যানজটে নাকাল নগরবাসী

17

মনিরুল ইসলাম মুন্না

রমজান আসার আগে এবং রোজা শুরু হওয়ার পর নগরীতে যানজট পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। প্রতিদিন নগরীর বিভিন্ন স্পটে যানজট লেগে থাকে। যানজটের কারণে বিমানের যাত্রী, অ্যাম্বুলেন্সের রোগী, শিক্ষার্থী, চাকরিজীবীসহ সাধারণ মানুষ চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন।
এদিকে রমজানে মার্কেটগুলোর পার্কিংয়ে টাকার বিনিময়ে গাড়ি রাখতে হচ্ছে বলে অনেক ক্রেতা মূল সড়কে গাড়ি পার্কিং করচ্ছেন। ফলে যানজট দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। গত এক সপ্তাহ ধরে নগরীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে যানজটের এমন পরিস্থিতি দেখা গেছে।
তবে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) মাসুদ আহাম্মদ পূর্বদেশকে বলেন, পবিত্র রমজান মাস উপলক্ষে ট্রাফিক বিভাগের পক্ষ থেকে নানা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। ইফতারের পূর্বে যানজট এড়াতে আমাদের অতিরিক্ত ফোর্স হিসেবে স্পেশাল টিম থাকবে। মার্কেটের সামনে যাতে পার্কিং করতে না পারে, সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মার্কেট কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।
সরেজমিন দেখা গেছে, অপরিকল্পিত বাসস্ট্যান্ডের কারণে নগরীর চার প্রবেশমুখ কার্যত অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে। নগরীর অক্সিজেন মোড়, শাহ আমানত সেতু চত্বর, কাপ্তাই রাস্তার মাথা এবং সিটি গেট-কর্নেল হাটে যাত্রীদের সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। বেশিরভাগ সড়কের দুই পাশের ফুটপাত দখল করে চলছে ব্যবসা-বাণিজ্য। যদিও ইতোমধ্যে সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে বেশ কয়েকটি ফুটপাত দখলমুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু তার এক-দুইদিন পর আবার দখল হয়ে যায়। যত্রতত্র যানবাহন দাঁড়িয়ে থেকে যাত্রী ওঠা-নামা করানোর কারণে প্রতিটি মোড়েই বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে। নগরীর অভ্যন্তরে দিনে ট্রাক, কাভার্ডভ্যানসহ অন্যান্য মালবাহী যানবাহন চলাচল এবং অবৈধ পার্কিং-এর ফলে যানজট সৃষ্টির পাশাপাশি জনসাধারণের স্বাভাবিক চলাচলে বিঘœ সৃষ্টি হচ্ছে। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণ কাজের ফলে জিইসি থেকে টাইগারপাস মোড় পর্যন্ত রাস্তা সরু হয়ে যায়। এতে যানবাহনসমূহের গতি একেবারেই কমে যায়।
বহদ্দারহাট থেকে আগ্রাবাদগামী যাত্রী মোকসেদুল ইসলাম বলেন, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণ কাজের জন্য যে জটটা লাগে সেটা মুরাদপুর পর্যন্ত চলে আসে। এ জ্যামের কারণে অফিসে যেতে প্রায় আধাঘণ্টা দেরি হয়ে যায়। তাছাড়া লোকাল বাসগুলোর অসুস্থ প্রতিযোগিতা ও রাস্তার মাঝখানে যাত্রী উঠানামার ফলে যানজট আরও বেড়ে যায়।
এদিকে নগরীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে যানজট নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হলেও বিমানবন্দর সড়কে যানজট পরিস্থিতি সবচেয়ে মারাত্মক। বিমান ধরার জন্য কয়েক ঘণ্টা আগে যাত্রা শুরু করেও যানজটের কারণে অনেকে ফ্লাইট মিস করেন। এর বিকল্প মাধ্যম হিসেবে উত্তর চট্টগ্রামের অনেক মানুষ আউটার রিং রোড ব্যবহার করেন আবার দক্ষিণ চট্টগ্রামের মানুষ মইজ্জারটেক হয়ে ১৫নং ঘাট দিয়ে সরাসরি বিমানবন্দরে চলে যান।
বন্দরের আমদানি-রপ্তানি পণ্যের কন্টেইনার পরিবহনে নিয়োজিত কার্গো, লরিগুলো (প্রাইমমুভার) প্রধান সড়কের দুই পাশে পার্কিং টার্মিনাল হিসেবে ব্যবহার করছে। এছাড়া বন্দরের ভেতরে ঢোকার জন্য অপেক্ষমাণ ট্রাক-কাভার্ডভ্যানের সারিও যানজটের অন্যতম কারণ। ব্যস্ততম এ সড়কের আশপাশের বেসরকারি কন্টেইনার ডিপোগুলো যানবাহন নিয়ন্ত্রণে অব্যবস্থাপনার পরিচয় দিচ্ছে, যা সড়কে যানজট বাড়াচ্ছে।
রমজানের চাপ সামলাতে টেরিবাজারের সড়কটি বন্ধ করে দেয় সমিতি ও ট্রাফিক বিভাগ। এতে লালদীঘি পূর্বপাড়ের জেল রোড হয়ে আনসার ক্লাব থেকে কোরবানিগঞ্জ ও খাতুনগঞ্জের অনেক মালবাহী ট্রাক ১৫ থেকে ২০ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকার পরও পণ্য খালাস করতে না পারায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন ভুক্তভোগীরা। ট্রাক চালকরা বলছেন, আমরা ২৪ ঘণ্টা পার হলেও এখনও কাক্সিক্ষত গন্তব্যে পৌঁছাতে না পারায় পণ্য আনলোড করতে পারছি না।
স্থানীয়রা বলছেন, রাস্তায় সারিবদ্ধ ট্রাক দাঁড়িয়ে থাকার কারণে আমাদের চলাচলে অসুবিধা হচ্ছে। এ সড়কের জ্যামের প্রভাবটা আশেপাশের কয়েকটি সড়কে গিয়ে পড়েছে।
বাকলিয়া এক্সেস রোড নামে পরিচিত জানে আলম দোভাষ সড়কের প্রবেশমুখে (চন্দনপুরা অংশে) প্রতিদিন সৃষ্টি হচ্ছে যানজট। এতে দুর্ভোগ বাড়ছে গাড়িচালক ও যাত্রীদের। গতকাল বিকেলে এক্সেস রোডের মুখে তৈরি হওয়া যানজট গিয়ে ঠেকেছে প্যারেড কর্নার (চট্টগ্রাম কলেজের পূর্ব গেট)। অপরপাশের যানজট দেওয়ান বাজার পর্যন্ত গিয়ে ঠেকে। এসময় থেমে থেমে চলে বিভিন্ন গাড়ি। এ সড়কে শাহ আমানত সংযোগ সড়ক হয়ে আসা গাড়িগুলো নির্দিষ্ট দিকে না গিয়ে গাড়ি প্রবেশের রাস্তারে দিকে ঢুকিয়ে দিচ্ছে যে যার মতো। ফলে প্রবেশ ও বের হওয়ার গাড়ি একসঙ্গে আটক পড়ছে এক স্থানে। এছাড়া রাস্তার দুপাশে রয়েছে অবৈধ ব্যাটারি রিকশার স্ট্যান্ড এবং বিভিন্ন ভাসমান দোকান ও ভ্যানগাড়ি। ফলে রাস্তা সংকুচিত হয়ে গাড়ি প্রবেশ ও বের হতে পথে পেতে হচ্ছে বেগ। তৈরি হচ্ছে যানজট।
যাত্রীদের অভিযোগ, যানজটের কারণে প্রতিদিন গাড়ি সংকট তৈরি হচ্ছে। অনেক গণপরিবহন নির্দিষ্ট গন্তব্য পর্যন্ত যেতে চাই না। গাড়ি ঘুরিয়ে পুনরায় একই পথে চলে যায়। আবার অনেক চালক যানজটের অজুহাতে ১০ টাকার ভাড়া ৩০ টাকা দাবি করে। নিরূপায় হয়ে দিতে হয়।
আবার নগরীর বিলাসবহুল মার্কেটগুলোতে (নাসিরাবাদের আফমি প্লাজা, মিমি সুপার, চকবাজারের গুলজার টাওয়ার, বালি আর্কেড, সুবসতি সৈয়দ সেন্টার, মতি টাওয়ার, মতি কমপ্লেক্স, সিডিএ এভিনিউ’র ইউনেস্কো সিটি সেন্টার, চট্টগ্রাম শপিং কমপ্লেক্স, সানমার ওশান সিটি, সেন্ট্রাল প্লাজা, আমিন সেন্টার, রিয়াজউদ্দিন বাজারের গোলাম রসুল মার্কেট, শাহ আমানত মার্কেট, বিপণী বিতান, আগ্রাবাদের সিঙ্গাপুর ব্যাংকক মার্কেট, আকতারুজ্জামান সেন্টার, ইপিজেড বে শপিং, অলংকার শপিং ইত্যাদি) পার্কিং ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু তার সবই পে পার্কিং। এসব মার্কেটের নিচে পার্কিং ব্যবস্থা রাখা হলেও সেখানে বিনামূল্যে ক্রেতাদের গাড়ি রাখতে দেয়া হয় না। প্রতিটি পার্কিং ভাড়া ঘণ্টাপ্রতি ৩০ টাকা ৫০ টাকা পর্যন্ত। আবার সময় ও গাড়িভেদে পার্কিং ভাড়া আরও বেশিও হয়ে থাকে। আর পার্কিংয়ের টাকা দিতে হয় বিধায় অনেক গাড়ি চালক মূল সড়কে পার্কিং করে থাকেন। এতে যানজট তৈরি হয়।
এদিকে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে নগরীতে দিনে ভারী যানবাহন চলাচল বন্ধ রাখার নির্দেশনা রয়েছে। এতে প্রতিদিন সকাল আটটা হতে রাত আটটা পর্যন্ত পণ্যবাহী ট্রাক, কাভার্ডভ্যান, লং-ভেহিকেল, প্রাইমমুভারসহ অন্যান্য পণ্য ও মালবাহী যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হবে। রাত আটটার পর পণ্যবাহী যানবাহন চলাচল ও মালামাল ওঠা-নামা করানো যাবে। তবে জরুরি আমদানিকৃত খাদ্যদ্রব্য, পণ্য ও রপ্তানিযোগ্য গার্মেন্টস পণ্য বিশেষ ব্যবস্থায় চলাচল করতে পারবে।
সিএমপি’র অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) মাসুদ আহাম্মদ আরও বলেন, ‘আমরা ট্রাফিক ব্যবস্থাকে শৃঙ্খলায় ফিরিয়ে আনতে দিনরাত কাজ করে যাচ্ছি। ফিটনেসবিহীন যানবাহন, অবৈধ ব্যাটারি রিকশা, সিএনজি ট্যাক্সি, ড্রাইভিং অবস্থায় সিটবেল্ট না পড়া, হেলমেটবিহীন মোটরসাইকেলসহ নানা অনিয়মের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। রমজান ও ঈদে যাতে যানজট যাতে না হয়, সেদিকে আমরা বিশেষ নজর রাখছি। যানজট সহনশীল করার জন্য ফুটপাত উচ্ছেদে আমাদের পক্ষ সিটি কর্পোরেশনকে সহযোগিতা করা হচ্ছে। মূল সড়কের উপর যেন কোন হকার বসতে না পারে সেক্ষেত্রে সিটি কর্পোরেশনও আমাদের সহায়তা করছে। সর্বোপরি আমাদের পক্ষ থেকে নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছি। এখানে শুধু আমরা কাজ করলে হবে না, নগরবাসীরও সহযোগিতা করতে হবে। তবেই সুষ্ঠু ট্রাফিক ব্যবস্থা ফিরিয়ে আসবে।