যদি এ যাত্রায় বেঁচে যাই…

47

সনেট দেব

ছোট এক স্কুলপড়–য়া বালককে প্রশ্ন করেছিলাম। আচ্ছা এক বছরে কয় মাস। উত্তরে হেসে সে বললো চার (৪) টা মাস। অনেকটা অবাক চোখে বললাম আমি, কি বলো? কিভাবে। আবারও একগাল হাসি দিয়ে বালকটি বললো, সাধারণত বছরে বারোটি (১২) মাস হয়। কিন্তু এবছর ৪ টি মাস। বিস্ময়ের সাথে জানতে চাইলাম মাস গুলোর নাম। সেও অনেক আগ্রহ নিয়ে মাসের নামগুলো বললো- জানুয়ারি, ফেব্রæয়ারি, লকডাউন, ডিসেম্বর। উত্তর শুনে নিজেই হাসি চেপে রাখতে পারলাম না। কি এক অশুভ দিন কাটছে আমাদের। পৃথিবী সুস্থ হওয়ার কোন নাম গন্ধ নেই। বরং দিনে পর দিন পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ থেকে ভয়াবহতর হচ্ছে। মুখে নেই মাস্ক, স্বাস্থ্যবিধির দুই পয়সার বালায় নেই। যে যার মত করেই চলছে। সচেতনতামূলক কথা বলতে গেলেই তেড়ে এসে জনগণ বলছে- আমার পরিবারকে কি আপনি খাওয়াবেন? বাহিরে হাজার হাজার মানুষ। যে যার মত করে ঘুরছে-ফিরছে-খাচ্ছে। হাসপাতালের তিল ফেলার জায়গা নেই। চোখ বন্ধ করলেই ভাবি, এই যাত্রায় কি বাঁচতে পারবো?
গত ২৫ নভেম্বরের সর্বশেষ আপডেট অনুসারে ২৪ ঘন্টায় নতুন আক্রান্তের সংখ্যা ২ হাজার ১৫৬ জন, সর্বমোট ৪ লক্ষ ৫৪ হাজার ১৪৬ জন। মৃত্যুবরণ করেছেন ৩৯ জন, সর্বমোট ৬ হাজার ৪৮৭ জন। সুস্থ হয়েছে ২ হাজার ৩০১ জন, সর্বমোট ৩ লক্ষ ৬৯ হাজার ১৩৯ জন। পরীক্ষা করেছে ১৬ হাজার ১ জন, সর্বমোট ২৬ লক্ষ ৯৬ হাজার ১৫০ জন। এটা বাংলাদেশের চিত্র। বিশ্বব্যাপী এ চিত্র আরো ভয়াবহ। বিশ্বে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৫ কোটি ৯৮ লক্ষ ২৭ হাজার ৫১২ জন। আর মোট মৃত্যুর সংখ্যা ১৪ লক্ষ ১০ হাজার ৪৫৮ জন। পরিসংখ্যান অনুসারে দেখা যাচ্ছে এ হার ধীরে ধীরে আবার বাড়ছে। ধরে নিতে পারি আমরা করোনার ২য় ঢেউয়ে পা দিলাম। দেশের বর্তমান পরিস্থিতি দেখলে বুঝার কোন উপায় নেই যে, করোনা নামক কিছু এ দেশে আছে। স্কুল-কলেজ ছাড়া বাকি সব স্বাভাবিক নিয়মেই চলছে। চলছে সামাজিক অনুষ্ঠান থেকে শুধু করে সব রকমের কার্যক্রম। যদিও এসব অনুষ্ঠান পরিচালনার আগে স্বাস্থবিধি মেনে চলার প্রতিশ্রুতি দিলেও বাস্তাবে তার সামান্য ভাগও পালন করা হয় না। তাহলে ২য় ঢেউ সামাল দিতে আমাদের আবার লকডাউনে যেতে হবে? কিন্তু লকডাউনও বা কতটুকু যুক্তিযুক্ত সেটাও ভাবার বিষয়। কেননা আমাদের দেশ কানাডা নয় যে, দেশের প্রতিটা মানুষের দরজায় দরজায় দুই মাসের নিত্য প্রয়োজনিয় দ্রব্যসামগ্রী পৌঁছে দেয়ার প্রতিশ্রæতি দিয়ে দুই মাসের লকডাউন ঘোষণা করতে পারবে। আমাদের দেশে অধিংকাশ মানুষই মধ্যবিত্ত। গেলো লকডাউনে তাদের যে পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে এবং গোটা দেশের যে পরিমান অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে তা হয়তো আগামী ১৫ বছরেও পূরণ করা যাবে না। এখন আবারও যদি নতুন করে লকডাউনের মত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় তাহলে অর্থনীতি আরো ভেঙে পড়বে। কিন্তু সমাধানেও তো যেতে হবে! তাহলে করোনার ২য় ঢেউ মোকাবেলায় সমাধান কি হতে পারে? ইতোপূর্বে আসন্ন শীতে করোনা পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞরা। এছাড়া সারা বিশ্বের বিশেষজ্ঞরা পূর্বাভাস দিয়ে আসছেন যে, শীতকালে করোনা সংক্রমণ আরও বাড়বে। করোনার সেকেন্ড ওয়েভ বা দ্বিতীয় ঢেউ প্রথম ঢেউয়ের চেয়েও ভয়াবহ হতে পারে বলে মনে করছেন তারা। কোনো কোনো শীতপ্রধান দেশে ইতোমধ্যেই দ্বিতীয় ঢেউ দেখা দিয়েছে এবং সেসব দেশে করোনার সংক্রমণ ও মৃত্যুর হারও বেড়েছে। এমতাবস্থায় দেশে আসন্ন শীত সামনে রেখে করোনা মোকাবেলায় জোরালো প্রস্তুতি নিতে হবে আমাদের। নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে দেশে শীতের প্রকোপ বাড়তে শুরু করেছে। আর এ সময়টিতেই দেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ যাত্রাও শুরু করেছে। উদ্বেগের বিষয় হল, করোনার স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিষয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা খুবই কম। শুরুর দিকে মানুষ কিছুটা সতর্ক হলেও এখন মাস্ক পরা, শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা ইত্যাদি ব্যাপারে চরম উদাসীনতা লক্ষ করা যাচ্ছে অনেকের মধ্যে। একটা বিষয় মাথায় রাখতে হবে যে, করোনা মোকাবেলায় মাস্ক পরা জরুরি বটে; সেই সঙ্গে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখারও দরকার।
আমি মনে করি আপনি যদি এই যাত্রায় বেঁচে যান। তবে কথা দিতে পারি আরো অনেক বছর বাঁচবেন। আর অবহেলা নয়। চোখের সামনে কত আপন জনের মৃত্যু দেখেছেন, আর কত দেখবেন? ভ্যাকসিন আবিষ্কার হয়েছে সত্য, কিন্তু সেই ভ্যাকসিন আমাদের পুশ করতে করতে এদেশ মৃত্যুপুরীতে রূপ নিবে। কারণ সামনের দিনগুলো আরো ভয়াবহ থেকে ভয়াবহতর হয়ে উঠবে। এখনো সময় আছে সচেতন হওয়ার। মনে করে মাক্স পড়ুন। অবশ্যই নাক-মুখ ডেকে। কারণ অনেকে মাস্ককে নানা রকমের ফ্যাশনের মত ব্যবহার করে। কেউ নাকের নিচে, কেউ মুখের নিচে, কেউ এক কানে ঝুলিয়ে। ভাবখানা এমন যে, মাস্ক একটা আছে তো, কিন্তু এর ব্যবহার যেমন হবে হোক। মাস্ক এর পাশাপাশি একে অপরের সাথে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখাটাও বেশ জরুরি। মনে রাখবেন, আপনি যদি বাঁচেন তবে আপনার পরিবার বাঁচবে। আপনার পরিবার বাঁচলে আপনার সমাজ বাঁচবে। আপনার সমাজ বাঁচলে আমার দেশ বাঁচবে। এখানে প্রতিটা মানুষ কোন না কোন ভাবে চক্রাকার সম্পর্কে আবদ্ধিত। সুতরাং এখনি সচেতন হোন।
একটা বিষয় সবার মনে রাখতে হবে এ করোনা যুদ্ধে সবচেয়ে বড় বীরত্ব হবে, বেঁচে থাকতে পারাটা। অনেকে মনে করছে আমার তো জ¦র হয়নি, সর্দি হয়নি কিংবা আমার কোন গলা ব্যাথা, কাঁশি নেই। সুতরাং আমার করোনা হয় নি। এমন ভেবে স্বাস্থ্যবিধি না মেনে আরামে এদিন সেদিক ঘুরতে থাকলে হবে সবচেয়ে বোকামি। বিজ্ঞানীরা বলেছেন, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের একটি বিরাট অংশ (ক্ষেত্রভেদে প্রায় ৬০ শতাংশ বা তারও বেশি) কোনো উপসর্গই প্রকাশ করে না এবং নীরবে ও নিজের অজান্তে রোগটি ছড়তে থাকে। সুতরাং সময় হাতে খুব কম। সরকারের প্রতি বিনীত অনুরোধ থাকবে, ভ্যাকসিন এর ব্যাপক ব্যবহার নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত রাস্তাঘাট, বাজার, কর্মক্ষেত্র ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সব পাবলিক প্লেসে সবাইকে বাধ্যতামূলকভাবে মাস্ক ব্যবহারসহ করোনাসংক্রান্ত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ওপর জোর দিতে হবে। প্রয়োজনে কঠোর আইনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে। না হয় আগামীর বাংলাদেশ হয়তো ইতালীর রূপ নিবে।

লেখক: সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক