপনাকে এগিয়ে রাখতে প্রয়োজন ১০টি বিশেষ স্কিল বা দক্ষতা। উল্লেখিত স্কিলগুলো হলো – জটিল সমস্যা সমাধানের যোগ্যতা, ক্রিটিক্যাল থিংকিং, ক্রিয়েটিভিটি, অন্যকে ম্যানেজ বা কনভিন্স করার ক্ষমতা, মানুষের সঙ্গে সমন্বয় করা কিংবা সামাজিকতা, ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স, বিচার ও ডিসিশন নেয়ার সামর্থ্য, সেবা দেয়ার মানসিকতা, নেগোশিয়েশন এবং মানসিক শক্তি।
একটু চিন্তা করুনতো, মোবাইল ফোনের শুরুর দিকটাই এটি কেবলই কমিউনিকেশনের উদ্দেশ্যে ব্যবহার হতো , কিন্তু আমরা ডিভাইসটির নিত্যনতুন ফিচার ব্যবহার শিখে নতুন নতুন অনেক সমস্যার সমাধান খুঁজে পাচ্ছি, জীবনকে সহজতর করে তুলছি। ঠিক তেমনি, সময়ের সাথে তাল মিলের যুগের ফিচারগুলোও আমাদের ধারণ করতে হবে, নয়তো বিবর্তনবাদের গ্রোতে যোগ্যতরের টিকে থাকার লড়াইয়ে বিলীন হতে হবে আপনাকে আমাকে। দ্বিধাদ্ব›েদ্ব থেকে সাতপাঁচ ভাবতে থাকলে পিছিয়ে পড়বেন নির্দ্বিধায়; তাই সময়ক্ষেপণ না করে পরিকল্পনা অনুযায়ী বছরের শুরু থেকেই যুগের ফিচারগুলো আয়ত্তে আনার চেষ্টা করুন, লক্ষ্য নির্ধারণ করে ঝুড়িভর্তি করুন আপনার প্রয়োজনীয় স্কিলগুলো দিয়ে। এক্ষেত্রে মনে রাখা জরুরি, যে সংকল্পই আপনি গ্রহণ করুন না কেন, তা অর্জনের জন্য আপনার যা অবশ্য প্রয়োজন তা হলো মোটিভেশন তথা নিজের মধ্যে উদ্দীপনা সৃষ্টি করা। কিন্তু আমরা সবাই জানি সেই উদ্দীপনা তৈরি করা কতটা কষ্টকর। যুক্তরাষ্ট্রের স্ক্যানট্রন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে মাত্র ৮ শতাংশ মানুষ বছরের শুরুতে নেওয়া সংকল্প বাস্তবায়ন করতে পারে। কিন্তু আপনাকে সেই ৯২ শতাংশ ব্যর্থ মানুষের তালিকায় থাকতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। কীভাবে আপনি সফলতাকে অর্জন করতে পারেন নিচে তার কিছু উপায় উল্লেখ করা হলো। চেষ্টা করে দেখুন; আপনার জন্য শুভেচ্ছা।
১। কর্মপঞ্জিকা তৈরি করুন: নতুন বছরে কী কী করতে চান তা ঝটপট নোট তৈরি করে ফেলুন, তৈরী করুন পার্সোনাল ওয়ার্ক ক্যালেন্ডার। কাজ শেষ হলে তাতে টিক চিহ্ন দিন, এতে করে সবসময় নিজের কাজের গতি বা অবস্থান বুঝতে পারবেন। নির্ধারণ করে নেওয়া সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করার ক্ষেত্রে সচেষ্ট থাকুন।
২। সুনির্দিষ্ট এজেন্ডা নির্ধারণ করুন: স্পষ্ট ও স্বচ্ছ লক্ষ্য নির্ধারণ করুন। আমাদের প্রধান একটি সমস্যা হচ্ছে আমরা অতিমাত্রায় উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য নির্ধারণ করি। ‘এমন একটা কিছু ভেবে বসি যে নতুন বছরে আমি নতুন এক মানুষ হয়ে উঠবো- এমন ভাবনার ভিত্তিটাই গরল,’ বলছেন মনোবিজ্ঞানী র‌্যাচেল ওয়েনস্টেইন। আমরা অনেক সময় লক্ষ্য স্থির করার আগে ভাবিনা ঠিক কীভাবে তা অর্জন করা যাবে। সুতরাং খুঁটিনাটি পরিকল্পনা খুবই জরুরি।
৩। মনকে স্থির করুন: প্রয়োজনে ধীরে শুরু করুন কিন্তু থেমে যাবেন না। জগিং দিয়ে শুরু করে পরে তারপর না হয় ম্যারাথনের কথা ভাবুন। মিস ওয়েনস্টেইন বলছেন, ‘বাস্তব জীবনে পরিবর্তন আসে ধীরে ধীরে।’ আপনাকে শুরু করতে হবে ধীরে। তারপর আস্তে আস্তে সংকল্পের পারদ চড়াতে হবে।
৪। নিজের নেটওয়ার্ক গড়ে তুলোন: নিজের মাঝে সামাজিকীকরণ ও ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স দক্ষতা অর্জন করতে, সময়ের ফিচারগুলো ধারণ করতে সরব থাকুন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে। নিজের মনের চিন্তাগুলোকে সাজিয়ে প্রকাশ করুন, বস্তুনির্ভর উপাত্ত শেয়ার করুন, বাড়ান আপনার নেটওয়ার্ক। নিয়মিত মেইল চেক করুন, ফেসবুক – লিংকডইনে উঁকি দিন, মাসে অন্তত একবার পরিচিত পেশাজীবীদের সঙ্গে আলাপচারিতায় ব্যস্ত সময় কাটান, সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবামূলক সংগঠনে নিজেকে যুক্ত করুন; দেখবেন অচিরেই নিজের একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক তৈরি হয়ে গেছে, হয়ে গিয়েছে যুগোপযোগী স্কিলগুলো অর্জন।
৫। জীবনবৃত্তান্ত আপডেট রাখুন: আপনি যদি কোনো বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান, উন্নয়ন সংস্থা ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান কিংবা সরকারি চাকরি পেতে চান, প্রস্তুতি শুরু করুন এখনই। প্রয়োজনীয় তথ্য ও নিত্য অর্জিত দক্ষতা দিয়ে হালনাগাদ করে নতুনভাবে সাজান জীবনবৃত্তান্ত। আপনি যদি অন্য কোনো চাকরিতে কর্মরত থাকেন সেখান থেকেই দৃঢ় দৃষ্টি রাখুন কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যের দিকে, নিত্য চোখ রাখুন জব সাইটগুলোতে।
৬। আইডিয়া শেয়ার করুন: আপনার বন্ধু বা কলীগদের মধ্য থেকে এমন কাউকে বেছে নিন, যার সঙ্গে আপনার ভাবনা বা পরিকল্পনার মিল খুঁজে পান। নিজেদের ভাবনা-নতুন আইডিয়া আদান-প্রদান করুন।
ব্রিটেনের ওয়ারইক বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের অধ্যাপক ড. জন মাইকেল বলছেন, ‘আপনার সংকল্প সফল হলে অন্যের মঙ্গল হতে পারে, ব্যর্থ হলে অন্যের ক্ষতি হতে পারে – এমন পরিস্থিতি মানুষকে বিশেষভাবে উদ্বুদ্ধ করে। সুতরাং আপনার সংকল্প বাস্তবায়নে অন্যদের যুক্ত করুন, তাদের সাহায্য নিন।’ এমনকি মাঝেমধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রফেশনাল-উদ্যোক্তা গ্রæপগুলোতে আপনার আইডিয়া শেয়ার করুন। এতে লজ্জা পাওয়া কিংবা দ্বিধায় থাকার কিছু নেই, বরং নানাজনের মন্তব্য আপনার নিজেকে যাচাই করতে সহজ করে দিবে। এই ধনাত্মক – ঋণাত্মক পরামর্শ যেমন আপনাকে সঠিক পথ দেখাবে, বাড়াবে আত্ম প্রণোদনা, তেমনি কাজের অগ্রগতিতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে।
৭। অনাহুত সমস্যা মাথায় রেখে প্রস্তুত থাকুন: নিত্যদিনের জীবনে অল্প কিছু পরিবর্তন আনার চেষ্টা করুন, যখন লক্ষ্য অর্জন কঠিন মনে হয়, ঠান্ডা মাথায় পরিস্থিতিকে বিশ্লেষণ করতে হবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী সহজেই সব কাজ হয়ে যাবে এমন ভাবার দরকার নেই। যেকোনো কাজে বাধা আসতেই পারে, তাই সবসময় মনোবল শক্ত রাখতে হবে। কী ধরনের সমস্যার মুখোমুখি আপনাকে হতে হচ্ছে? কোন কৌশল সবচেয়ে কার্যকর? কোন কৌশল কাজে লাগছে না? বিশ্লেষণের পর আপনাকে বাস্তবমুখী পথ নিতে হবে। স্বল্প অর্জনকেও দাম দিতে হবে। তাই প্রতিদিনের জীবনযাপনে আত্ম বিশ্লেষণমূলক সামান্য অদল-বদলও অনেক সাফল্য বয়ে আনতে পারে।
৮। নিজেকে পুরস্কৃত করুন: কাজের অগ্রগতির মাত্রা কিংবা ছোটখাটো সাফল্যেই নিজেকে পুরস্কৃত করুন, উৎসাহিত করুন। ধরুন আপনার এ সপ্তাহের গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা সফলভাবে শেষ হলো, ভালো কোন রেস্তোরায় গিয়ে ভালো কিছু খান, নিজের জন্য কিছু উপহার কিনুন কিংবা আপনার আজকের সাফল্যটা অন্যদের সাথে হাস্যোজ্জ্বল মুখে শেয়ার করুন। এতে আপনার চিন্তাজগত রিফ্রেশ থাকবে, বাড়বে আত্মবিশ্বাস। সময়ের সাথে নিজেকে হালনাগাদের মাধ্যমে পূরণ হোক আপনার মিশন ও ভিশন টুয়েন্টি টুয়েন্টি, ২০২০ টা হোক আপনার।
লেখক : উদ্যোক্তা ও ই-এক্টিভিস্ট