যাকে ফোন করেছেন তিনি ঋণখেলাপী

33

চীনের নাগরিকদেরকে পয়েন্টের ভিত্তিতে ভাল-মন্দের এক তালিকায় ওঠানোর ব্যাপক কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছে দেশ জুড়ে। সেদেশের বিশালসংখ্যক জনগণকে তাদের কাজকর্ম, আচার আচরণের ভিত্তিতে পয়েন্ট দেয়া হচ্ছে এবং সেই পয়েন্ট নথিভুক্ত হচ্ছে কম্পিউটারের বিশাল তথ্য ভান্ডারে।
কর্মকর্তারা বলছেন, যারা বেশি পয়েন্ট পাবেন তাদের জন্যে সমাজের বিভিন্ন স্তরে ভাল সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা রাখা হচ্ছে। আর যারা আইন ভাঙবেন, নিয়ম মেনে চলবেন না, তাদেরকে নানা ভোগান্তির মুখে পড়তে হবে।
চীনে যেভাবে উচ্চ প্রযুক্তির সঙ্গে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের মেলবন্ধন ঘটানো হয়েছে তা নজিরবিহীন। নাগরিকদের কাছ থেকে সরকার বিপুল পরিমাণ তথ্য সংগ্রহের যে উদ্যোগ নিয়েছে তা নিয়ে উদ্বেগ সমালোচনাও থেমে নেই।
বিবিসির সংবাদদাতা জন সাডওয়ার্থ গিয়েছিলেন দেশটির পূর্বাঞ্চলের রংচাং শহরে যেখানে এই সামাজিক পয়েন্ট ব্যবস্থার কাজ চলছে রীতিমত জোরেসোরে। তিনি বলছেন, সরকারি ভবনে মানুষ প্রতিদিন ভিড় জমাচ্ছেন তাদের ব্যক্তিগত স্কোর জানার জন্য।
প্রত্যেক নাগরিক শুরু করছেন এক হাজার পয়েন্ট নিয়ে – যেটি এ রেটিং হিসাবে নথিভুক্ত হচ্ছে। এরপর ভাল কাজ করলে কেউ তার পয়েন্ট দ্বিগুণ-তিনগুণ বাড়িয়ে নিতে পারেন। তখন তার রেটিং গিয়ে দাঁড়াবে ডাবল এ, বা ট্রিপল এ তে। আর মন্দ কাজ করলে পয়েন্ট নামতে নামতে ডি-রেটিংয়ে গিয়ে পৌঁছবে।
যেমন এক নাগরিক নিজের পাড়ায় সেবামূলক কাজ করে, গরীবদের সাহায্য করে, বরফ খুঁড়ে অসমর্থ প্রতিবেশির রাস্তা সাফ করে দিয়ে বাড়তি ৬৫ পয়েন্ট পেয়েছেন। এখন তার পয়েন্ট ১০৬৫। কিন্তু এই বাড়তি পয়েন্ট তার কী কাজে লাগবে? তিনি বলছেন, এই বাড়তি পয়েন্টের সুবাদে তিনি এখন বিনাখরচে চিকিৎসা সেবা পেতে পারবেন।
তাহলে মন্দ কাজ কোনগুলো যার জন্য পয়েন্ট কাটা যাবে? প্রশাসন বলছে, মূলত আইন ভাঙলে নাগরিকরা পয়েন্ট হারাবেন। কিন্তু কোনো কোনো জায়গায় এর পরিধি আরও বাড়ানো হয়েছে।
যেমন এক গ্রামবাসী দং জিয়াওপিং তার বাড়ির উঠানে ঝাড়ু দিতে দিতে বললেন, আমার ঘরের উঠান পরিষ্কার না রাখার জন্য আমার দুপয়েন্ট কেটে নেয়া হয়েছে। তবে এটা আমারই দোষ, আমি ভালভাবে উঠান পরিষ্কার করিনি। এটা খুবই লজ্জার।
দং জিয়াওপিং ক্ষুব্ধ নন – বরং লজ্জিত। কিন্তু নেতিবাচক স্কোরের পরিণাম বেশ খারাপ হতে পারে। এর ফলে তার ব্যাংক ঋণ পাওয়া বন্ধ হতে পারে। কোনো কোনো চাকরির জন্য তার আবেদন করার পথও বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
চীনের অন্যত্র ডিজিটাল মাধ্যমে মানুষকে লজ্জা দেওয়ার প্রক্রিয়াও পরীক্ষামূলকভাবে চালু করা হয়েছে। ঋণখেলাপীদের বাধ্য করা হচ্ছে তাদের মোবাইল ফোনে বিশেষ রিংটোন বসানোর জন্য। ওই রিংটোনে বলা হচ্ছে, আপনি যাকে ফোন করেছেন সে ঋণখেলাপী -তাকে বলুন আইন মানতে- ঋণ শোধ করতে।
চীনের নতুন এই সামাজিক পয়েন্ট ব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্য সামাজিক মূল্যবোধের ওপর আস্থা ফিরিয়ে আনা। আইন ভাঙা বা নিয়ম অগ্রাহ্য করার পরিণতিকে সামাজিক স্তরে নিয়ে যাওয়া।
রংচাং-এ মাছের এক রেস্তোরাঁর ম্যানেজার চাং সিয়া হাও বলছেন, পর্যবেক্ষকরা যখন তার রেস্তোরাঁ পরিদর্শন করতে আসেন তখন তারা দেখতে চান রান্না করা খাবার আর কাঁচা খাবার আলাদাভাবে রাখা হচ্ছে কিনা । এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা ভাল পয়েন্ট স্কোর করলে ভবিষ্যতে আমি যদি নতুন রেস্তোরাঁ খুলতে চাই, সেটা সহজ হয়ে যাবে, বলেন তিনি।
চীনে একদলীয় শাসনব্যবস্থায় ক্রেতা ও ভোক্তাদের আস্থা খুব কম। সবকিছুই কমিউনিস্ট পার্টির নিয়ন্ত্রণে।
সরকারি দপ্তরের বাইরে সাধারণ এক নাগরিক লিও চুনচান বললেন, তার রেটিং যে খুব একটা বাড়বে তা তিনি আশা করেন না। সাধারণ নাগরিকের জন্য এ রেটিং বাড়ানো প্রায় অসম্ভব। এটা সম্ভব একমাত্র কম্যুনিস্ট পার্টির সদস্যদের জন্য, বলেন তিনি।
সামাজিক এই পয়েন্ট ব্যবস্থা চীনের বিভিন্ন শহরে চালু হলেও এখনও তা অনেকটা পরীক্ষা নিরীক্ষার পর্যায়ে রয়েছে।
অনেক সমালোচক বলছেন, এই প্রকল্প পরিচালনা একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ, তার ওপর রয়েছে দেশের প্রতিটি মানুষের আচার আচরণের সব তথ্য সরকারি ভান্ডারে নথিভুক্ত হয়ে যাওয়ার বিষয়টি। এখানে ব্যক্তি স্বাধীনতা খর্ব হবার বড় ধরনের আশঙ্কা রয়েছে।
এসব মোকাবেলা করে ২০২০ সালের মধ্যে দেশটির ১৩০ কোটি মানুষের জন্য এটা জাতীয় প্রকল্পে রূপ দেয়া কতটা সম্ভব হবে তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। কারণ এই প্রকল্প সফল করতে গেলে প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি সরকারকে ভাবতে হবে ক্ষমতায় টিঁকে থাকার লড়াইয়ে এ প্রকল্প ভবিষ্যতে কী ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে।