মৃত্যুর মিছিলে পুরো পরিবার

58

ভবনে আগুন লেগেছে; পরিবারকে বাঁচাতে আদরের সন্তান আর স্ত্রীর হাত ধরে জীবন বাঁচানোর চেষ্টায় রওনা হয়েছিলেন শহিদুল কিরমানী রনি। এদিকে নিচতলার গ্যারেজে আগুনের ভয়াবহতা দেখে নিরাপত্তাকর্মী লুৎফুর রহমান চিৎকার করে ভবনের সবাইকে নিচে নামতে নিষেধ করেছিলেন।
কিন্তু আতঙ্ক আর হট্টগোলের মধ্যে লুৎফুরের সেই চিৎকার শুনতে পাননি রনি। তৃতীয় তলার ফ্ল্যাট থেকে যখন তারা বের হলেন, আগুনের লেলিহান শিখা পৌঁছে গেছে তৃতীয় তলার সিঁড়িতে। পুরো ভবন তখন ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন।
ফ্ল্যাট থেকে বের হওয়ার পরপরই হাত ফসকে কোথায় যেন ছিটকে পড়ে রনির আদরের সন্তান এ কে এম রুশদি। ধোঁয়ার মধ্যে রনি আর তার স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌসীও বেশিদূর এগোতে পারেননি।
গত ২৬ ফেব্রূয়ারি রাতে ঢাকার দিলু রোডে পাঁচতলা একটি ভবনে আগুন লাগার পর আধা ঘণ্টার চেষ্টায় তা নিয়ন্ত্রণে আনে ফায়ার সার্ভিস। আগুন নেভানোর পর ভবনের দোতলার একটি বায়িং হাউজের কর্মী আব্দুল কাদের লিটনের লাশ পাওয়া যায় নিচতলায় গ্যারেজের পাশের একটি ঘরে; সেখানেই তিনি থাকতেন।
তৃতীয় তলার সিঁড়িতে পাওয়া যায় চার বছরের রুশদি এবং ষষ্ঠতলার কলেজছাত্রী আফরিন জাহান জুঁথির পোড়া লাশ। ভিকারুন্নেসা স্কুল অ্যান্ড কলেজের ছাত্রী জুঁথির এবারই এইচএসসি পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল।
মগবাজারের এ জি চার্চ স্কুলের প্লে গ্রূপের ছাত্র রুশদির বাবা আর মাকে সেদিনই শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়েছিল, কিন্তু তাদেরও বাঁচানো যায়নি। গত রবিবার সকালে জান্নাতের মৃত্যুর পর গতকাল সোমবার সকালে রনিও পাড়ি জমান না ফেরার দেশে।
রনি হাতিরঝিল পুলিশ প্লাজায় ‘ভিআইভিপি এস্টেট ম্যানেজমেন্ট’ নামে একটি কোম্পানির ফাইন্যান্স ম্যানেজার ছিলেন। আর তার স্ত্রী জান্নাত বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যাল লিমিটেডের অর্থ বিভাগে চাকরি করতেন। নরসিংদীর শিবপুরের ইটনায় তাদের বাড়ি।
রনির ভগ্নিপতি মনিরুজ্জামান বলেন, গত শুক্রবার রাতে ইটনায় পারিবারিক কবরস্থানে রুশদিকে দাফন করেন তারা। রবিবার রাতে তার পাশেই শোয়ানো হয় তার মা জান্নাতকে। আজ রনিকেও দাফন করতে হবে ওদের পাশে। সবাই শেষ হয়ে গেল আগুনে কেউ বাঁচলো না। খবর বিডিনিউজের
রনির মা পারভীন বেগম মারা গেছেন ২০০৬ সালে। বোন নাসরিন আক্তার রঞ্জনা আর বাবা একেএম শহিদুল্লাহ এখন বাকহারা প্রায়।
মনিরুজ্জামান জানান, বৃহস্পতিবার দুপুর পর্যন্ত চেতনা ছিল রনির, তখন তার কাছ থেকেই শেষ মুহূর্তের কিছু ঘটনা তারা জানতে পেরেছেন। আগুন লাগার পরে রুশদি আর জান্নাত ভাবিকে নিয়ে তৃতীয় তলার ফ্লাট থেকে বের হয়েছিল রনি। সিঁড়িতে আসার পর নিচতলার গ্যারেজে বিস্ফোরণ ঘটে। ওই ঝাঁকুনিতে রুশদি হাত থেকে ফঁসকে যায়। ধোঁয়ার মধ্যে ভাবিকেও হারিয়ে ফেলে রনি।
মনিরুজ্জামান বলেন, হাত থেকে ছিটকে যাবার সময় রুশদির পায়ে একবার ধরতে পেরেছিলেন রনি। কিন্তু আগুনের তাপ আর ধোঁয়ায় সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়। ছেলে আর স্ত্রীকে হারিয়ে হাঁমাগুড়ি দিয়ে আবার ফ্ল্যাটে ফিরতে পেরেছিলেন রনি। বাথরুমে গিয়ে পানিও ঢেলেছিলেন গায়ে। কিন্তু শরীরের ৪৩ শতাংশ আগুনে পুড়ে যাওয়ায় তাকেও আর বাঁচাতে পারেননি চিকিৎসকরা।
আগুন লাগার পর নিচতলার গ্যারেজে কীসের বিস্ফোরণ ঘটেছিল জানতে চাইলে তেজগাঁও ফায়ার স্টেশনের সিনিয়র অফিসার ফয়সালুর রহমান বলেন, গ্যারেজে সেদিন পাঁচটি গাড়ি ছিল, সবগুলোই পুড়ে গেছে। দু’টি গাড়িতে সিলিন্ডার ছিল, তবে সেগুলো অক্ষত রয়েছে। গাড়ির চাকায় আগুন লেগে এমন ভাবে শব্দ করে ফেটেছে যে স্বাভাবিকভাবে মনে হবে সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়েছে। তবে সেদিন কোনো গাড়ির সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়নি।
ওই ভবনের নিরাপত্তাকর্মী লুৎফর রহমানের ভাষ্য অনুযায়ী, গ্যারেজের একটি ইলেকট্রিক বোর্ডে আগুন লাগার পর তা পাশে রাখা একটি কাঠের চৌকিতে ছড়ায়। এরপর তা গাড়িতে এবং ভবনের ওপরের অংশে ছড়ায়।