মোহাম্মদ আবু তালেব বেলাল

135

২০০৯ সালে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের এলাকা সম্প্রসারণ নিয়ে চট্টগ্রামের রাজনৈতিক অঙ্গন বেশ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল। এ নিয়ে ইলেক্ট্রিক ও প্রিন্ট মিডিয়াগুলো বেশ সরব হয়ে উঠেছিল। বাস্তবে এসবে যা ঘটছিল তা দেখে মনে হয়েছিল ‘যার বিয়ে তার খবর নেই, পাড়া-পড়শীর ঘুম নেই’ অবস্থা।
চট্টগ্রাম বিশ্বের নগর ও বন্দরের ইতিহাসে একটি পরিচিত নাম। পৃথিবীর প্রাচীন বন্দর- শহরগুলো যেমন সিংহল, মালাক্কা, কালিকট, জাভা, সুমাত্রা, মালয়, ক্যান্টন বন্দরগুলোর নামের পাশে চাটগাঁও (চট্টগ্রাম) নামের চাকচিক্য রয়েছে যথেষ্ট। এ বন্দর শুধু জাহাজ বোঝায় মাল উঠানামার সুযোগ সুবিধার জন্য বিখ্যাত ছিল না; বরং এ বন্দর একসময় পরিণত হয়েছিল গোটা বাংলাদেশের শিক্ষা, সভ্যতার পীঠস্থান; শিল্প বাণিজ্যের লীলাভ‚মি। তাছাড়া এ বন্দর ও নগর ছিল আরব, চীন, গ্রীক, রোমান, পর্তুগিজ, ডেনিস ও ইংরেজ সভ্যজাতির পন্ডিত, সাধক, ধর্মপ্রচারক ও ভূগোলবিদদের পাশাপাশি বণিকদের তীর্থস্থান। ষোল শতকের এক পরিব্রাজক সিজার ফ্রেডরিক চট্টগ্রাম বন্দর অঞ্চলে তৎকালীন পৃথিবীর উন্নত জাহাজ নির্মাণ কাহিনীর এক চিত্তাকর্ষি বর্ণনা দেন। তিনি বলেন, “এখনকার সন্দ্বীপ (চট্টগ্রাম) জনবহুল এক বিশাল বাণিজ্য কেন্দ্র। এ বন্দরে প্রতিদিন গড়ে দুইশ’ জাহাজ লবণ বোঝাই হইয়া বিদেশ গমন করে। এখনকার জাহাজ নির্মাণ কৌশল এত সুন্দর ও কাঠ এত মজবুত যে ইস্তাম্বুলের সুলতান আলেকজান্দ্রিয়ার বদলে এখন তার রাজ্যের প্রয়োজনীয় সমস্ত জাহাজ এইখান হইতে তৈয়ার করাইয়া থাকেন।” এসব কারণে চট্টগ্রাম বন্দর প্রাচীন বন্দর ও নগরসমূহের চেয়ে স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তবে ভাগ্যের পরিহাস সুমাত্রা, মালয়, ক্যান্টন, জাভা ও সিংহল তাঁর প্রাচীন ঐতিহ্য নিয়ে পৃথিবীর আধুনিক বন্দর ও নগর হিসেবে পরিচর্যা পেলেও চট্টগ্রামকে তার রূপ-লাবণ্যের বিকৃত করে চুন-কালি দিয়ে শুধু টু-পাইস কামাইর মকামে পরিণত করা হয়েছে। এ সবের পেছনে কিন্তু রাষ্ট্র থেকে রাজনীতিবিদ সবাই সমানভাবে দায়ি। রাষ্ট্র বারবার চট্টগ্রামের প্রতি বেনিয়া- লুটেরাদের চরিত্র চর্চা করেছে। আর রাজনীতিবিদরা ফারাক্কার ন্যায় ইস্যু করে তাদের স্বার্থ চরিতার্থ করার প্রয়াস চালিয়েছে। ঢাকা চারশত বছরের ইতিহাসে বিশাল ও আধুুনিক নগরের মর্যাদা পেলেও চট্টগ্রাম প্রাচীন নগর হিসেবে সর্বোপরি দেশে অর্থনীতির চালিকাশক্তি বা প্রধান যোগানদাতা হিসেবে যে মর্যাদাটুকু পাওয়ার কথা সে মর্যাদা আগের পরাধীন শাসনামলের কথা বাদ দিলেও স্বাধীনতার ৪২ বছরেও পায়নি। তার কারণ অনেক হলেও প্রধান কারণ হিসেবে ধরে নিতে পারি আমাদের সচেতনতার অভাব ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের ঐক্যের অভাব। বিনয়ের সাথে অভিযোগ, দেশের কোন শহরে বা মফস্বলে চট্টগ্রামের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মত অনৈক্য, প্রতিহিংসা ও পরশ্রীকাতরতা খুব কমই দেখা যায়। আর তাদের অনেক্য, প্রতিহিংসা, পরশ্রীকাতরতা তাদের রাজনৈতিক কেরিয়ার কতটুকু উন্নত হচ্ছে তা বোধগম্য না হলেও চট্গ্রাম বিদ্বেষীরা যে মহাখুশি এবং চট্টগ্রামের উন্নয়নে মারাত্মক ক্ষত সৃষ্টি হচ্ছে তা বলার অবকাশ নেই। এ লেখাটির পূর্বে চট্টগ্রামের বন্দর ও কর্ণফুলী নদের নির্মম ও অসহায়ত্বের কথা আমি পত্রিকায় অনেক লিখেছি। কর্ণফুলীর তৃতীয় সেতুকে আমরা দক্ষিণ চট্টগ্রামবাসীরা আপাততঃ স্বর্গীয় উদ্যানের মতো ভাবছি। এটি আমাদের আত্মকেন্দ্রিক চিন্তা, এক্ষেত্রে নিজেদের ওপাড়ে পারাপারের সহজ উপায়ের কথাই ভাবছি শুধু। এ রকম ভাবাও প্রত্যাশা মানুষের থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু ঝুলন্ত সেতুর নামে যে পিলার সেতুটি আমাদের জন্য করা হয়েছে তার পরিণতি দেখতে হলে একবার কর্ণফুলী নদী মোহনা থেকে রাঙ্গুনিয়ার কোদালা চা বাগান পর্যন্ত নৌ ভ্রমণ করে আসতে হবে।
একসময় যে জাহাজ কর্ণফুলী মোহনা হয়ে সরাসরি বন্দরে প্রবেশ করতো, আজ তা গভীর সমুদ্র থেকে মোহনা পর্যন্ত আসতে পারে না। এ নদীতে যে পলি জন্মেছে, তার পরিনাম এতো ভয়াবহ রূপ ধারণ করছেন ক্রমান্বয়ে কর্ণফুলী নদী ‘সাঁকো’ দিয়ে পারাপার সম্ভব হবে। কিন্তু আমাদের রাজনীতিবিদরা ভোটযুদ্ধে জয়ী হওয়ার জন্য প্রয়োজনে দেশ সাহারা মরুভূমি হোক তাতে কি? যেই নীতিতে তাঁরা রাজনীতি করছেন সেই হিসেবে কথাটি বলা। ব্রিজ হয়েছে, যখন কর্ণফুলীতে পানিই থাকবে না তখন ব্রিজ আমাদের কি কাজে আসবে? চট্টগ্রাম বন্দরের তার অস্তিত্বই বা থাকবে কিভাবে। সে যাক, মূল কথায় আসি। চট্টগ্রাম শহর বা সিটি কর্পোরেশনের সম্প্রসারণ ও উন্ন্য়ন প্রসঙ্গে। উন্নয়নের কথা আগেই বলেছি। উন্নয়নের একটি তাত্ত্বিক দিক হচ্ছে যেখানে নগর, শহর ও শিল্পায়ন হবে সেখানে উন্নয় ঘটবে। হয়তো তা প্রত্যাশার সিঁড়ি অতিক্রম নাও করতে পারে। তবুও উন্নয়নের জন্য নগরায়ন একটি অপরিহার্য বিষয় আর শক্তিশালী নগরায়নের জন্য প্রয়োজন সার্বিক উন্নয়ন। সার্বিক উন্নয়নের প্রবক্তাদের মতে, একটা সমাজের বিভিন্ন দিকসমূহ পরস্পর এমনই ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত যে, আলাদা আলাদাভাবে কোনো একটি দিকের উন্নয়ন চূড়ান্ত বিচার সম্ভব নয়। তাই প্রকৃত উন্নয়নের জন্য সার্বিক উন্নয়ন প্রক্রিয়াই যথার্থ। অর্থাৎ শহর উন্নয়নের প্রক্রিয়ার সাথে জনসমষ্টি এবং অন্যান্য প্রাসঙ্গিকতার সাথে শহর সম্প্রসারণ উন্নয়নের একটি অংশ। দূর অতীতের ইতিহাস না হয় নাই বললাম। এই যে সোনারগাঁও’র ইতিহাসে দেখুন, এখানে যখন বাংলার মোগল সুবাদাররা থাকতেন এটি যখন বাংলার রাজধানী ছিল, তখন তাবৎ বিশ্ব সোনারগাঁও এর দিকে থাকিয়ে দেখতেন। এখানে রাজা-রাণীদের প্রসাদ, হাম্মানখানা, সরাইখানা, রাস্তা-ঘাট এমনকী সমাধিও পর্যটকদের অবাক করে। অথচ সোনারগাঁও যখন রাজাহারা নগরে পরিণত হল। রাজধানী যখন বুড়িগঙ্গার তীরে চলে গেলো, সোনারগাঁও ইতিহাসের পাতায় নিঃস্ব ও উপেক্ষিত মফম্বল শহরে পরিণত হলো। তা নগরের মতো উন্নয়ন তার আর হয় না। এভাবে বাংলার এ সময়কার রাজধানী রাজমহল, মুর্শিদাবাদে ইতিহাসের স্মৃতির পাতায় প্রসিদ্ধ নগর হিসেবে পরিচিত। আধুনিক ঢাকা এসবকে মফস্বলে পরিণত করেছে। কারণ এসব এলাকা আধুনিক নগর সভ্যতা থেকে অনেক পশ্চাতে। একটি কথা আমাদের বোধে আসতে হবে, আমাদের আবেগ আমাদের প্রকৃতির মতো। আমাদের আবেগ যখন চেতনায় শাণিত হয় তখন উপযুক্ত ও যোগ্য নেতৃত্বে আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ পেয়েছি। এরপর আমাদের আবেগের জল পাত্রে নিয়ে রাজনীতি হয়েছে মাত্র। এ রাজনীতি শূন্য গোয়ালঘরে সোনার হরিণের জন্ম দিয়েছে, খালি ব্রিফকেইসে হাজার কোটি টাকায় ভর্তি হয়েছে। আ্ঙ্গুল ফুলে হয়েছে কলাগাছ। বাইশ পরিবারের স্থলে বাইশ হাজার পরিবারের জন্ম হয়েছে। আর তখন আমেরিকার মত দেশ আমাদের দেশকে আখ্যা দিয়েছিল ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’। বলার অপেক্ষা রাখেনা বাংলাদেশ কিন্তু এখন তলাবিহীন ঝুড়ি নয়। বরং বাংলাদেশ এখন বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে উন্নয়নের মডেল। এর পরও বুঝা দায়, আসলে আমাদের রাজনীতির সংস্কৃতি কি? রাজনীতি মানে যেখানে প্রজাদের মঙ্গল, দেশের উন্নয়ন, সে রাজনীতি ঠকবাজি, চালবাজি, চুরি, ডাকাতি, দুর্নীতি, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ আর দলবাজির মাধ্যমে ‘ভালো কাজে বাধা অসৎ কাজে সাড়া’ নীতিই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
রাজনীতিবিদদের চল-চাতুরী ও কূট-কৌশলে এক ধরনের বঞ্চনা ও উপেক্ষার মধ্যে দিনাতিপাত করছে ঐতিহাসিক কর্ণফুলীর দক্ষিণ পাড়ের মানুষগুলো। তারা এবং তাদের ভূমি অনেক জায়গায় ঐতিহ্য হয়ে ইতিহাসে ঠাঁই করে আছে। তারা কর্ণফুলীর তরঙ্গের ছন্দময় আওয়াজ শুনতে পায়। জাহাজের বজ্রঘণ্টা তাদের এখনও হয়তো ঘুম ভাঙ্গায়, ওপাড়ের ডিঙির মিটিমিটি বাতি আর প্রসাদতুল্য অট্টালিকার চূড়া এপাড়ের কিশোর, যুবা-বৃদ্ধরা দেখে পুলকিত হয়। ওপাড়ের শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণী স্বচ্ছ-সুন্দর কাপড় পরে স্কুলে যায়, যায় কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে, সাইবার ক্যাফে। আর এপাড়ের পড়শীরা ঐ বয়সে যায় নদীতে মাছ ধরতে। ক্ষেতে ধান রোপন। কর্ণফুলীর শাহ্ আমানত সেতুর উত্তরপাড় নগর আর দক্ষিণ পাড় অজপাড়া গাঁ। ভাবতে অবাক লাগে। পৃথিবীর কোন দেশে এমন চিত্র আছে কি না সন্দেহ। ইউফ্রেটিস ও টাইগ্রীস নদীর দু’কূল ঘেঁষে যে বাগদাদ নগরী গড়ে উঠেছিল তা ইতিহাসকে আলোকিত করেছে। মোঘল প্রাসাদ দিল্লী হলেও যমুনার তীরকে সৌন্দর্যের রাণীতে পরিণত করছিল মোঘলরা। এখানে গড়ে তুলেছিল আগ্রা আর তাজমহল, পৃথিবীর সপ্তাচার্যের নগরী। বুড়িগঙ্গার ওপাড়েও গড়ে উঠেছে ঢাকা নগর। পরিণত হয়েছে শিল্পাঞ্চল। ঐতিহ্যময় কেরানীগঞ্জ ও জিঞ্জিরা শিল্প এলাকা। গড়ে উঠেছে আবাসিক।
কিন্তু কর্ণফুলীর ওপাড়ে শিকলবাহা, কোলাগাঁও, চরলক্ষ্যা, চরপাথরঘাটা, জুলধার খোয়াজনগর, ইছানগর, চরফরিদ, ডাঙ্গারচর, দ্বীপকালামোড়, লাখেররার ভগ্ন রাস্তা, আর শিল্প-সংস্কৃতির পশ্চাদপদতা দেখলে ইতিহাসও অভিসম্পাত দিবে। কারণ এসব অঞ্চল হাজার বছরের চট্টগ্রামের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এক সময় এসব অঞ্চলে কর্ণফুলীর হয়ে পর্যটক, ব্যবসায়ী, ধর্মপ্রচারকরা চট্টগ্রামে আসতেন। জাহাজ তৈরির জন্য ব্যবসায়ীরা শিকলবাহা ও কোলাগাঁওকে পছন্দ করতেন বেশি। আজ কিন্তু এসব অঞ্চলের অবস্থা দেখলে মনে হবে কত অবহেলা ও বঞ্চনার শিকার এসব অঞ্চলের মানুষ। এছাড়া শহরতলীর পূর্ব-উত্তর দিকের বোয়ালখালী, কুয়াইশ-বুড়িশ্চর-চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, সীতাকুন্ডের ফৌজদারহাট, সলিমপুর এলাকার অবস্থাও একই। অথচ স্বাধীনতার পর থেকে এসব অঞ্চলের মানুষ ভোট দিয়েছে, নেতা বানিয়েছে, আশায় বুক বেঁধেছে। কিন্তু উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি সেই ঝুলানো কলা এখনো ঝুলানোই আছে। এসব অঞ্চল ছিটমহলের ন্যায় ‘নয় ঘরকা নয় ঘটকা’।
প্রকৃতপক্ষে শহরের একদৃষ্টি পথের এ অবস্থা কোন সভ্য দেশে চলতে পারে না। আর শহরও তার সীমানায় দীর্ঘদিন স্থিতি থাকতে পারে না। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন এলাকায় এখন আর চল্লিশ লাখ মানুষের বাস নয়; এটি পুরনো সংখ্যাতত্ত্ব। এখন সত্তর লাখেরও অধিক মানুষ মাত্র ষাট কিলোমিটার এলাকায় বাস করেন। তার সাথে বাড়ছে আবাসন, যানবাহন, রাস্তাঘাট, শিল্প-কারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য। তাই একদিকে যেন শহর সম্প্রসারণ অপরিহার্য, অন্যদিকে, শহরতলী এলাকা নগর অন্তর্ভুক্ত না হলে নগরের শ্রীবৃদ্ধিও হয় না। ভবিষ্যতে নাগরিক জীবনে হয়ে উঠতে পারে দূর্বিষহ যন্ত্রণা।
বর্তমান আধুনিক বিশ্ব শহরায়ন বা নগরায়ন আগেকার ধারণার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। মফস্বলগুলোও শহরের আলো বাতাস পেতে চায়। তাই দেখা যায়, অবকাঠামোগত সুযোগ সুবিধা নেই। জনগণের জীবন তেমন মানসম্পন্ন নয়। কিন্তু পৌরসভা হয়েছে। এতে রাজনৈতিক ফায়দায় নেতার থলে ভর্তি হলেও উক্ত এলাকার উন্নয়ন ও জনগণের সামগ্রীরক মানোন্নয়নের কথা অস্বীকার করা যায় না। এ পৌরসভার একসময় চেয়ারম্যান বা প্রশাসক এখন ‘মেয়র’ নামে মর্যাদা পেয়েছে। সামনে হয়ত এ পৌরসভাগুলো সিটি কর্পোরেশন হবে। সিটি কর্পোরেশন হলে কর দিতে হবে। তাই শহুরে হবো না, গ্রামেই থেকে যাবে এ ধারণা সনাতনী। আমরা জানি ২০০৮-’০৯ সালে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র আলহাজ এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী (প্রয়াত) সিটি কর্পোরেশন এলাকা সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিয়েছিলেন যা অত্যন্ত বাস্তবসম্মত ছিল। কিন্তু রাজনীতিবিদদের স্বার্থের দ্বন্দ্বে সেই উদ্যোগ মাটি হয়েছে। যাকে দেখতে না পারে, তার নাচন বাঁকা’র মতো অবস্থা। আরো একটি বিষয় উল্লেখ না করলে নয়, নগরীর এ সম্প্রসারণ প্রস্তাবনা ও পরিকল্পনা অনেক আগেই নেয়া হয়েছিল। ১৯৯৭ সালের প্রস্তাবনা অনুযায়ী এবং ১৯৯৯ সালে সাবেক মেয়র এ বি এম মহিউদ্দীন চৌধুরী স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের আশেপাশে ১৮টি ইউনিয়কে সিটি কর্পোরেশনের আওতায় এনে ৬০ কিলোমিটার এলাকা বাড়িয়ে ১২০ কিলোমিটার এলাকায় উন্নীত করার জরিপ প্রস্তাবনা উপস্থাপন করেন। ১৯৯৯ সালে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় তা গেজেট আকারে প্রকাশ করে। এ সময় উক্ত আঠার ইউনিয়নের সর্বসাধারণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে এ উদ্যোগকে স্বাগত জানায়। সিটি কর্পোরেশনের এ উদ্যোগ যে জনগণের আবেগ ও ইচ্ছার প্রতিফলন তখন স্থানীয় ও জাতীয় দৈনিকগুলোতেও এ বিষয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। ২০০৫ সালের ৫ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের একটি দৈনিক ‘চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন এলাকায় পরিধি দ্বিগুণ হচ্ছে; শিরোনামে প্রথম পৃষ্ঠায় সংবাদ প্রকাশ হয়। এতে বলা হয়, ‘চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন এলাকার পরিধি দ্বিগুণ করা হচ্ছে। বর্তমান সিটি কর্পোরেশন এলাকার পার্শ্ববর্তী পাঁচটি থানার ১৮টি ইউনিয়নকে সিটি কর্পোরেশনের আওতায় আনা হচ্ছে। এ ব্যাপারে স্থানীয় মন্ত্রণালয় থেকে গেজেট প্রকাশ করা হয়েছে। ১৮ ইউনিয়নের চেয়ারম্যানদেরকে সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের কমিশনার করা হবে বলে জানা গেছে। একই সাথে মহিলা মেম্বারদেরকে উন্নয়ন কাজে সম্পৃক্ত করা হবে বলে বলা হয়েছে।
পত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণের কথা বিবেচনা করে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী সিটি এলাকাকে আরো সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তিনি অবকাঠামো উন্নয়নের আগে এলাকা থেকে পাঁচ বছর কর নেওয়া হবে না বলে জানিয়ে ছিলেন। ওই সময় বর্তমান সিটি কর্পোরেশনের ৬০ বর্গমাইল এলাকার সাথে আরো ৬০ বর্গমাইল এলাকা বাড়ানোর একটি জরিপ রিপোর্ট স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছিল। জানা গেছে, মন্ত্রণালয়ে জরিপ রিপোর্ট পাঠানোর পর স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে গেজেটে প্রকাশ করা হয়। পরবর্তীতে সম্প্রসারিত এলাকার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানগণ সিটি কর্পোরেশনের বিরোধিতা করে মামলা করলে তা স্থগিত হয়ে যায়।
গত ২০০৮-’০৯ সালে তৎকালিন সিটি মেয়র পুনরায় সিটি কর্পোরেশন এলাকাকে সম্প্রসারণ করার উদ্যোগ নিয়ে ছিলেন। সম্প্রসারিত এলাকার জনগণ মেয়রের এই উদ্যোগকে স্বাগতও জানিয়েছিলেন। মেয়রের ঘোষণা ১৯৯৯ সালে যে রকম ছিল ২০০৫ সালেও একই রকম ছিল, ২০০৯ সালেও এর বৈপরিতা ঘটেনি। তবে যারা এই উদ্যোগের বিরোধিতা করছেন তাঁরা কোন বলিষ্ঠ যুক্তি দেখাতে পানেনি। আমাদের মনে হয়, মেয়র আর ব্যক্তি মহিউদ্দিন বা রাজনীতিবিদ মহিউদ্দিনকে এক করে ফেলায় এ সব সমস্যার জন্ম হয়েছিল। তবে মহিউদ্দিন তার মেয়র পদ ছাড়ার পর চশমা হিলেই চলে গিয়ে ছিলেন, সেখানে তিনি চিরশায়িত হয়েছেন, কিন্তু প্রস্তাবিত সম্প্রসারিত এলাকায় তিনি এককড়া জায়গা কিনেছেন বা বাড়ি করেছেন এমনটি নজির নেই। কিন্তু সম্প্রসারিত এলাকার মানুষের সামনে যে সুযোগ এসেছিল তার ফল ভোগ করতে পারতো তারা, অনাদিকাল নগর সভ্যতার অংশীদারি হয়ে। কিন্তু ২০০৯ সালে তারা সেই সুযোগ নেয়নি।
২০১৯ সালে এসে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আ.জ.ম নাছির উদ্দীন এবাস্তবতা উপলব্ধি করেছেন। কয়েকমাস আগে তিনি একটি অনুষ্ঠানে শহর সম্প্রসারণের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেছেন। চট্টগ্রামের ক্রমবর্ধমান আবাসন, ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পয়নের পাশাপাশি জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে নগর সম্প্রসারণ এখন অপরিহার্য এবং এটিই বাস্তবতা।
আমাদের প্রত্যাশা, বর্তমান মেয়র মহোদয় তাঁর চিন্তা ও ভাবনাকে রূপ দেয়ার বিষয়ে আন্তরিক হবেন। নজর দিবেন নগর সম্প্রসারণের দিকে। চট্টগ্রাম শহরে যে হারে লোক সংখ্যা বাড়ছে, বাড়ছে শিল্প, আবাসিক ও বাণিজ্য, সেই হারে এখনি শহর সম্প্রসারণ পরিকল্পনা গ্রহণ না করলে নগরবাসীকে এর খেসারত দিতে হতে পারে ভবিষ্যতে।
ঢাকা যদিও রাজধানী, জনসংখ্যা অনুপাতে নগর পরিকল্পনা ও উন্নয়ন না হওয়ায় বাসযোগ্য হারাতে বসছে। পরিবেশ হয়ে পড়েছে দূষিত। আমরা আশা করছি, চট্টগ্রামে সময় থাকতে যথার্থ পরিকল্পনা নিতে পারলে- প্রাচ্যের রাণীর সৌন্দর্য ও রূপ-লাবন্য নিয়ে এই বন্দর নগরী চট্টগ্রাম মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকবে।

লেখক : সহকারী সম্পাদক , দৈনিক পূর্বদেশমোহাম্মদ আবু তালেব বেলাল