মেয়েটি বলে আমি সুন্দরী, আমি ফার্স্টক্লাসে বসব

160

এক.
এই যুগ প্রতিযোগিতার যুগ। এটা এমন এক সময়, এখন মানুষকে প্রতিযোগিতা করে সমাজ সংসারে টিকে থাকতে হবে। ভবিষ্যতে অশিক্ষিতের চাইতে শিক্ষিত, জ্ঞানী- লোকেরা সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে বেশী সুবিধা হাসিল করতে পারবে। ভবিষ্যতে অশিক্ষিত, স্বল্পশিক্ষিত মানুষকে শিক্ষিত মানুষ, বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিদের সাথে প্রতিযোগিতা করতে হবে, ব্যাপার শুধু তা নয়, বিশেষজ্ঞদের প্রতিযোগিতা করতে হবে এআই (আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স) বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন যন্ত্রের সাথে। আগামী দিনে রোবট হবে মানুষের প্রতিদ্বন্দ্বি। রাস্তায় রোবটের পাশাপাশি হাঁটবে মানুষ।
এ আই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তিকে প্রশিক্ষিত করে তুলতে রোগ নির্ণয়ের পরীক্ষাগুলোর তথ্য-উপাত্ত “কৃত্রিম নিউরাল নেটওয়ার্ক” (এএনএন) নামের এআই সিস্টেমে ইনপুট দিচ্ছেন গবেষকরা। এতে কারো নিউমোনিয়া, ক্যানসার রোগ হয়েছে- নাকি কবজির হাঁড়ে চিড় ধরেছে, প্যাটার্ন দেখেই এআই সিস্টেম তা বুঝে ফেলবে। এআই সিস্টেমটি অ্যালগোরিদম এবং নির্দেশনা অনুসরণ করে নিজে নিজেই শিখতে পারে। এটি যত বেশী তথ্য পাবে, বোগ নির্ণয়ে তত বেশী চৌকষ হয়ে উঠবে।
আগামী দিনে ডাক্তারের চাইতে পারদর্শী হবে কম্পিউটার। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির সাহায্যে সিটি স্ক্যানের ফলাফল দেখে ফুসফুসের ক্যান্সার নির্ণয়ে পারদর্শী হয়ে উঠবে কম্পিউটার। গত বছর যুক্তরাষ্ট্রে ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয় ১লক্ষ ৬০ হাজার মানুষ। বিশ^ব্যাপী ১৭ লক্ষ মানুষ এই রোগে মারা যায়। গবেষকদের গবেষনায় ফুসফুসের ক্যান্সার নির্ণয়ে সিটি স্ক্যানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি প্রয়োগ করা হয়। যেভাবে দুনিয়া এগুচ্ছে- তাতে আমার মনে হয়, ভবিষ্যতে প্রত্যেক মানুষকে জ্ঞান সম্পন্ন হতে হবে। অশিক্ষিত, অর্ধ শিক্ষিতরা প্রতিযোগিতায় নিচে পড়ে যাবে। শুধু চিকিৎসা নয়, গৃহ নির্মাণ, কলকারখানা, যানবাহন, কৃষি ব্যবস্থা সর্বত্র এআই ব্যবহৃত হবে। সব ক্ষেত্রে দক্ষ ম্যানপাওয়ার লাগবে। যারা অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত আছেন, তাদের লেখাপড়া শিখতে হবে কিংবা পেশাগত জ্ঞান অর্জন করতে হবে। বসকে তেল মেরে বসের বাসায় বাজার করে দিয়ে- এসএসসি পাশ ভবিষ্যতে আর অফিসে প্রভাবশালী হতে পারবেনা।
দুই.
অর্ধশিক্ষিত লোকদের নিয়ে অনেকে ভয়ভীতির মধ্যে থাকেন। শিক্ষিতরা বিনয়ী হন। অর্ধশিক্ষিতরা উদ্ধ্যত্তপুর্ণ আচরন করেন বলে অনেকে প্রচলিত ধারনায় বিশ^াস করেন। আমার ও মনে হয়, কোন কোন স্বল্প শিক্ষিত লোক মনে করেন, তিনি সব বিষয়ে জানেন। সব কাজ তিনি করতে পারবেন। “অল্প বিদ্যা ভয়ংকর” ছোটকালে এরকম কথা শুনেছি। শিক্ষিত হোক বা অশিক্ষিত হোক, সব ক্ষেত্রেই খারাপ মানুষ আছে। তাদের নিয়ে যত টেনশন। বাল্যশিক্ষা বইতে পড়েছি, “খল লোক স্বর্পের ন্যায়।” শিক্ষিতের মাঝেও খল লোক আছে। স্বল্প শিক্ষিতের মাঝে ও আছে। রমজান মাসে তিনি ওমরাহ করতে যাচ্ছেন, বিপুল পরিমান টাকা যাকাত দিচ্ছেন, কিন্তু তার ব্যবসা হলো, ভেজাল ও বিষ মেশানো খাবারের আড়তদারী। তিনি মাদকের ব্যবসা করেন। ঘুষ খান। দূর্নীতি করেন। এখনতো খল লোকেরই প্রাধান্য? খারাপ জামানায় এসে পড়েছি আমরা। স্বল্প-শিক্ষিত ছড়ি ঘোরায়। স্বল্প শিক্ষিত স্কুল পরিচালনা কমিটির সভাপতি হয়। মসজিদ কমিটির সভাপতি হয়।
তিন.
আইনস্টাইন ছিলেন বিজ্ঞানী, কিন্তু উনার সোফার (গাড়ি চালক) ছিলেন স্বল্প শিক্ষিত মানুষ। আইনস্টাইন আপেক্ষিকতার তত্ত¡ আবিষ্কার করেছেন। এই তত্ত¡ নিয়ে আমেরিকার এই স্টেট থেকে ওই স্টেটে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তখন তো আর ইন্টারনেট, ফেসবুক ছিলনা। ফলে আইনস্টাইনের চেহারা সবার কাছে পরিচিত ছিলনা। উনার সোফার উনাকে বল্লেন, স্যার, আপনি রিলেটিভিটি থিউরীর উপর কি ভাষন দিচ্ছেন, সব যায়গাতে একই রকম কথা বলছেন, শুনতে শুনতে আমার মুখস্থ হয়ে গেছে। পরের স্টেটে লেকচার দিতে গেলে আইনস্টাইনের পোশাক পরলেন তার সোফার। সে পোশাক পরে “সোফার” মঞ্চে উঠলেন। ভাষন দিলেন। আইনস্টাইন, সোফারের ড্রেস পরে এক পাশে বসে পড়লেন। হুবহু আইনস্টাইনের মতো বক্তব্য দিলেন সোফার। সমস্যা দেখা দিল, যখন স্থানীয় এক বিজ্ঞানী উঠে দাঁড়ালেন এবং বল্লেন, মিঃ আইনস্টাইন, আমার একটা প্রশ্ন আছে। আইনস্টাইনবেশী সোফার তার মালিকের বক্তব্য মুখস্থ বলতে পারলে ও রিলেটিভিটি থিউরির উপর প্রশ্নের জবাব কি ভাবে দিবেন? চতুর সোফার প্রশ্ন কর্তাকেতাচ্ছিল্যের সাথে বল্লেন, প্রশ্ন করুন। প্রশ্ন শুনে বল্লেন, এটা আপনার প্রশ্ন? আপনার এই প্রশ্নের জবাব আইনস্টাইনের সোফারও দিতে পারবেন। এবার সোফারবেশী আইনস্টাইন মঞ্চে উঠলেন।
দেখলেন, স্বল্প শিক্ষিত ড্রাইভারের বুদ্ধি? এখন এমন যুগ এসেছে যে, উচ্চ শিক্ষিত এডমিনরা যুৎসই চেয়ারে বসলেও- তাদের আশে পাশে বসে স্বল্প শিক্ষিতরা- এডমিনদের নিয়ন্ত্রন করে।
চার.
যে দেশে স্বল্প জ্ঞানী, স্বল্প শিক্ষিতরা মাথার উপর ছড়ি ঘোরায়- সে দেশে কি অবস্থা হতে পারে, সেটা বোঝানোর জন্য আজকের (২২/৫/১৯) একটি জাতীয় দৈনিকের পাতা থেকে পাশাপাশি ছাপানো দুটো সংবাদের রেফারেন্স দিই। সংবাদ শিরোনাম ঃ এক ঘণ্টার পথ চার ঘণ্টায়। এক দিকে খানাখন্দ, অন্য দিকে সড়কের দুই পাশে প্রশস্তকরনের কাজ চলছে। আবার মেরিন ড্রাইভ সড়ক বন্ধ। কক্সবাজার থেকে টেকনাফ যেতে লাগছে চার ঘণ্টা।
তারপাশে আরেক সংবাদ শিরোনাম ঃ “নিউ ইয়র্ক- লন্ডন ৯০ মিনিটে।” (সুত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ২২/৫/১৯, শেষের পাতা)। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক থেকে আকাশ পথে যুক্তরাজ্যের লন্ডন যেতে সাত ঘণ্টা বা তার বেশী সময় লাগে। এটি দেড় ঘণ্টায় নামিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টিক ভিত্তিক উড়োজাহাজ নির্মাতা একটি প্রতিষ্ঠান। শব্দের গতির বেশী গতিতে চললে আমরা তাকে সুপার সিনিক গতি বলি। আর সে গতি যদি শব্দের গতির ৫ গুন হয়? তাকে বলা হয় হাইপারসনিক। যানবাহনের ক্ষেত্রে শব্দের গতিকে মার্ক-১ ধরা হয়। সে হিসাবে হাইপারসনিক গতির মাত্রা মার্ক-৫। এই হাইপারসনিক মার্ক-৫ এর যুগে আমাদেরকে কে নিয়ে যাবে? স্বল্প শিক্ষিত? না, উচ্চ শিক্ষিত গবেষক? কেন আমরা ১ ঘণ্টার পথ ৪ ঘণ্টায় অতিক্রম করি? আমাদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কারনে। আমাদের উচ্চ শিক্ষিতদেরকে ও আয়নায় নিজের মুখ দেখতে হবে।
পাঁচ.
আমি একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের চট্টগ্রাম শাখার প্রধানের সাথে দেখা করতে যাই। প্রথমে যেতে হয় উনার পার্সোনাল স্টাফের কক্ষে। সে আমাকে বলে, আপনি স্যারের সাথে কি বিষয়ে কথা বলবেন, সেটা আমাকে জানাতে হবে। না হয় এপয়েন্টমেন্ট হবেনা। আমি অবাক হই। তার ব্যাপারে খবর নিলাম। একজন আমাকে বল্ল, সে এসএসসি পাস। তাই ব্যবহার রুক্ষ। বল্লাম, সে তার বসকেও তো মানেনা। উনি হেসে বল্লেন, সে ঢাকায় আমাদের সংস্থা প্রধানের লোক এই বসকে না মানলেও তার কোন সমস্যা নাই। আমি মনে মনে বল্লাম, অল্প বিদ্যা ভয়ংকর। লোক্যাল বস্ এসব জানেন। জেনে আর কিইবা করবেন?
ছয়.
মেয়েটি অপরূপা সুন্দরী। বডি ফিগার আকর্ষণীয়। প্লেনের ইকনমি ক্লাসের যাত্রী। যাবে নিউইয়র্ক। সে প্লেনের ইকনমি ক্লাস থেকে উঠে ফার্স্ট ক্লাসে গিয়ে বসে। এয়ার হোস্টেস তার কাছে যায়। বলে, মিস দয়া করে আপনার বোডিং কার্ড দেখান। এয়ার হোস্টেস বলে, আপনার টিকেট ইকনমি ক্লাসের। দয়া করে আপনার নির্দিষ্ট আসনে বসুন। মেয়েটি বলে, দেখছনা- আমি সুন্দরী? আমি ফার্স্ট ক্লাসে বসব। এয়ার হোস্টেস এটা কো-পাইলটকে জানায়।কো- পাইলট গিয়ে বিনয়ের সাথে বলে, ম্যাম, আপনি আপনার নিজ আসনে বসুন। মেয়েটি বলে, আমি সুন্দরী, আমি ফার্স্ট ক্লাসে বসব। কো- পাইলট গিয়ে পাইলটকে ঘটনা জানান। পাইলট প্রশ্ন করে, মেয়েটি কি অপরূপ সুন্দরী? কো-পাইলট বলে, হ্যাঁ। পাইলট বলে আমি তাকে হ্যান্ডেল করতে পারব। আমার স্ত্রী আগুনের মতো সুন্দরী। আমি তাকে ভাল মত ম্যানেজ করি। পাইলট ওই মেয়ের কাছে যায়। সুন্দরীর গালের কাছে মুখ নিয়ে যায়। না কিস্ করার জন্য না। ফিস্ ফিস্ করে কিছু বলার জন্য। সুড় সুড় করে সুন্দরী ইকনমি ক্লাসে গিয়ে বসে।
সাত.
ফিসফিস করে পাইলট সুন্দরীকে কি বলেছিলেন? হ্যাঁ, পাইলট সুন্দরীকে বলেছিলেন, ম্যাম্ আপনি যাবেন, নিউইয়র্ক। এই প্লেনের ইকনমি ক্লাস যাবে নিউইয়র্ক। ফার্স্ট ক্লাস সোজা যাবে নিউজিল্যান্ডে।
আট.
রূপ দেখে, বডি ফিগার দেখে কে শিক্ষিত, কে যোগ্যলোক তা বুঝা যায়না। স্বল্প বিদ্যাধারীকে মাথার উপর তুলবেন না। আখেরে পস্তাতে হবে। এসএসসি ফেল এখন অফিসের বসের মাথার উপর ছড়ি ঘোরায়। অথচ আর ৫/৭ বছরের মধ্যে আমাদেরকে এআই এবং রোবটের সাথে প্রতিযোগিতায় নামতে হবে।তবে যার কৌশল জানা আছে, সে “স্বল্পবিদ্যাকে” সহজে ম্যানেজ করতে পারে।

লেখক : সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, অধ্যক্ষ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ
Email: fazlulhoque_7@yahoo.com