মৃত্যুই একটি অসাধারণ ইতিহাস

104

চট্টগ্রামকে বলা হয় বিপ্লব তীর্থ ভূমি। এ অঞ্চলে অনেক বিখ্যাত বিখ্যাত বিপ্লবী জন্মগ্রহণ করেছেন। তাঁদের মধ্যে চট্টগ্রামের কৃতিজন ও পৃথিবীর উদ্ভাসিত মানুষের অন্যতম সূর্য কুমার সেন (মাস্টারদা সূর্যসেন)। সমগ্র পৃথিবীতে বিপ্লবী মানুষের কাছে প্রাতঃস্মরণীয় হয়ে আছে। মাস্টারদা সূর্যসেনের জন্মগত কারণ, স্বাধীনতা ও মানবাধিকার সর্বপরি- তাঁকে ফাঁিসতে ঝুলিয়ে প্রাণনাশসহ ঘটনাবহুল ইতিহাসের কারণে চট্টগ্রাম, বাংলাদেশ ও মাস্টারদা সূর্যসেন, সূর্য উদয় থেকে অস্ত পর্যন্ত এলাকাতে পরিচিত। আমি গর্ববোধ করি বিপ্লবীদের এই চারণভূমি চট্টগ্রামেই আমার জন্ম। মানুষ যখন অধিকার হারা হয়ে পিঠ দেয়ালে টেকে যায়, তখন সামনের দিকে এগিয়ে যায়। আর এগিয়ে যাওয়ার সাহস সঞ্চারিত স্বপ্ননীল সাহস আসে মাস্টারদা সূর্যসেনের জীবন দান থেকে। জয়ের ইতিহাসে পরাজয়ের পথ রুদ্ধ করে আবারও জয় হওয়ার সাহস আজীবন মাস্টারদা সূর্যসেন এ জাতিকে দিয়ে গেছেন। মাস্টারদা সূর্যসেনের জীবন ও কর্মের ইতিহাসে জানা যায় তিনি ১৮৯৪ সালের ২২ মার্চ চট্টগ্রামের নোয়াপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর গর্বিত পিতার নাম রাজমণি সেন। মাস্টারদা সূর্যসেন ১৯১৬ সালে চট্টগ্রাম স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯১৮ সালে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে আই এ পাস করে বি এ ক্লাসে ভর্তি হন। কিন্তু কোন এক অজ্ঞাত কারণে চট্টগ্রাম কলেজে তাঁর বি এ পড়া সম্ভব হয়নি। ভারতের বহরমপুর ব্রজনাথ কলেজে বিএ পড়বার সময়ে পশ্চিমবঙ্গ বিশেষ করে কলকাতার বিপ্লবী কর্মীদের সংস্পর্শে এসে বিপ্লবী ভাবধারায় অনুপ্রাণিত হন। চট্টগ্রামে বিপ্লবী দলের কেন্দ্রীয় কমিটি গঠনে তিনি অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন। বিএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার কিছুকাল পর তিনি ন্যাশনাল হাইস্কুলে সিনিয়র গ্রাজুয়েট শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯২০ সালে কংগ্রেস কর্মী হিসেবে অসহযোগ আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন। ১৯২১ সালে অসহযোগের আহবানে সমর্থন জানিয়ে বিদ্যালয়ের শিক্ষকতায় পদত্যাগ করে তরুণদের দেশাত্মবোধ শিক্ষা দেবার জন্য ‘সাম্য আশ্রম’ প্রতিষ্ঠা করেন। অসহযোগ আন্দোলন শেষে তিনি ১৯২৩ সালে চট্টগ্রামের দেওয়ান বাজারে অবস্থিত উমাতারা উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে শিক্ষকের পদ গ্রহণ করেন। এ সময় থেকে তিনি তাঁর অনুসারীদের নিকট মাস্টারদা নামেই অধিক পরিচিত হয়ে উঠেন। ১৯২৪ থেকে ১৯২৬ সাল পর্যন্ত সময়ে তিনি গোপনে কয়েকবার কলকাতা গিয়ে যুগান্তর দলের কর্মীদের সাথে যোগাযোগ করেন। চট্টগ্রামে কিভাবে চরমপন্থী কার্যকলাপ আরও শক্তিশালী করা যায় এটাই তাঁর লক্ষ্য হয়ে উঠে। তাঁর কার্যকলাপ তখন পুলিশের নিকট প্রকাশ হয়ে পড়ে। ১৯২৬ সালে ১নং বেঙ্গল অর্ডিনেন্স অনুসারে কলকাতায় তিনি গ্রেফতার হন এবং তাঁকে জেলে আটক রাখা হয়। কিছুদিন পরে তাঁকে রতœগিরি জেলে স্থানান্তর করা হয়।
১৯২৮ সালে অসুস্থ স্ত্রীকে দেখবার জন্য তাঁকে চট্টগ্রামে নিয়ে আসা হয় কিন্তু কিছুদিন পরেই তাঁর স্ত্রীবিয়োগ ঘটে। ১৯২৮ সালের শেষের দিকে তিনি জেলা থেকে মুক্তি পান। মুক্তিলাভের পরেই তিনি কলকাতা ও চন্দনগরের বিপ্লবীদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে চট্টগ্রামে বিপ্লবী সংগঠনে আত্মনিয়োগ করেন। ঐ বছরের ডিসেম্বর মাসে কলকাতা কংগ্রেস অধিবেশনে চট্টগ্রাম থেকে যোগদানকারী প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন। ১৯২৯ সালে চট্টগ্রাম জেলা কংগ্রেসের সম্পাদক নির্বাচিত হন। এ বছরের মে মাসে চট্টগ্রাম জেলা কংগ্রেস সম্মেলনের তিনি প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন। নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন। মাস্টারদা এবং তাঁর অনুসারীরা চট্টগ্রামে একটা সশস্ত্র অভ্যুত্থানের বিষয় নিয়ে সুভাষ বসুর সাথে একান্তে আলোচনা করেন। ১৯৩০ সালে কংগ্রেসের আহবানে আইন অমান্য আন্দোলন মাস্টারদার দলের পক্ষে সুযোগ সৃষ্টি করে। অনন্ত সিং, গনেশ ঘোষ প্রমুখ নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা তরুণদের অস্ত্র চালনা শিক্ষা এবং অস্ত্র সংগ্রহের জন্য তৎপর হয়ে উঠেন। এপ্রিল মাসে গোপনে ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি গঠিত হয় এবং বিপ্লবীরা সশস্ত্র বিদ্রোহের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করে। পরিকল্পনা মতে ১৮ এপ্রিল বিদ্রোহের ঘোষণা পত্র জারি করা হয়। ২২ এপ্রিল সরকারি সৈন্য জালালাবাদ পাহাড় আক্রমণ করলে বিপ্লবীদের সাথে ইংরেজদের সম্মুখ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। জালালাবাদ সংঘর্ষের পর মাস্টারদার নির্দেশে বিপ্লবীরা নূতন রণকৌশল গ্রহণ করেন। নূতন রণকৌশনের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য হলো গ্রামাঞ্চলে বিপ্লবী কর্মকাÐ ছড়িয়ে দেওয়া, অধিক সংখ্যায় তরুণদের ভর্তি করা এবং ইউরোপীয় ও পুলিশদের উপর অতর্কিত আক্রমণ পরিচালনা করা। ১৯৩২ সালে পটিয়ার ধলঘাট গ্রামে পুলিশের সাথে সূর্যসেনের নেতৃত্বে বিপ্লবীদের সংঘর্ষ হয়। ক্যাপ্টেন ক্যামেরন এর নেতৃত্বে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর একটি দল ১৯৩২ সালে ১৩ জুন বিপ্লবীদের আশ্রয়স্থল ঘিরে ফেলে। সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠার সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে ক্যামেরন মারা যান এবং সূর্যসেন, প্রীতিলতা ওয়ার্দ্দেদার ও কল্পনা দত্ত নিরাপদ স্থানে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। শেষ পর্যন্ত এক গ্রামবাসী চট্টগ্রামের গৈরলা গ্রামে সূর্যসেনের লুকিয়ে থাকার তথ্য পুলিশকে জানিয়ে দেন। ১৯৩৩ সালের ১৭ ফেব্রæয়ারির প্রথম প্রহরে একদল গোর্খা সৈন্য গোপন স্থানটি ঘিরে ফেলে। সূর্যসেন পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন। ১৯৩৩ সালের আগস্ট মাসে সূর্যসেনের ফাঁসির রায় হয়। ১৯৩৪ সালের ১২ জানুয়ারি চট্টগ্রাম কারাগারে ফাঁসি কার্যকর হয়। অস্ত্রাগার লুণ্ঠনকে যে দৃষ্টিতেই দেখা যাক না কেন এটা অস্বীকার করবার উপায় নাই যে এ ধরনের বিদ্রোহাত্মক কার্যকলাপ উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে একটি অভিনব ব্যাপার। যুদ্ধক্ষেত্রে লড়াই করবার জন্য ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি (যদিও সদস্যদের মধ্যে অধিকাংশই তরুণ এবং অনভিজ্ঞ) গঠন, সেনাবিভাগ সর্বাধিনায়কের পদ সৃষ্টি, সেনাবাহিনীতে অফিসারদের পদ সৃষ্টি, পদস্থদের সেল্যুট প্রদান রীতি, যুদ্ধের জন্য ঘোষণাপত্র পাঠ (যার ভাষা অত্যন্ত উচ্চমানসম্পন্ন), আক্রমণ পরিকল্পনা প্রণয়ন, আকস্মিক আক্রমণ (যেটিকে অবশ্যই দুর্ধর্ষ বলতে হবে), জালালাবাদ সংঘর্ষ এ সমস্তই রীতিমত যুদ্ধের ন্যায়। হয়ত সূর্যসেনের নেতৃত্বাধীন ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি ছত্রভঙ্গ হয়ে গিয়েছিল কিন্তু পরবর্তীকালে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠনে একরূপ পুরোপুরিই সূর্যসেনের বিপ্লবী কর্মপন্থাকেই অনুসরণ করেছিলেন। সূর্যসেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার আক্রমণ ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে চিরভাস্বর হয়ে থাকবে। মাস্টারদা সূর্যসেনের ফাঁসির ৮৫ বছর অতিবাহিত হলেও এদেশ এবং ভারতবর্ষের স্বাধীনতার ইতিহাসে তিনি কালজয়ী পুরুষ হিসেবে বিবেচিত। ৮৫তম ফাঁসি দিবসে বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি।

লেখক : মরমী গবেষক ও প্রাবন্ধিক