মেঘ

127

একটু আগে চাকরিটা ছেড়ে দিলাম। সাধারণত মাথা গরম করে আমি কোনো সিদ্ধান্ত নিই না। কিন্তু কখনও কিছু ঘটনায় মস্তিষ্ক এতটাই উত্তেজিত হয়ে যায় যে তখন নিজের উপর আর কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না।
এই দুর্মূল্যের বাজারে হঠাৎ চাকরি চলে গেলে চাকরি পাওয়া যে কত কষ্ট, তা আমার চেয়ে বেশি আর কে জানে! কিন্তু ইস্তফাপত্র লেখার সময় কেমন একটা জান্তব ঘোর কাজ করছিল। সমস্ত ব্যাপারটা এতটাই তাৎক্ষণিক ঘটে গেল যে ভাবনার কোনো অবকাশ ছিল না।
তানভির আহমেদ, অফিসে আমার বিভাগীয় প্রধান, গত পাঁচ বছর ধরে আমার পদোন্নতি আটকে রেখেছেন। কেন পদোন্নতি হচ্ছে না, সে ব্যাপারে কোনো ব্যাখ্যা নেই। অফিসের নিয়ম হলো, বিভাগীয় প্রধানের সুপারিশ ছাড়া কারো পদোন্নতি হবে না।
আমি এই প্রতিষ্ঠানের কাজে যোগ দিয়েছি প্রায় ছয় বছর আগে। স্বাভাবিক নিয়মে তিন বছরের মধ্যে একটা পদোন্নতি হওয়ার কথা; আর পরবর্তী তিন বছরে দ্বিতীয় পদোন্নতি।
আগে যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করতাম, সেখানে ভালোই ছিলাম। শরিফ ভাই, মানে এই অফিসে আমার বিভাগের পূর্ববর্তী বিভাগীয় প্রধান, ঐখান থেকে কাজ ছাড়িয়ে আমাকে এখানে নিয়ে আসেন। বলেছিলেন এই প্রতিষ্ঠানে আমার ভবিষ্যৎ অত্যন্ত উজ্জ্বল; আর তাছাড়া তিনি তো আছেন, সব দেখভাল করবেন।
কাজেই আমার বন্ধুর খালাত ভাই শরিফ ভাইয়ের কথায় আগের কর্মস্থলে ইস্তফা দিয়ে এখানে যোগ দিলাম। কিন্তু আমার কপালটাই বোধ হোয় খারাপ। আমি এখানে যোগ দেওয়ার ছয় মাসের মাথায় শরিফ ভাই একটা বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে চাকরি পেয়ে চলে যান। যাওয়ার সময় আমাকে বলে যান, “কোন চিন্তা কোরো না, তানভির তোমাকে দেখবে। আমি ওকে বলে দিয়েছি।”
তিনি যে কী বলে দিয়েছিলেন, আমি জানি না। তবে এই অফিসে ছয় বছর আগে আমি যে পদে যোগ দিয়েছিলাম, এখনও একই পদে কাজ করে যাচ্ছি। বছর বছর শুধু বার-তেরশ টাকা করে ইনক্রিমেন্ট হচ্ছে। অফিসের হিসেবে মূল বেতনের টেন পারসেন্ট। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মোট বেতনের ফোর পারসেন্টের চেয়েও কম। ঐদিকে বাজারে মূল্যস্ফিতি ফাইভ পারসেন্টের উপরে। তাই বেতনের টাকা দিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছি। অথচ আমার জুনিয়রদের অনেকেই পদোন্নতি পেয়ে এখন ভদ্র জীবন যাপন করছে। আর আমি যেখানে থাকি, তা বলতে গেলে বস্তিপাড়া।
অবশ্য অফিসে শুভাকাক্সক্ষী দাবিদার কয়েকজন সহকর্মী পদোন্নতির জন্য আমাকে ভিন্ন পথে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। তাঁদের মতে আমি আগের বস কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত বলে বর্তমান বসের আস্থাভাজন নই। তাই বসের আস্থা অর্জনের প্রতি মনোযোগ দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তাঁরা।
বলতে দ্বিধা নেই বসের আস্থা অর্জনের জন্য তাঁরা যেসব উপায় বাতলে দিয়েছেন সেগুলো আমার রুচির সাথে যায় না। তাই এসব আমি করতে পারি না। এতে আমার সহকর্মীরা কিঞ্চিত বিরক্ত। সোহেল সাহেব তো সেদিন মুখের উপর বলেই দিলেন, “তাহলে যান, রুচি ধুয়ে ধুয়ে পানি খান গিয়ে।”
পারুল, মানে আমার স্ত্রী, অত্যন্ত ধৈর্যের সাথে এতদিন দারিদ্র্যকে সহ্য করে যাচ্ছিল। তার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেল গতকাল। আমি তার দোষ দেখি না। বাসায় একই দিনে তিন তিনবার জল ঢুকলে কার মাথা ঠিক থাকে!
গতকাল ছিল সাপ্তাহিক ছুটির দিন। আরাম করে বেশ বেলা পর্যন্ত ঘুমানোর কথা। কিন্তু আমাকে বিছানা ছাড়তে হলো কাক ডাকা ভোরে। মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল ভোররাত থেকেই। সেই বৃষ্টিতে জমতে থাকা জল ক্রমান্বয়ে বেড়ে ঢুকে পড়ল বাসায়। জল সেঁচে বের করতে করতে দুপুর হয়ে গেল। আমি আর বৌ দুজনেই কাহিল।
বিকেলেই দেখি বাড়ির আঙিনায় আবার জল জমছে। ব্যাপার কী! বৃষ্টি নেই, জল আসছে কোথা থেকে? পরে জানলাম, পাশের বড় নর্দমা উপচে জোয়ারের জল ঢুকে পড়েছে আঙিনায় এবং একটু পরে বাসার ভিতরে। সেই জল সেঁচে বাসা পরিষ্কার করতে বেজে গেল রাত দশটা।
যখন চূড়ান্ত পরিশ্রান্ত হয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছি, তখনই আবার শুরু হলো মুষলধারে বৃষ্টি। এইবার আর বেশি সময় নিলো না; ঘন্টাখানেকের মধ্যেই বাসায় তৃতীয়বার জল ঢুকলো। আমরা দুজনের কেউই বিছানা ছেড়ে নামলাম না। আসলে নামার মতো শক্তি অবশিষ্ট ছিল না। পারুল নামের মেয়েটি অসহায়ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। তার জন্য এ এক সম্পূর্ণ নতুন অভিজ্ঞতা।
পারুলের সাথে আমার বিয়ের এক বছর পূর্তি হলো গত মাসে। ধনীর দুলালী পারুল বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার পাঁচ বছরের জুনিয়র ছিল। আমি যখন মাস্টার্স ফাইনাল দিচ্ছি, তখন সে সবে ভর্তি হয়েছে। তার সাথে ঘটনাক্রমে যেদিন পরিচয় হলো, সেদিন দুজনের কেউই জানতাম না এই পরিচয় একদিন প্রণয় এবং পরিণয়ে রূপ নেবে। পাঁচ বছর প্রেম করার পর পরিবারের প্রবল অসম্মতি সত্তে¡ও আমরা বিয়ে করলাম।
এই বাসায় এসেছি মাস দুয়েক হয়। একপ্রকার বাধ্য হয়ে আগের বাসাটা ছেড়ে দিতে হলো। দ্বিতীয় তলার ঐ বাসাটাতে মোটামুটি ভালোই ছিলাম। কিন্তু বাড়িওয়ালা হঠাৎ করে বছর শেষে একসাথে দুই হাজার টাকা ভাড়া বাড়িয়ে দিলো। তার নাকি হোল্ডিং ট্যাক্স বেশি দিতে হচ্ছে! বারশ টাকা ইনক্রিম্যান্টের চাকুরে আমি এই ধাক্কা সামলাতে না পেরে ঐ বাসা ছেড়ে দিয়ে একটু দূরে নীচতলার এই বাসাটাতে উঠে আসলাম। এসেই দুই মাসের মাথায় চরম বাস্তবতার মুখোমুখি হলাম।
সকালে অফিসে আসার সময় বাড়িওয়ালাকে বাসার চাবি দিয়ে বললাম একটা কাজের মহিলা ডেকে আমার বাসাটা পরিস্কার করে দিতে। বাড়িওয়ালা আমাকে দেখে অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, “ঠিক আছে, আপনি কোন চিন্তা করবেন না।” ব্যাটা ভাড়া দেওয়ার সময় বলেছিল পানি উঠে না এই এলাকায়। আমি আর সেই প্রসঙ্গ তুললাম না। বাসায় মূল্যবান জিনিষপত্র বলতে গেলে নেই। টিভি, ফ্রিজ আজকাল কেউ চুরি করে না। কাজেই সেদিক থেকে আমি নিশ্চিন্ত।
পারুলকে রেখে এলাম তার মেজ মামার বাসায়। রিকশা থেকে নামার সময় সে বললো, এই বাসা ছেড়ে আরেকটা বাসা ঠিক না করা পর্যন্ত সে আর আসবে না।
অফিসে গিয়ে এই প্রথম বসকে আমার পদোন্নতির ব্যাপারে বললাম। ছয় বছরে যে আমার অন্তত একটা পদোন্নতি পাওনা হয়ে আছে, তা তাঁকে মনে করিয়ে দিলাম এবং সবশেষে একপ্রকার মরিয়া হয়ে আমার বাসার দুর্দশার কথাও তাঁকে জানালাম।
তিনি আমার দিকে এমন ভঙ্গিতে তাকালেন, মনে হলো রাস্তার একজন ভিখিরি তাঁর কাছে ভিক্ষা চাইছে। মুখে বললেন, “দেখি কী করা যায়।”
আমি বললাম, “স্যার, একটু তাড়াতাড়ি যদি হয়, তবে ভালো হয়। আপনি তো সবই শুনলেন।”
তিনি বললেন, “তাড়াতাড়ি বললেই তো তাড়াতাড়ি করা যায় না, অফিসিয়াল সিস্টেমেই তো সবকিছু করতে হবে। আমি তো আর মালিক না যে চাইলে কালকেই আপনাকে প্রোমোশন দিয়ে দিলাম।”
আমি বললাম, “স্যার, আপনি আমার ডিপার্টমেন্টের হেড। আমার প্রোমোশনটা ডিউ হয়ে আছে। আপনি সুপারিশ করলেই প্রোমোশনটা হয়ে যায়। ভ্যালিড গ্রাউন্ড আছে। আমার জুনিয়রদের প্রোমোশন হয়ে গেল, আমারটাই শুধু আটকে আছে।”
তিনি বললেন, “তার নিশ্চয়ই সঙ্গত কারণ আছে।”
আমি বললাম, “সঙ্গত কারণটা কী আমাকে বলুন স্যার। আমার কি পারফরম্যান্স ভালো না? আমি কি অফিসের শৃঙ্খলা পরিপন্থী কোনো কাজে লিপ্ত?”
তিনি বললেন, “এত কৈফিয়ত তো আপনাকে দিতে পারবোনা। মনে রাখবেন, অফিসের কিছু নিজস্ব পলিসি থাকে। সেই অনুযায়ীই সব সিদ্ধান্ত হয়।”
আমি বললাম, “তাহলে সেই পলিসি সব স্টাফদের জানা থাকা উচিৎ। সারাদিন কাজ করেও আমার প্রোমোশন হয়না, আর অফিসে শুধু আসা-যাওয়ার মধ্যে থাকাদের অনেকের প্রোমোশন হয়ে যায়। এই পলিসি কোন স্ট্যান্ডার্ডের ভিত্তিতে করা তা জানতে পারলে ভালো হতো স্যার।”
বস বললেন, “তুষার সাহেব, আপনি কিন্তু আপনার কলিগদের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ তুলছেন। আসা-যাওয়ার মধ্যে থাকা বলতে আপনি কাকে কাকে মিন করছেন ক্লিয়ার করুন।”
আমি বললাম, “আমি কাউকে মিন করছি না, কারও বিরুদ্ধে আমার কোনো অভিযোগও নেই। আমি শুধু নিজের কাজ যথাযথভাবে করে যেতে চাই, এবং আমার প্রাপ্য সব ন্যায্য সুযোগ-সুবিধা পেতে চাই। দ্যাটস অল।”
বসের রুম থেকে বের হয়ে আর কাজে মন বসাতে পারিনি। মনের মধ্যে সারাক্ষণ কে যেন বার বার বলছে, “তুষার, চাকরিটা ছাড়। চাকরিটা ছেড়ে দে শালা।” কোনোরকমে অফিস-সময় পার করে বের হওয়ার সময় এডমিন এক্সিকিউটিভ সাগর বাবুর হাতে ইস্তফাপত্রটি দিয়ে আসলাম। তিনি কিছুই বুঝতে না পেরে একবার আমার দিকে আরেকবার কাগজটির দিকে তাকাচ্ছেন। তাঁকে হতভম্ব অবস্থায় রেখেই অফিস থেকে বেরিয়ে এলাম।
রাস্তায় নেমে ভাবছি কোথায় যাবো? বাড়িওয়ালা হয়তো কাউকে দিয়ে বাসাটা পরিষ্কার করেছে এতক্ষণে। কিন্তু বাসায় গিয়ে হবেটা কী? পারুল বলেছে নতুন বাসা না নেওয়া পর্যন্ত সে আর আসবে না। এইদিকে চাকরিটাও দিলাম ছেড়ে।
হাঁটতে হাঁটতে মেহেদিবাগ থেকে চলে আসছি চকবাজারের পথেই। আমার বাসা পশ্চিম বাকলিয়া। এই পথ দিয়েই যাই প্রতিদিন কিছুদূর হেঁটে কিছুদূর ট্যাম্পু করে। আজকে শুধু হেঁটেই যাচ্ছি পয়সা বাঁচানোর জন্য। কে বি ফজলুল কাদের সড়ক দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পারুলের কথা ভাবছি। তার জন্য মনটা খুব খারাপ লাগছে।
মাত্র মাস্টার্স শেষ করলো পারুল। রেজাল্ট হয়েছে প্রায় দুই মাস। পরীক্ষা শেষ হওয়ার সাথে সাথে বিসিএসের জন্য দিনরাত প্রস্তুতি নিচ্ছে। রান্নাবান্না থেকে শুরু করে বাসার সব কাজ সামলে আবার পড়াশুনাটাও ঠিকমত চালিয়ে গেছে সে গত এক বছর। আমি তাকে কোনো স্বচ্ছলতা দিতে পারিনি। একটা ন্যুনতম মধ্যবিত্তের জীবন, যে চাওয়াটা তার মত একটা মেয়ের জন্য অযৌক্তিক কিছু নয়, সেই স্বাচ্ছন্দ্যও আমি তাকে দিতে পারিনি। আর কিছু না হোক, একটা ন্যুনতম ভালো বাসায় থাকার তো দাবি সে করতেই পারে।
এই মুহূর্তে চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে মনে খুব প্রশান্তি লাগছে। এইভাবে চাকরি করার চেয়ে না-করাই ভালো। “যঃ পলায়তি সঃ জীবতি।”
একটু আগের খিটখিটে ভাবটা চলে গেছে পুরোপুরি। পারুলকে খবরটা জানাতে হবে। জানিনা সে কীভাবে নিবে বিষয়টা। আমি পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করলাম। দেখি সেটা বন্ধ হয়ে আছে। ফোনে যে চার্জ ছিল না, তা আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। বাসায় সারারাত বিদ্যুৎ ছিল না। সকালে অফিসেও নানান ঝামেলায় চার্জ দেওয়ার কথা মনে ছিল না।
বাসার কাছাকাছি পৌঁছে গেছি। চারদিকে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। আমি ভাবছি রাতটা আজকে কীভাবে কাটাবো? জানি না বাসার হাল কী? বাড়িওয়ালা কি কাজের লোক পেয়েছিল? না-পেয়ে কি আমাকে ফোন দিয়ে বলতে চেয়েছিল, ভাই, দুঃখিত, এই বৃষ্টি বাদলার দিনে কাজের লোক পাওয়া গেলো না। কিন্তু আমার ফোন তার আগেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল?
গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই বাসার জানালার ভিতর আলো দেখতে পেলাম। কী ব্যাপার? বাড়িওয়ালা কি এখন কাজ শুরু করলো? সারাদিন বুঝি তবে সত্যিই কাজের লোক পাওয়া যায়নি? কলাপসিবল গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকে দেখি বাসার দরজা বন্ধ। দরজা বন্ধ করে কী কাজ করছে? আমার সন্দেহ হলো। কল বেল টিপলাম। একবার, দুইবার, তিনবার। কোনো সাড়া নেই। আবার টিপতে যাবো, এমন সময় দরজা খুলে গেলো। দরজা খুললো এক অপরিচিত মহিলা। জিজ্ঞেস করলো, “কাকে চান?”
আমি বললাম, “আপনি কে? বাড়িওয়ালা কি আপনাকে দরজা বন্ধ করে কাজ করতে বলেছে? এতক্ষণ বেল বাজালাম, আপনি খুলছিলেন না কেন? কী করছিলেন?” মহিলা কোনো জবাব না দিয়ে চুপ করে রইল।
তাকে পাশ কাটিয়ে ভিতরে ঢুকে আমি অবাক। মেঝে একেবারে পরিষ্কার করে ঝকঝকে তকতকে করে রেখেছে। তা দেখে আমার রাগ একটু প্রশমিত হলো। আমি বললাম, “আপনার কাজ শেষ হয়েছে? নাকি ভিতরে আরও বাকি আছে?”
মহিলা বললো, “কাজ তো মেসিমাম আন্টিই করছে। আমি তাইনরে হেলেপ করলাম।”
আমি বললাম, “আন্টি মানে? বাড়িওয়ালার স্ত্রী? কী বলছেন! উনি কেন কাজ করতে গেলেন?”
মহিলা বললো, “জ্বে না, ছোট আন্টি। তাইনে ভিতরে পরিষ্কার কইরতে আছে। গিয়া দেহেন।”
বেডরুমে ঢুকে তো আমি অবাক! পারুল মেঝে পরিষ্কার করছে। দেখে আমার চোখে জল এসে গেল। বললাম, “পারুল, তুমি কখন এলে?”
সে বললো, “আমি তো দুপুরেই এসেছি। এটা ঝর্না আন্টি-মামার বাসায় কাজ করে।”
আমি বললাম, “কিন্তু তুমি তো বলেছিলে বাসা না পাল্টালে আর আসবে না!”
সে বললো, “হ্যাঁ বলেছিলাম। আমিতো এখানে থাকতে আসিনি। তুমি থাকবে, তাই পরিষ্কার করে দিতে এসেছি। আমার হাজব্যান্ড এইরকম নোংরা বাসায় কীভাবে থাকবে!”
আমার সত্যিই কান্না চলে এলো। আমি বললাম, “পারুল, আমি চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে এলাম।”
সে প্রথমে আমার দিকে কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। তারপর হাসিমুখে বললো, “তাহলে তো ভালোই হলো। এই বাসায় আর বেশিদিন থাকা লাগবে না। বাড়িওয়ালাকে বলে দিও আমরা এই মাসে বাসা ছেড়ে দিব।”
আমি বললাম, “তাহলে আমরা থাকবো কোথায়?”
সে বললো, “তা জানিনা, তবে এই বাসায় আর না। শোনো, গত মাসে যে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ইন্টারভিউ দিয়ে এলাম, সেখান থেকে আজকে ফোন দিয়েছিল। আগামী মাস থেকে জয়েন করতে বলেছে। বেতন আমি যা ডিম্যান্ড করেছিলাম, তা-ই দেবে। কী বল? জয়েন করবো?”
আমি বললাম, “তুমি এইরকম একটা খবর আমাকে এত পরে জানাচ্ছো?”
সে বললো, “তোমাকে সকালে ফোন দিয়েছিলাম। কিন্তু তোমার ফোন বন্ধ ছিল। বেতন যা পাবো, তা দিয়ে আপাতত আমাদের চলে যাবে। তাছাড়া তুমি তো আরে বেশিদিন বেকার থাকবে না!”
আমি পারুলের চোখেমুখে এক অদ্ভূত খুশির আভা দেখতে পেলাম। এটা কি জীবনে প্রথম চাকরি পাবার প্রতিক্রিয়ায়, নাকি অন্য কোনো কারনে, তাৎক্ষণিক আমি তা বুঝতে পারলাম না।
তার মুখের দিকে তাকিয়ে সারাদিনের সমস্ত গ্লানি আমি মুহূর্তেই ভুলে গেলাম। যে রাতকে আমি মনেপ্রাণে এড়ানোর চেষ্টা করছিলাম, দৈবচক্রে সেই রাত-ই এখন আমার কাছে সুখের এক ভিন্ন মাত্রা নিয়ে উপস্থিত।
পারুল এখন রান্নাঘরে ঝর্না আন্টিকে নিয়ে রাতের খাবার আয়োজন করছে। মাঝে মাঝে তাদের উচ্চস্বরের হাসির আওয়াজ কানে আসছে। একটু আগে আমাকে এক কাপ গরম চা পরিবেশন করা হয়েছে। আমি সোফায় বসে আয়েশ করে চায়ে চুমুক দিচ্ছি। জানালা দিয়ে দেখলাম আকাশে মেঘ কেটে গিয়ে তারা ঝিলমিল করছে। আপাতত আর বৃষ্টির সম্ভাবনা নেই। এই মুহূর্তে জীবন অনেক আনন্দময়।