ম্যাগনাকাটা খ্যাত বাঙালির মুক্তির সনদ ঐতিহাসিক ছয় দফা

113

এড. সালাহ্উদ্দিন আহমদ চৌধুরী লিপু

বাংলার গণমানুষের স্বাধিকার আন্দোলনের দাবি সম্বলিত বাঙালির ‘ম্যাগনাকাটা’ খ্যাত ঐতিহাসিক ছয় দফা। বাংলাদেশ অভ্যুদয়ের পথে বলিষ্ট ভূমিকা রাখার কারণে ছয় দফাকে বাংলাদেশের ‘ম্যাগনাকাটা’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। তাই ছয় দফাকে ইংল্যান্ডের ‘রাজা জন’ কতৃক স্বীকৃত ‘ম্যাগনাকাটা’র সাথে তুলনা করা হয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে ঐতিহাসিক ছয় দফার গুরুত্ব অপরিসীম। বাঙালি জাতির মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে এক অনন্য প্রতিবাদী আত্মত্যাগের ভাস্বর গৌরবোজ্জ্বল একটি দিন ৭জুন। স্বাধীনতার পথে বাঙালির হাজার বছরের সংগ্রামী ইতিহাসের এক মাইলফলক। ছয় দফা বাঙালির মুক্তির সনদ। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠির দুঃশাসন, অত্যাচার, বৈষম্য, অন্যায় ও শোষণের বিরুদ্ধে বাঙালির প্রতিবাদ ধীরে ধীরে দৃপ্ত পদক্ষেপে স্বাধীকার আন্দোলনের পথে অগ্রসর হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় ছয় দফার মাধ্যমে বাংলার মাটিতে স্বাধীনতার বীজ বপন হয়। সে থেকেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার বীজ অঙ্কুরিত হয়। ফলে এর মাধ্যমে বাঙালির স্বাধীকার ও স্বাধীনতা সংগ্রামে রূপ নেয়।
পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের পর পাকিস্তানের পরিস্থিতি আলোচনা ও একটি জাতীয় সরকার গঠনের দাবিতে পশ্চিম পাকিস্তানের বিরোধীদলীয় রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃবৃন্দের উদ্যোগে ১৯৬৬ সালের ৫ ও ৬ ফেব্রæয়ারি পাকিস্তানের লাহোরে নিখিল পাকিস্তান জাতীয় কনভেনশন ডাকা হয়। বঙ্গবন্ধুর শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১০ সদস্যের আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি দল সে কনভেনশনে যোগ দেন। ৫ ফেব্রæয়ারি নেজামে ইসলামী দলের প্রধান চৌধুরী মোহাম্মদ আলীর বাসভবনে অনুষ্ঠিত জাতীয় কনভেনশনে আওয়ামীলীগের পক্ষ থেকে এবং দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তানে স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ছয় দফা দাবি উত্থাপন করেন এবং তা সভার আলোচ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করেন, কিন্তু উক্ত কনভেনশনের সভাপতি চৌধুরী মোহাম্মদ আলী এ দাবির বিষয়ে অস্বীকৃতি জানালে বঙ্গবন্ধু ১১ ফেব্রæয়ারি লাহোর কনভেনশন থেকে ফেরার পর ঢাকা বিমানবন্দরে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে ছয় দফার ব্যাখ্যা দেন। ছয় দফার বিবৃত দাবিসমূহ- প্রথম দফা : সরকারের বৈশিষ্ট্য হবে ফেডারেল বা যৌথ রাষ্ট্রীয় ও সংসদীয় পদ্ধতির, তাতে যৌথ রাষ্ট্রের অঙ্গ রাজ্যগুলো থেকে কেন্দ্রিয় ব্যবস্থাপক সভার নির্বাচন হবে প্রত্যক্ষ ও সার্বজনীন প্রাপ্ত বয়স্ক ভোটাধিকারের ভিত্তিতে ও কেন্দ্রিয় ব্যবস্থাপক সভার প্রতিনিধি নির্বাচন হবে জনসংখ্যার ভিত্তিতে। দ্বিতীয় দফা : কেন্দ্রীয় সরকারের দায়িত্ব থাকবে কেবল প্রতিরক্ষা ও বৈদেশিক বিষয় এবং তৃতীয় দফায় ব্যবস্থিত শর্ত সাপেক্ষ বিষয়। তৃতীয় দফা : পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য দুটি পৃথক মুদ্রা ব্যবস্থা চালু করতে হবে, যা পারস্পরিক কিংবা অবাধে উভয় অঞ্চলে বিনিময় করা চলবে। অথবা এর বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে একটি মুদ্রা ব্যবস্থা চালু থাকতে পারে এই শর্তে যে, একটি কেন্দ্রিয় সংরক্ষণ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা কররতে হবে, যার অধীনে দুই অঞ্চলে দুটি রিজার্ভ ব্যাংক থাকবে। তাতে এমন বিধান থাকতে হবে যেন এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে সম্পদ হস্তান্তর কিংবা মূলধন পাচার হতে না পারে। চতুর্থ দফা : রাজস্ব ধার্য ও আদায়ের ক্ষমতা থাকবে অঙ্গরাজ্যগুলোর হাতে। প্রতিরক্ষা ও বৈদেশিক বিষয়ের ব্যয় নির্বাহের জন্য কেন্দ্রিয় সরকারকে প্রয়োজনীয় রাজস্বের যোগান দেয়া হবে। সংবিধানে নির্দেশিত বিধানের বলে রাজস্বের এই নির্ধারিত অংশ স্বাভাবিক ভাবেই কেন্দ্রিয় সরকারের হাতে জমা হয়ে যাবে। এহেন সাংবিধানিক বিধানে এমন নিশ্চয়তা থাকবে যে, কেন্দ্রিয় সরকারের রাজস্বের প্রয়োজন মেটানোর এমন একটি লক্ষ্যের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হতে হবে যেন রাজনীতির উপর নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা নিশ্চিতভাবে অঙ্গরাজ্যগুলোর হতে হবে। পঞ্চম দফা : যৌথ রাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গরাজ্যে যে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করবে, সেই অঙ্গরাজ্যের সবকার যাতে স্বীয় নিয়ন্ত্রণাধীনে তার পৃথক হিসেব রাখতে পারে, সংবিধানে সেরূপ বিধান থাকতে হবে। সংবিধান নির্দেশিত বিধি অনুযায়ী নির্ধারিত অনুপাতের ভিত্তিতে অঙ্গরাজ্য গুলো থেকে তা আদায় করা হবে। সংবিধান নির্দেশিত বিধি অনুযায়ী দেশের বৈদেশিক নীতির কাঠামোর মধ্যে, যার দায়িত্ব থাকবে কেন্দ্রিয় সরকারের হাতে, বৈদেশিক বাণিজ্য ও বৈদেশিক সাহায়্য সম্পর্কে চুক্তি সম্পাদনের ক্ষমতা। আঞ্চলিক বা প্রাদেশিক সরকারগুলোর হাতে থাকবে। ষষ্ঠ দফা : ফলপ্রসূভাবে জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষার কাজে সাহায্যের জন্য অঙ্গরাজ্যগুলোকে মিলিশিয়া বা আধা-সামরিক বাহিনী গঠনের ক্ষমতা দিতে হবে।
২০ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় ছয় দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে ছয় দফার যৌক্তিকতা তুলে ধরতে ও জনমত গড়ে তুলতে দেশব্যাপী জনসভা করার কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়। তারই অংশ হিসেবে ২৫ ফেব্রæয়ারি ছয় দফার সমর্থনে সর্বপ্রথম চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক লালদীঘি ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ট সহচর, তৎকালিন বৃহত্তর চট্টগ্রাম আওয়ামীলীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক, চট্টল শার্দুল, এক দফার প্রবক্তা মরহুম এম এ আজিজ নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথম প্রকাশ্যে জনসভা করেন। সে সভায় এম,এ, আজিজ ছয ঘোষণা করেন যে, ছয় দফা না মানলে এক দফার স্বাধীনতার আন্দোলন চলবে। বঙ্গবন্ধু দেশব্যাপী ৩৫ দিনে ৩২টি জনসভা করেন। তিনি জনসভায় সারা দেশের অগণিত মানুষের সন্মুখে ছয় দফার নানা দিক তুলে ধরেন। বিভিন্ন জনসভায় তিনি আবেগময় ভাষায় বক্তৃতার মাধ্যমে জনসাধারণকে অনুপ্রাণিত করেন। যার কারণে ছয় দফা যত জনপ্রিয় হয়েছে, ব্যক্তি মুজিবের নেতৃত্বে আরো সুসংহত হয়েছে। ছয় দফা আন্দোলনই তাঁকে বাঙালি জাতির একমাত্র মুখপাত্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ১৯৬৬ সালের ১৮-২০ মার্চে ঢাকার ইডেন হোটেলে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ষষ্ঠ কাউন্সিলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সভাপতি ও তাজউদ্দিন আহমদকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। কাউন্সিলে ছয় দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে ‘আমাদের বাঁচার দাবি, ছয় দফা কর্মসূচি’ শীর্ষক একটি পুস্তিকা প্রচার করা হয়।
ছয় দফার সংগ্রাম ছিল কন্টকাকীর্ণ ও বিপদসংকুল। পাকিস্তানি শাসকরা প্রচারণা, মিথ্যা তথ্য আর ভয়ভীতি ও হুমকি প্রদর্শন করেও ছয় দফার আন্দোলন দমন করতে পারেনি। জেল, জুলুম, নির্যাতন ছয় দফাকে বাঙালিদের কাছে আরো গ্রহণযোগ্য, য়ৌক্তিক ও জনপ্রিয় করেছে ও বাঙালি জাতির মৌন রাজনৈতিক চেতনা, অধিকার আদায়ের সংগ্রামে আরো শাণিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু নীতিতে হিমালয়ের মতো অটল অবিচল ছিলেন। তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন, ছয় দফার বাস্তবায়ন ব্যতীত বাঙালি জাতির মুক্তি সম্ভব নয়। তাই এই অকুতোভয় বীর দ্বিধাহীন চিত্তে বলেছিলেন, ‘সরাসরি রাজপথে যদি আমাকে একা চলতে হয় চলবো। কেননা ইতিহাস প্রমাণ করবে বাঙালি জাতির মুক্তির জন্য এটিই সঠিক পথ’। ছয় দফা দেয়ার অপরাধে স্বৈরশাসক বঙ্গবন্ধুকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে অভিহিত করা হয়। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল আইয়ুব খান বলেছিলেন, ‘বিচ্ছিন্নতাবাদীরা যদি গৃহযুদ্ধ চাপিয়ে দেয়, তবে দেশের সংহতি ও অখÐতা রক্ষায় প্রয়োজন হলে অস্ত্রের মুখে জবাব দেয়া হবে’। তৎপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু সহ আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের উপর স্বৈরশাসক আইয়ুবের নির্যাতন শুরু হয়। জনসভা করার দায়ে স্বৈরশাসক বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে প্রত্যেক জেলায় গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি করেন। ৮ মে বঙ্গবন্ধু নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়ায় লক্ষাধিক লোকের এক বিশাল জনসভা করেন এবং তিনি ভাষণে বজ্রকন্ঠে সংকল্প ঘোষণা করে বলেন, ছয় দফা প্রশ্নে কোন আপোস নেই। তখন উদ্দীপিত লাখো জনতা হাত তুলে বঙ্গবন্ধুকে অকুন্ঠ সমর্থন জানান। সেদিন দিবাগত রাত ১টার সময় তার বাসভবন থেকে দেশরক্ষা আইনে বঙ্গবন্ধুকে স্বৈরাচার সরকার গ্রেফতার করে কারাগারে প্রেরণ করে। পরবর্তীতে দলের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দিন আহমদকে গ্রেফতার করা হয়। ছয় দফা প্রচারকালে বঙ্গবন্ধুকে তিন মাসে তাকে আটবার গ্রেফতার করা হয়। বন্দিদশায় তার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেয়া হয়। ফলশ্রæতিতে এ ছয দফাকে কেন্দ্র করে স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন জোরদার হয়।
১৯৬৬ সালের ২০ মে কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় সিদ্ধান্ত মোতাবেক ছয় দফা বাস্তবায়ন, বঙ্গবন্ধুসহ আটক সকল নেতাদের মুক্তি, জরুরি অবস্থার অবসান, দেশরক্ষা আইন বাতিল, সংবাদপত্রের উপর বিধিনিষেধ প্রত্যাহার ও অন্যান্য দাবিতে পূর্ব পাকিস্তা নে ৭ জুন আওয়ামী লীগ দেশব্যাপী হরতাল আহবান করে। আহুত হরতালে ছাত্র-জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য আইয়ুব সরকারের নির্দেশে পুলিশ বাহিনী নির্বিচারে গুলি করে। তৎপ্রেক্ষিতে পুলিশ ও ইপিআর এর গুলিতে ৭ জুন তেজগাঁওয়ে বেঙ্গল বেভারেজের শ্রমিক মনুমিয়া, আজাদ এ্যলুমনিয়াম কারখানা শ্রমিক আবুল হোসেন, মুজিবুল্লাহ, শফিক ও শামসুল হকসহ ঢাকা, টঙ্গী, নারায়ণগঞ্জে ১১জন শহীদ হলে আন্দোলনে তীব্রতা বৃদ্ধি পেলে লাখো বাঙালি রাস্তায় নেমে পড়ে। সেদিন সরকার সন্ধ্যায় কার্ফু জারি করে এবং রাতে সারা দেশ হতে প্রায় ৮০০ বাঙালিকে গ্রেফতার করা হয়। এমনিভাবে সারাদেশে ছয় দফার আন্দোলন সারাদেশ ব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। ফলে শহীদের রক্তে আন্দোলন নতুন মাত্রা পায়। ৭ জুন শ্রমিক জনতার রক্তে স্বাধীনতার সোপান রচিত হয়েছিল। স্বৈরশাসক বঙ্গবন্ধুকে জানুয়ারি মাসে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। ১৯৬৮ সালের জুলাই মাসে বঙ্গবন্ধুকে চিরতরে তাঁর কন্ঠ স্তব্ধ করে দেয়ার জন্য আগরতলা মামলা দিয়ে সেনানিবাসের অভ্যন্তরে আদালত বসিয়ে ৩৫ জন আসামিসহ দেশদ্রোহী সাবস্থ্য করে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলে দেশের ছাত্র-জনতা প্রতিবাদে গর্জে উঠে। তখন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গড়ে ওঠে। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফা ও ছয় দফা সামনে নিয়ে আন্দোলন এগিয়ে চলে। বঙ্গবন্ধু সহ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার ও বন্দিদের মুক্তির দাবিতে যে আন্দোলন শুরু হয় তা গণঅভ্যত্থানে পরিণত হয়। তৎপ্রেক্ষিতে স্বৈরসরকার বঙ্গবন্ধুসহ সব আসামিকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালির মুক্তির সেই ছয় দফার কন্টকপূর্ণ ও বন্ধুর সিঁড়ি বেয়ে অর্জিত হয় স্বার্বভৌম বাংলাশে। তাই দিনটি পালিত হয় ছয় দফা দিবস হিসেবে। ছয় দফার প্রণেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ৭ জুন স্বাধিক ার আন্দোলনের জন্য যারা আত্মাহুতি দিয়েছিলেন, সেসব শহীদদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করি।

লেখক: কলামিস্ট ও রাজনীতিক