মুম্বাই জঙ্গি হামলার বিচার কতদূর

71

ড. মুহম্মদ মাসুম চৌধুরী

২০০৮ সালের ২৬ নভেম্বর ভারতের বাণিজ্যিক রাজধানী মুম্বাইয়ে ভয়াবহ জঙ্গি হামলা সংগঠিত করে ১৬৪জন নিরাপরাধ মানুষকে হত্যা করা হয়। আহত হন ৩০০জনের অধিক। নিহতের মধ্যে ৩০জনই ছিল ভারতের বাইরে ১৬টি দেশের নাগরিক। তারা প্রায় সবাই ছিলেন তাজমহল প্যালেস হোটেল বা নরিম্যান পয়েন্টে ওবেরয় হোটেলে অবস্থানরত পর্যটক। এই দিনটি ছিল ভারতের ইতিহাসে এক কালো অধ্যায়। এই জঘন্য ঘটনায় বিশ্ববাসী সেদিনে হতবাক হয়েছিল। ২৬ নভেম্বর হতে ২৯ নভেম্বর পর্যন্ত ১০ জঙ্গি এ হামলা চালায়। এ সময় ভারতীয় নিরাপত্তাবাহিনীর সাথে সংঘর্ষে ৯জন জঙ্গি নিহত হয়। শুধুমাত্র ‘আজমল কাসভ’ নামক এক জঙ্গি জীবিত অবস্থায় ধরা পড়ে। তার নিকট জেরা করে জানা যায়, তাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে, পাক কাশ্মিরের রাজধানী মুজজফরাবাদে জঙ্গি সংগঠন ‘লস্কর-ই তাইবা’। তাদের ১৮ মাস প্রশিক্ষণ দিয়ে জঙ্গি হামলা করতে ভারতে প্রেরণ করা হয়। দুনিয়ার মানুষ তখন জানতো এই জঘন্য হামলায় পাকিস্তান জড়িত। তখন পাকিস্তান সরকার তা অস্বীকার করলেও পরবর্তীতে পাকিস্তানের অনেক লেখক সাংবাদিক বুদ্ধিজীবী পাকিস্তানের সরকারকে দায়ি করেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ প্রকাশ্যে স্বীকার করেছেন, মুম্বাই হামলায় পাকিস্তানি সন্ত্রাসীরা জড়িত ছিল। তিনি আরো বলেছেন, ইচ্ছে করলে হামলা এড়ানো অসম্ভব ছিল না। তিনি দুঃখের সাথে স্বীকার করেছেন, ‘পাকিস্তান দিন দিন নিজেদের বিশ্ব হতে বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে।’ সবাই জানে এই হামলা পুরো ছক এঁকে ছিল পাকিস্তানের প্রধান গোয়েন্দা সংস্থা আই এস আই। সবকিছু স্পষ্ট হওয়ার পরও যখন পাকিস্তান জঙ্গি দায় এড়িয়ে বলে, তারা পাকিস্তানি নাগরিক নন। এ বিষয়ে পরবর্তীতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ বলেন, ‘আমাদের দেশের জঙ্গি সংগঠনগুলো বেশ সক্রিয়। তারা পাকিস্তানি নাগরিক নন বলে আমরা কতদিন দায় এড়াবো। কেন এই হত্যাকাÐের বিচার করতে পারলাম না? এই হামলার মূল পরিকল্পনাকারী কারা এবং কীভাবে করেছে তা সবই স্পষ্ট হলেও তাদের বিচারের মুখোমুখি পাকিস্তান বার বছরেও করতে সক্ষম হয়নি। এ ধরনের জঙ্গি সম্পৃক্ততার কারণে পাকিস্তান একটি সন্ত্রাসী রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে, হচ্ছে। এ ঘটনার মামলা পাকিস্তানের সন্ত্রাস বিরোধী আবদালতে ২০০৯ সাল হতে চললেও বিচারিক কাজের কোন অগ্রগতি নেই। পাকিস্তানি আইনজীবী ও তদন্ত কর্মকর্তার একটি দল অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে প্রমাণ জোগাড় করতে দু’দুইবার ভারতে গিয়ে যথেষ্ট প্রমাণও তারা হাতে নিয়ে যায়। তারপরও ২৬/১১ কুচক্রীরা অবাধ ১২ বছর ঘুরেবেড়ায় কী করে! পাকিস্তানের নানা জঙ্গি ঘটনাপ্রবাহ দেখে এখন আত্মস্থ করতে পারি, ১২ বছর নয়, ৫০ বছর সময় দিলেও পাকিস্তান সরকার জঙ্গিদের বিচার করতে সক্ষম হবে না। কারণ সে দেশের অদৃশ্য সরকার শক্তিশালী। তারা রাষ্ট্রীয় শক্তি ব্যবহার করে জঙ্গি উৎপাদন করে নানা দেশে রপ্তানি করে। তাই পাকিস্তান সরকার জঙ্গিদের বিচার করার ক্ষমতা রাখে না।
ইসলাম একটি পবিত্র ধর্ম। পাকিস্তানের জঙ্গির চাষাবাদ চলে পবিত্র ধর্ম ইসলামের দোহাই দিয়ে। অথচ ‘ইসলাম’ শব্দের অর্থই শান্তি, মুসলিম অর্থ শান্তিকামী। যারা শান্তিতে নেই তারা ইসলামে নেই। জঙ্গি ও সন্ত্রাসীদের সমর্থন দেওয়া মানে ইসলামের বিরোধীতারই নামান্তর। মহান আল্লাহ্্পাকের একটি নাম ‘সালাম’ অর্থ শান্তি। মহানবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলা হয় শান্তির অগ্রদূত। তিনি যে মদিনার পবিত্র ভূমিতে শুয়ে আছেন তার একটি নাম, ‘দারুস সালাম’ যা শান্তির ঘর। যে শান্তির ঘরটিতেও জঙ্গিরা কয়েক বছর পূর্বে হামলা করে। এই জঙ্গিরা শুধু ভারত বা অমুসলিম দেশে হামলা করে তা নয়, অনেক মুসলিম দেশেও হামলা করে চলছে। দুনিয়ার মধ্যে একজন ইহুদী আরেকজন ইহুদীকে ধর্মের নামে হত্যা করে না, একজন খ্রিস্টান আরেক খ্রিস্টানকে ধর্মের নামে হত্যা করে না, এক হিন্দু আরেক হিন্দুকে ধর্মের নামে হত্যা করে না, এক বৌদ্ধ আরেক বৌদ্ধকে ধর্মের নামে হত্যা করে না, কিন্তু পাকিস্তানের এক মুসলমান আরেক মুসলমানকে ধর্মের নামে আল্লাহ্ ঘর মসজিদে হত্যা করে। মাদ্রাসা, স্কুল, খেলার মাঠে জঙ্গি হামলা করে মুসলমান হত্যা করে চলছে। যে হত্যা করছে তার ধর্ম ইসলাম, গ্রন্থ আল কোরআন, নবী মুহাম্মদ (দ.), সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ্্ এবং যাকে হত্যা করছে তারও ধর্ম, গ্রন্থ, নবী, সৃষ্টিকর্তা একই। পাকিস্তানের লাল মসজিদ এক মুসলমানের তরবারির আঘাতে আরেক মুসলমানের রক্তে লাল হয়ে যায়, জঙ্গিবাদের কারণে ২শ’ মাদ্রাসা বন্ধ হয়ে যায়। দুনিয়াব্যাপি শিক্ষার হার বাড়লেও পাকিস্তান নামক জঙ্গি রাষ্ট্রে আধুনিককালে শিক্ষার হার কমতে থাকে।
জঙ্গিরা আফগানিস্তানকে ধ্বংস করেছে, ইরাক, সিরিয়া, পাকিস্তানকে ধ্বংস করেছে, বাংলাদেশকে ধ্বংস করার চেষ্টা করেছে, কিন্তু আল্লাহ্্র রহমতে শেখ হাসিনার সরকার ওই সন্ত্রাসী থেকে দেশকে রক্ষা করেছে। পাকিস্তান অর্থনৈতিকভাবে ভারতের চেয়ে একসময় পিছিয়ে ছিল না, অথচ আজ অনেক পিছিয়ে পড়েছে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের কারণে। মুসলিম বিশ্বের একটি রাষ্ট্রই পারমাণুবিক বোমার অধিকারী, তা হলো পাকিস্তান। রূপকার হলো বিজ্ঞানী আবদুল কাদির। তিনি হলেন পাকিস্তানে সেরা অপরাধী। অপরাধের কারণে তাঁকে পাকিস্তান জঙ্গি রাষ্ট্র কারাগারে ঢুকিয়ে দেয়। আর তখন ভারতে যিনি সেরা বিজ্ঞানী তিনিও মুসলমান। নাম আবদুল কালাম। তাঁকে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের রাষ্ট্র ভারতের সর্বোচ্চ সম্মানের স্থান মহামান্য রাষ্ট্রপতির আসনে বাসন। জঙ্গিবাদ জ্ঞান বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে পশ্চাতে যাওয়া, অন্ধকারে যাওয়া, অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া।
মুসলমান যদি জঙ্গিবাদ সৃষ্টি করে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে অমুসলিমদের হত্যা করে তাহলে খ্রিস্টান, হিন্দু, ইহুদী, বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশেও তাদের ধর্মের নামে জঙ্গিবাদ সৃষ্টি হতে পারে। এভাবে এক ধর্মের মানুষ অন্য ধর্মের মানুষকে হত্যা করতে থাকলে একদিন পৃথিবী নামক এইটি মানব শূন্য হয়ে যাবে। আমাদের মনে রাখা উচিৎ মুসলিম রাষ্ট্র মানে সমগ্র পৃথিবী নয়; মুসলিম দেশে যা কিছু ঘটবে তার প্রতিক্রিয়া বিশ্বব্যাপি হবে। আধুনিক বিশ্বের জনপ্রিয় শ্লোগান ‘গেøাবাল ভ্যালেজ’ বা বিশ্ব পল্লী। সারা জগৎ একটি গ্রাম। বিশ্ব তথ্যের মহাসড়কে বাস করছে। কোন কিছু গোপন থাকবে না। সব ঘটনার প্রতিক্রিয়া দুনিয়াব্যাপি হয়। একজন ব্যক্তিকে যখন হত্যা করা হয় তখন মানুষ বলে শুধু এক ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়েছে। সাক্ষী, আইনজীবী, বিচারক বলেন এক ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়েছে, মহান বিচারক আল্লাহ্্পাক পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করেছেন, “কাউকে কেউ হত্যা করলো (সে যে ধর্মের হোক) সে যেন সমগ্র মানবজাতিকে হত্যা করলো। আর যে কেউকে বাঁচলো সে যেন সমগ্র মানব জাতিকে বাঁচালো। (সূরা মায়িদা, আয়াত : ৩২)

লেখক: কলাম লেখক ও রাজনীতিক