মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামিদের জন্য কনডেমড সেল আসলে কী?

39

বাংলাদেশের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত বহু নারীকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হলেও এখন পর্যন্ত কোনো নারীর মৃত্যুদন্ড আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যকর হয়নি। বাংলাদেশে গত বছরের জুন মাসে বরগুনায় রিফাত শরীফ হত্যার ঘটনায় রিফাতের স্ত্রী মিন্নিসহ ছয়জনকে, যাদের গত বুধবার মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়েছে, চিরাচরিত নিয়ম অনুযায়ী তাদের কারাগারের ‘কনডেমড সেল’ এ রাখা হয়েছে।
মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামিদের কারাগারের যে বিশেষ সেলে রাখা হয় সেটিকে কনডেমড সেল বলা হয়।
কারাগারে থাকা অন্যান্য বন্দিদের তুলনায় কনডেমড সেলের বন্দিদের জন্য ভিন্ন আচরণবিধি রয়েছে এবং অন্যান্য বন্দিদের থাকার জায়গার সাথেও কনডেমড সেলের বেশ পার্থক্য রয়েছে।
‘কনডেমড সেল’ এর সাথে কারাগারের অন্যান্য সেলের পার্থক্য কী?
কোনো কারাগারে মৃত্যুদন্ড পাওয়া আসামিদের অন্যান্য অপরাধীদের চেয়ে আলাদা ধরণের কক্ষে রাখা হলেও বাংলাদেশের জেল কোড বা কারাবিধি মোতাবেক সেরকম কোনো আইন নেই বলে জানান সাবেক কারা উপ মহাপরিদর্শক শামসুল হায়দার সিদ্দিকী। কারাবিধি অনুযায়ী মৃত্যুদন্ড পাওয়ার পর একজন বন্দীকে কারাগারে সার্বক্ষণিক পাহারায় রাখা, দর্শণার্থীদের সাথে দেখা করার বিষয়ে সীমাবদ্ধতা আরোপ করা হলেও আলাদা কক্ষে রাখার বিষয়টি আইনে নির্দিষ্ট করে উল্লেখিত নেই।
তবে কারা কর্তৃপক্ষ সাধারণ অপরাধীদের চেয়ে কনডেমড সেলের আসামিদের একটু ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখেন বলে মন্তব্য করেন শামসুল হায়দার সিদ্দিকী। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের জেল কোড বা কারাবিধিতে ফাঁসির আসামিদের কনডেমড সেলে রাখার মত কোনো বিষয় উল্লেখ না থাকলেও তাদের আলাদা ধরণের কক্ষে রাখা হয়ে থাকে। এটিকে এক ধরণের রেওয়াজ বলা যেতে পারে’।
একটি কনডেমড সেলে সাধারণত একজন বা তিনজন বন্দী রাখা হয়ে থাকে। শামসুল হায়দার বলেন, ‘সাধারণত ধারণা করা হয় যে দুইজন বন্দী থাকলে গোপনে পালানোর পরিকল্পনা করতে পারে, তবে তিনজন থাকলে পরিকল্পনা আর গোপন থাকে না। ঐ ধারণা থেকেই দুইজন বন্দী একটি কনডেমড সেলে রাখা হয় না’।
কারাবিধি অনুযায়ী, একজন বন্দীর থাকার জন্য ন্যূনতম ৩৬ বর্গফুট (৬ ফিট বাই ৬ ফিট) জায়গা বরাদ্দ থাকতে হবে। তবে বাংলাদেশের জেলগুলোতে কনডেমড সেলের ক্ষেত্রে এই আয়তন কিছুটা বেশি হয়ে থাকে বলে জানান শামসুল হায়দার সিদ্দিকী।
একজন বন্দী থাকার কনডেমড সেল সাধারণত ১০ ফুট বাই ৬ ফুট আয়তনের হয়ে থাকলেও বাংলাদেশের অনেক জেলেই সেলের মাপ কিছুটা বড় হয়ে থাকে বলে জানান শামসুল হায়দার সিদ্দিকী। আর তিনজন বন্দী যেসব সেলে রাখা হয় সেগুলোর আয়তন আরো বড় হয়ে থাকে।
কনডেমড সেলের ভেতরে আলো-বাতাস চলাচলের জন্য সাধারণত অন্যান্য সেলের তুলনায় অনেক ছোট আকারের জানালা থাকে। আর এসব সেলে থাকা বন্দীদের দিনে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সেলের বাইরে চলাচলের অনুমতি দেয়া হয়।
শামসুল হায়দার সিদ্দিকী বলেন, ‘একসময় কনডেমড সেলের বন্দীদের নিজেদের সেলের বাইরে যাওয়ার বাধ্যবাধকতা ছিল না। সেল থেকে বছরের পর বছর বের হননি, এমন উদাহরণও আছে। কিন্তু একটা ছোট ঘরের ভেতরে দীর্ঘ সময় থাকতে থাকতে অসুস্থ হয়ে মৃত্যু ঝুঁকি তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে, তাই বর্তমানে সব বন্দিদেরই দিনের একটা নির্দিষ্ট সময় বাইরে চলাফেরা করতে দেয়া হয়’।
কনডেমড সেলে থাকা বন্দীরা মাসে একদিন দর্শণার্থীদের সাথে দেখা করার সুযোগ পান। আগে একসময় জেলের ভেতরেই কনডেমড সেলে থাকা বন্দিদের সাথে দেখা করতে আসতে পারতো দর্শণার্থীরা। তবে এখন মাসে একদিন জেল গেটে তারা দর্শণার্থীদের সাথে দেখা করার সুযোগ পান।
একজন বন্দি একবারে সর্বোচ্চ ৫ জন দর্শণার্থীর সাথে দেখা করতে পারেন। কারা কর্তৃপক্ষ সাধারণত কনডেমড সেলের প্রত্যেক বন্দির কাছ থেকে তার নিকটাত্মীয়দের তালিকা নেন, নির্দিষ্ট কয়েকজন ছাড়া কনডেমড সেলের বন্দির সাথে দেখা করতে অনুমতি দেয় না কারা কর্তৃপক্ষ। খবর বিবিসি বাংলার
শামসুল হায়দার সিদ্দিকী বলেন, ‘সাধারণত মাসে একদিন বন্দিদের সাথে দর্শণার্থীদের দেখা করার অনুমতি দেয়া হলেও বিশেষ বিবেচনায় কখনো কখনো ১৫ দিনের মধ্যেও কনডেমড সেলের আসামির সাথে দর্শণার্থীদের দেখা করতে দেয়া হয়’।
বাংলাদেশের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত বহু নারীকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হলেও এখন পর্যন্ত কোনো নারীর মৃত্যুদন্ড আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যকর হয়নি। মাঝেমধ্যে দেখা যায় কোনো একটি বিচারিক আদালতে কোনো ব্যক্তির মৃত্যুদন্ডের আদেশ দেয়া হলেও পরবর্তীতে উচ্চ আদালতের রায়ে তার মৃত্যুদন্ডাদেশ পরিবর্তিত হয়েছে।
বাংলাদেশে এই ধরণের বেশকিছু ঘটনা রয়েছে যেখানে মৃত্যুদন্ড পাওয়া আসামি উচ্চ আদালতে আপিল করার পর তার সাজা কমেছে বা মওকুফ হয়েছে। আর এই ধরণের ক্ষেত্রে চূড়ান্ত বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে সাধারণত দীর্ঘসময় লেগে থাকে বলে মন্তব্য করেন শামসুল হায়দার সিদ্দিকী। এসব ক্ষেত্রে মৃত্যুদন্ডের রায় উচ্চতর আদালত থেকে বাতিল না হওয়া পর্যন্ত কনডেমড সেলেই থাকতে হয় বন্দীকে।
শামসুল হায়দার বলেন, ‘যতদিন পর্যন্ত উচ্চ আদালত মৃত্যুদন্ডের আদেশ বাতিল না করছে, ততদিন পর্যন্ত এ বন্দিকে কনডেমড সেলেই থাকতে হয়। কারা বিধি অনুসরণ করে কনডেমড সেল থেকে গিয়েই আদালতের কার্যক্রমে যোগ দিতে হয় বন্দীকে’।
আর এরকম অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে বন্দীকে বছরের পর বছর কনডেমড সেলে থাকতে হচ্ছে। বাংলাদেশে দশ বছরেরও বেশি সময় ধরে কোনো বন্দীর কনডেমড সেলে থাকার নজির আছে বলে জানান শামসুল হায়দার সিদ্দিকী। তবে বাংলাদেশের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত বহু নারীকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হলেও এখন পর্যন্ত কোনো নারীর মৃত্যুদন্ড আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যকর হয়নি।