মেলায় আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে ‘আপন আলো’

165

শিক্ষার খুটিনাটি সব বই নিয়ে বইমেলাতে আলো ছড়াচ্ছে ‘আপন আলো’। শিক্ষা বিষয়ক ছোটদের বই নিয়েই আপন আলোর পসরা। তবে গল্প ও কবিতার বইয়ের কাটতিও আছে আপন আলোর স্টলে।
আপন আলোর স্টলে গণিতের মূল্যায়ন-দেখা ও শেখা বইটি হাতে নিয়ে পড়ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এহসানুল কবির। পাশে নবম শ্রেণিতে পড়ুয়া নাইমুল ইসলাম চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিল ‘সৃজনশীলপত্র ও অন্যান্য প্রসঙ্গ’ বইটিতে। কয়েক মিনিট দেখার পর বইটি কিনে নিলেন নাইমুল ইসলাম।
বইটি কেনা প্রসঙ্গে নাইমুল বলেছে, সৃজনশীলপত্র ও অন্যান্য প্রসঙ্গ বইটি দেখে ভালো লাগলো তাই কিনে নিলাম। বইমেলায় এসে খুবই ভালো লাগলো। আরো দুইটি বই কিনেছি। সময় করে বইগুলো পড়বো।
আপন আলো প্রকাশনের স্বত্ত¡াধিকারী নাজমা হক বলেন, ব্যতিক্রমী কিছু করার প্রত্যয় নিয়ে আপন আলোর যাত্রা। ছোটদের শিক্ষামুখি করা এবং সঠিক ইতিহাস তুলে ধরার কাজ করে যাচ্ছে আপন আলো। শিক্ষামূলক বইগুলোর প্রতি আপন আলোর প্রাধান্য থাকে। তাছাড়া গল্প ও কবিতার বইও প্রকাশ করেছি আমরা।
তিনি বলেন, বইমেলা সত্যিকার অর্থে লেখক, পাঠক ও প্রকাশকদের মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে। মেলা প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে পেয়েছে। আগামীতে চট্টগ্রামে বৃহৎ বইমেলার ইঙ্গিত বহন করে এই বইমেলা।
আপন আলো থেকে এবার প্রকাশিত হয়েছে, ছোটদের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মোহাম্মদ শহীদুল্লাহর ‘গণিতের মূল্যায়ন-দেখা ও শেখা, শামসুদ্দীন শিশিরের ‘শিক্ষা ও অন্যান্য প্রসঙ্গ, শিক্ষক অভিভাবক সমীপে, বীর শ্রেষ্ঠদের কথা, সৃজনশীলপত্র ও অন্যান্য প্রসঙ্গ, ছোটদের মাহবুবুল হক, ছোটদের মহিউদ্দীন চৌধুরী, ছোটদের অনুপম সেন ও ছোটদের ওয়াজেদ মিয়া। কবিতার বইয়ের মধ্যে বিবর্ণ রাফির ‘বিনা অনুমতিতে প্রবেশ নিষেধ’।
স্টলটিতে পাওয়া যাচ্ছে আমাদের অধ্যাপক জাহানারা ইমাম, আমাদের জাতীয় অধ্যাপক, আমাদের অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ, আমাদের বেগম রোকেয়া, আমাদের আহমদ ছফা, গল্পে গল্পে শিখি কাজী নজরুল ইসলাম।
সৃজনশীল প্রকাশনা পরিষদের যুগ্ম সচিব জামাল উদ্দিন বলেন, বইমেলা প্রাণের মেলায় পরিণত হয়েছে। দিনে দিনে পাঠক-বই অনুরাগীদের পদচারণা বাড়ছে। মেলায় প্রায় প্রতিটি স্টলেই ভালো বিক্রি হচ্ছে। নতুন পুরাতন মিলে সব বইয়ের প্রতি পাঠকদের আগ্রহ আছে।
সৃজনশীল প্রকাশনা পরিষদের সহায়তায় চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন ১৯ দিনব্যাপী এ বইমেলার আয়োজন করেছে। আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রতিদিন বিকেল ৩টা থেকে রাত ১০টা এবং ছুটির দিন সকাল ১০টা থেকে মেলা সকলের জন্য উন্মুক্ত থাকবে। মেলায় ঢাকা ও চট্টগ্রামের ১১০টি প্রকাশকের স্টল রয়েছে।

মেলায় নতুন বই

বাংলাদেশের
মস্তিষ্ক হবে
চট্টগ্রাম
নাসিরুদ্দিন চৌধুরী
নিজস্ব প্রতিবেদক


বীরমুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিক, লেখক ও গবেষক নাসিরুদ্দিন চৌধুরী বলেছেন, বাংলাদেশের মস্তিস্ক হবে চট্টগ্রাম। চট্টগ্রামের অর্থনৈতিক সম্বৃদ্ধি যেমন আছে, তেমনি জ্ঞান চর্চা এবং সাহিত্য-সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে অভাবনীয় সুযোগ আছে।
অমর একুশে বইমেলা সম্পর্কে তিনি বলেন, আমি খুব খুশি হয়েছি চট্টগ্রামের অভিন্ন বইমেলা হওয়াতে। একুশ মেলা করার কারণে সৃজনশীল প্রকাশক সৃষ্টি হয়েছে। মেলার আয়োজন দেখে ভালো লাগলো। আরো সৃজনশীল প্রকাশক সৃষ্টি হোক এটা কামনা করি। আগামীতে প্রকাশনার ক্ষেত্রে যেন আমাদের ঢাকামুখি হতে না হয় সেটা আশা করি।
তবে মেলা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করে নাসিরুদ্দিন চৌধুরী বলেন, আজকে সিটি কর্পোরেশনের অধীনে বইমেলা চলে এসেছে। মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের মানুষ হিসেবে মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন সাহেব খুবই ভালোভাবে একটি বইমেলার আয়োজন করেছেন। তবে কোন কারণে ৫/১০ বা ২০ বছর পর যদি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী বা ভিন্ন চেতনার মানুষ মেয়র হিসেবে আসেন, তখন মেলার কী হবে? সিটি কর্পোরেশন বইমেলাতে সহযোগিতা করুক, সে সহযোগিতা নানাভাবে হতে পারে। কিন্তু মেলার মূল নিয়ন্ত্রণ থাকতে হবে জনগণের হাতে। কোন প্রতিষ্ঠানের হাতে নিয়ন্ত্রণ চলে গেলে, তখন বিরূপ প্রভাব আসতে পারে।
চট্টগ্রামে মৌলিক লেখকের অভাবের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, আমি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখালেখি করি। তবে সাহিত্য-সংস্কৃতি, রাজনীতিও আমার লেখার বিষয়বস্তু হিসেবে নিয়েছি। আমি মনে করি, চট্টগ্রামে এখনও মৌলিক সৃষ্টিশীল বইয়ের অভাব রয়েছে। মৌলিক চিন্তা যারা করেন বা যারা মৌলিক চিন্তার লিখা লিখতে পারেন, তারা ঢাকায় অথবা দেশের বাইরে চলে যাচ্ছেন। তবে চট্টগ্রামকে ভালোবেসে ড. অনুপম সেন, জামাল নজরুল ইসলাম, প্রফেসর মোহাম্মদ নজরুল ইসলামরা থেকে গেছেন। সাংবাদিক ও কবি আবুল মোমেনও একজন মৌলিক লেখক। আমি চাই চট্টগ্রামে আরও অনেক মৌলিক লেখক সৃষ্টি হোক। বইমেলার মাধ্যমে বুদ্ধিবৃত্তি চর্চার বান পড়–ক। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের মাঝে বই পড়ার অভ্যাস বাড়ুক। জ্ঞান চর্চা হোক, যা থেকে আমরা মৌলিক চিন্তার উদ্ভাবক দেখবো।
চট্টগ্রামের বইমেলার ইতিহাস তুলে ধরতে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধা ও সাংবাদিক নাসিরুদ্দিন চৌধুরী বলেন, চট্টগ্রামে বইমেলার সূচনা হয়েছিল ১৯৮৯/৯০ সালের দিকে মুসলিম হলের খোলা জায়গায়। ‘চট্টল ইয়ূথ কয়ার’ নামের একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন এই বইমেলার আয়োজন করে। তখন পুরো ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে ‘একুশ মেলা’ নামে বইমেলা হতো। একুশ মেলার আয়োজনের মূল উদ্যোক্তা ছিলেন চট্টল ইয়ুথ কয়ারের মহাসচিব শিল্পি অরুন চন্দ্র বণিক। এতে আমিও যুক্ত হই। তখন চট্টগ্রামে সৃজনশীল কোন প্রকাশক ছিল না। আজকে জিমনেসিয়ামের মাঠে অনেক প্রকাশক দেখা যায়, তখন তাদের জন্মই হয়নি।
তিনি বলেন, একুশ মেলার উদ্দেশ্য ছিল সৃজনশীল প্রকাশক সৃষ্টি করা। যারা চট্টগ্রাম থেকে লেখকদের বই প্রকাশ করবে। সে সময় চট্টগ্রামের লেখকদের ঢাকায় দৌড়াতে হতো। তখন চট্টগ্রামে ‘বইঘর’ নামে একটিমাত্র প্রকাশনা ছিলো। এটি আর্ট প্রেসের স্বত্ত¡াধিকারী সৈয়দ মোহাম্মদ শফির প্রতিষ্ঠান। আর্ট প্রেস পাকিস্তান আমল থেকে কিছু কিছু বই প্রকাশ করতো, যেগুলো বইঘরের মাধ্যমে প্রকাশ হতো। এখন যারা প্রকাশক হিসেবে প্রসিদ্ধি অর্জন করেছেন বা চেষ্টা চালাচ্ছেন, তাদের অনেকেই মুসলিম হলে একুশ মেলাই বই কিনে বিক্রি করতো। পরবর্তিতে তারা প্রকাশনায় আত্মনিয়োগ করেন।
নাসিরুদ্দিন চৌধুরী বলেন, একুশ মেলায় সারা দেশ থেকে লেখক, শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবীরা আসতেন। তখন দেশখ্যাত বুদ্ধিজীবীদের মেলা বসে যেতো মুসলিম হলে। সে বইমেলা সাংস্কৃতিক উৎসবে পরিণত হতো। বই অনুরাগীরা ছুটিতে আসতেন। সমস্ত চট্টগ্রামের বৈকালিক মেলায় পরিণত হতো মুসলিম হল মাঠ।
তিনি বলেন, ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো একুশে ফেব্রুয়ারিকে স্বীকৃতি দেয়ার পর তৎকালীন মেয়র এবিএম মহিউদ্দীন চৌধুরী একটি কমিটি গঠন করেন। সে কমিটিতে মহিউদ্দীন চৌধুরী চেয়ারম্যান আর আমি মহাসচিব ছিলাম। সে বছর তিন জায়গায় বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়। লালদীঘি, ডিসি হিল এবং মিউনিসিপ্যাল স্কুল মাঠ। পরবর্তিতে বইমেলার সাথে ড. অনুপম সেন, আবদুল্লাহ আল হারুনরাও যুক্ত হন।
বরেণ্য এ সাংবাদিক বলেন, ১৯৯৯ সালে যখন সিটি কর্পোরেশনের সাথে বইমেলা উদযাপনের কথা বলে, তখন আমি এর বিরোধিতা করি। তখন আমি বলেছিলাম, বইমেলা প্রাণের মেলা, জনগণের স্বতঃর্স্ফুতভাবে এ মেলা হোক। কোন প্রতিষ্ঠানের অধীনে গেলে এটি প্রাণশক্তি হারাবে।
উল্লেখ্য, মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক নাসিরুদ্দিন প্রকাশিত গ্রন্থসমূহের মধ্যে আছে ‘মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম’, জহুর আহমদ চৌধুরী; জীবন ও কর্ম’, ‘জহুর আহমদ চৌধুরী স্মারকগ্রন্থ’, ‘আমীর হোসেন দোভাষ স্মারকগ্রন্থ’, ‘শেখ মোজাফ্ফর আহমদ স্মারকগ্রন্থ’, ‘মানিক চৌধুরী স্মারকগ্রন্থ’, ‘নুরুদ্দিন জাহেদ মঞ্জু স্মারকগ্রন্থ’, ‘শহীদ মুরিদুল আলম- হে প্রণম্য অগ্নি’ ও ‘ডা. ছৈয়দুর রহমান চৌধুরী সংবর্ধনা’সহ আরো অনেক গ্রন্থ।