মুন্সী আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের নিরলস সাধক

345

বাংলা সাহিত্যের বিলুপ্ত প্রায় পুঁথি সংগ্রহ, সম্পাদনা, সংরক্ষণ, চর্চা ও গবেষণায় নিজ জীবন উৎসর্গ করে স্মরণীয় হয়ে আছেন চট্টগ্রামের কৃতি সন্তান মুন্সী আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ। তাঁর মত নিষ্ঠাবান পুঁথি সংগ্রাহক ও ঐতিহ্য অনুসন্ধানী সাহিত্যসাধক খুব কমই দেখা যায়। তিনি প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের বিপুল সম্পদ উদ্ধার করে বাংলা ভাষাপ্রেমী ও সাহিত্যানুরাগীদের যে উপকার করে গেছেন তা অমূল্য ।
আবদুল করিমের জন্ম ১৮৭১ সালের ১১ অক্টোবর চট্টগ্রামের পটিয়া থানার সুচক্রদন্ডী গ্রামের এক ঐতিহ্যবাহী উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারে। তাঁর পিতার নাম শেখ নুর উদ্দিন মুন্সী এবং পিতামহের নাম মোহাম্মদ নবী চৌধুরী। তাঁদের পূর্বপুরুষ ছিলেন শেখ হাবিলাস মল্ল যিনি তৎকালীন গৌড়ের সুলতানের সৈনিক ছিলেন । যার নাম অনুসারে পটিয়ার একটি প্রাচীন এলাকার নামকরণ করা হয় হাবিলাসদ্বীপ। এই বংশেরই দোস্ত মোহাম্মদ আবদুল কাদির (১৭২০-১৭৯০) দুর্ভিক্ষের সময় বিপন্ন গ্রামবাসীকে খাবার যোগান দিয়ে তাঁদের জীবন রক্ষা করায় কৃতজ্ঞ এলাকাবাসী তাঁকে ‘কাদির রাজা’ উপাধি দিয়ে সম্মানিত করে। তিনি শিক্ষিত ছিলেন এবং বংশ পরম্পরায় আবদুল করিম ও শিক্ষার সুযোগ পান। তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় ১৮৭৮ সালে তাঁদের বাড়ির বৈঠক খানায় আরবী, ফার্সী ও বাংলা দিয়ে। আবদুল করিমের মায়ের নাম ছিল মিসরিজান। তিনি পটিয়ার পাইরোল গ্রামের জমিদার পাঠান তরফদার দৌলত হামজা খাঁ বংশের উমেদ আলী চৌধুরীর মেয়ে। উল্লেখ্য, করিমের জন্মের তিন মাস পূর্বে তাঁর পিতা নুর উদ্দিন মুন্সী মারা যান। এ অবস্থায় তিনি তাঁর দাদা মোহাম্মদ নবী, দাদী জোলেখা খাতুন এবং চাচা আইন উদ্দিনের আদরে লালিত পালিত হন। দাদা-দাদী জীবিত থাকা অবস্থায় করিমের পিতার মৃত্যু হওয়ায় নাতি করিম সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হবে বিধায় মাত্র এগার বছর বয়সে করিমের সাথে তাঁর চাচাতো বোন (আইন উদ্দিনের কন্যা) নয় বছর বয়সী বদিউন্নেসার বিয়ে দেয়া হয়। ১৮৮২ সালে সম্পন্ন এ বিয়ের বছরে করিম সুচক্রদন্ডী মধ্যবঙ্গ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এক বছর পর তিনি ভর্তি হন পটিয়া উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে। ১৮৮৮ সনে সতের বছর বয়সে করিম তাঁর মা মিসরিজানকেও হারান। ১৮৯৩ সালে আবদুল করিম পটিয়া হাই স্কুল থেকে দ্বিতীয় বিভাগে এনট্রান্স পাস করেন। তিনি তৎকালীন দক্ষিণ চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার এলাকার প্রথম মুসলমান এনট্রান্স পাস করা লোক যিনি সংস্কৃত দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে পড়েছিলেন। এর পর তিনি চট্টগ্রাম কলেজে এফ.এ (ফার্স্ট আর্টস) ক্লাসে ভর্তি হন। এবং সেখানে দু’বছর লেখাপড়া করেন। কিন্তু টাইফয়েড রোগে আক্রান্ত হওয়ায় ফাইনাল পরীক্ষা দিতে পারেননি। এভাবেই তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সমাপ্তি ঘটে। দুর্বল আর্থিক অবস্থার কারণে এ সময় তাঁকে কর্মজীবনে প্রবেশ করতে হয়।
আবদুল করিমের সাহিত্য ও সংস্কৃতি প্রীতি শৈশব থেকে শুরু। বিশেষ করে তাঁদের পারিবারিক সংগ্রহে থাকা বিভিন্ন পুঁথির প্রতি তাঁর বেশ আগ্রহ ছিল । ক্রমে পুঁথি পড়া ও পুঁথি সংগ্রহের নেশা পেয়ে যায় তাঁকে। স্কুলজীবন থেকে সহপাঠিদের দেখাদেখি বিভিন্ন পত্র পত্রিকার নিয়মিত পাঠক ও গ্রাহক হয়ে যান তিনি। অনুসন্ধান পত্রিকার গ্রাহক হওয়ার শুরু থেকে নবম শ্রেণিতে অধ্যয়নকালে ইংরেজি সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘হোপ’সহ আটটি পত্রিকার গ্রাহক হয়ে ছিলেন। দশম শ্রেণির ছাত্র থাকাকালীন তিনি তাঁর দাদা নবী চৌধুরীর সংগ্রহে থাকা অসংখ্য পান্ডুলিপি থেকে কাজী দৌলত রচিত ‘সতী ময়না-লোর চন্দ্রাণী’ কাব্যের পান্ডুলিপি আবিষ্কার করেন। এ সময় তিনি পাশ্ববর্তী বিভিন্ন গ্রাম থেকে পান্ডুলিপি সংগ্রহ করতে থাকেন।
কর্মজীবনের শুরুতে আবদুল করিম চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল স্কুলে শিক্ষকতায় যোগ দেন। কয়েক মাস পরে তিনি সীতাকুন্ড মধ্য ইংরেজি স্কুলে অস্থায়ী প্রধান শিক্ষকের পদে যোগদান করলেও বেশি দিন চাকরী করেননি। ১৮৯৬-৯৭ সালে তিনি চট্টগ্রামের প্রথম সাবজজ আদালতে শিক্ষানবীশ কেরানির পদে চাকরী পান। পরে স্থায়ী হলে পটিয়া মুন্সেফ আদালতে বদলি হয়ে আসেন।
চট্টগ্রাম কলেজে পড়ার সময় থেকে পুঁথি সংগ্রহ, সম্পাদনা ও গবেষণামূলক রচনা লিখতে শুরু করেন। অক্ষয় কুমার সরকারের সম্পাদনায় প্রকাশিত মাসিক ‘পূর্ণিমা’ পত্রিকায় ‘অপ্রকাশিত প্রাচীন পদাবলী’ শিরোনামে তাঁর লোক সাহিত্য বিষয়ক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় । এভাবেই কবি নবীনচন্দ্র সেন তাঁর সাথে পত্রযোগে পরিচিত হন। উল্লেখ্য, কবি নবীনচন্দ্র সেন তখন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এক সময় তিনি বিভাগীয় কমিশনারের একান্ত সচিব রূপে চট্টগ্রামে বদলি হয়ে আসেন। তিনি আবদুল করিমকে পটিয়া থেকে বদলি করে চট্টগ্রাম কমিশনার অফিসে কেরানি পদে নিজের কাছে নিয়ে আসেন। এ বিষয়টি একই অফিসে অনেকেই ভালো চোখে দেখেননি। ফলে তাঁরা দু‘জনই তাঁদের ষড়যন্ত্রের শিকার হন। আবদুল করিম বছর খানেক চাকরী করার এক পর্যায়ে স্ব-গ্রাম নিবাসী কালী শংকর চক্রবর্ত্তী প্রকাশিত সাপ্তাহিক ‘জ্যোতি’ পত্রিকার এক সংখ্যায় কমিশনার অফিসের একটি গোপনীয় সংবাদ প্রকাশিত হয়। একই পত্রিকায় আবদুল করিমের নামে একটি বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়। যেখানে ছিল “প্রাচীন গীত, পুঁথি, বার মাস্যা প্রভৃতি যিনি সংগ্রহ করিয়া দিবেন তাহাকে আমরা এক বৎসরকাল ‘জ্যোতি’ পত্রিকা বিনামূল্যে দান করিব”। এটা দেখে নবীন চন্দ্র সেন ও আবদুল করিমের বিরোধীরা এ দু‘জনের বিরুদ্ধে তৎকালীন কমিশনারের নিকট অভিযোগ করে বসে- আবদুল করিমের মাধ্যমে অফিসের গোপনীয় সংবাদটি ফাঁস হয়েছে এবং নবীন চন্দ্র সেনও এটাতে জড়িত আছে। সরকারি কর্মচারী হিসেবে তাঁরা দু‘জনেই পত্রিকাটির সাথে যোগাযোগ রেখেছেন যা চাকরী বিধির পরিপন্থী। অথচ নবীন চন্দ্র সেন এ ব্যাপারে কিছুই জানতেননা এবং আবদুল করিমও সাহিত্য বিষয়ক একটি বিজ্ঞাপন ছাপানো অতোটা দোষণীয় হয়ে পড়বে তা বুঝতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত দ’ুজনের মধ্যে আবদুল করিমকে চাকরীচ্যুত এবং নবীন চন্দ্র সেনকে অন্যত্র বদলি করা হয়। আবদুল করিম এতে কিছুটা বিপদগ্রস্ত হলেও পরবর্তীতে আনোয়ারা মধ্য ইংরেজি বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের শূন্য পদে নিয়োগ পান। বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা রাজ চন্দ্র সেন (কবি মুক্তারাম সেন’র বংশ ধর) চট্টগ্রাম কালেক্টরটের নাজির ছিলেন। একই অফিসে চাকরীর সুবাদে সাহিত্য-সংস্কৃতি প্রেমী আবদুল করিমকে তিনি এক রকম জোর করে তাঁর স্কুলে নিয়ে যান। আনোয়ারা স্কুলে আবদুল করিম ১৮৯৯-১৯০৫ পর্যন্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। এ স্কুলে শিক্ষকতাকালীন সময়ে আবদুল করিম অনেক পুঁথি সংগ্রহ করেন। ১৯০১ সালে কোলকাতার বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে নরোত্তম ঠাকুরের ‘রাধিকার মানভঙ্গ’ গ্রন্থটি তাঁর সম্পাদনায় এ সময় প্রকাশিত হয় যেটির মুখবন্ধ লেখেন আচার্য্য হরপ্রসাদ শাস্ত্রী । এতে তিনি লিখেন-‘গ্রন্থের সম্পাদনা কার্যে যে রূপ কৌশল, যে রূপ সহৃদয়তা ও যে রূপ সূ²দর্শিতা প্রদর্শন করিয়াছেন তাহা সমস্ত বাংলায় কেন সমস্ত ভারতেও বোধ হয় সচরাচর মিলেনা। এক এক বার মনে হয় যেন কোন জার্মান এডিটর গ্রন্থ সম্পাদনা করেছেন’।
আনোয়ারা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষকতাকালীন সময়েই আবদুল করিম গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু কাব্য সংগ্রহ করেন। প্রথম যে পূঁথিটি তিনি সেখানে পান তা হল মহাকবি আলাওলের বিখ্যাত ‘পদ্মাবতী’ কাব্য। আনোয়ারা স্কুলের পাশ্ববর্তী ডুমুরিয়া গ্রামের এক কৃষকের ঘরে এ অমূল্য রত্মটি পেয়ে করিম এতটাই খুশি হয়েছিলেন যে ড. মুহাম্মদ এনামুল হককেও সে আনন্দের কথা বলেছিলেন। ড. হকের স্মৃতিচারণ এভাবে-‘‘ আনোয়ারায় শিক্ষক আবদুল করিমের দিন খোঁজাখুঁজিতেই কাটে। একদিন হঠাৎ এক চাষির বাড়িতে একখানা পুঁথি পাওয়া গেল। ইউরেকা! ইউরেকা! পেয়েছি। সে কি যে সে আনন্দ ! হাজার টাকার তোড়া বা গুপ্তধন পেয়েও কেউ তেমন আনন্দ ভোগ করেছেন কিনা জানিনে। আবদুল করিম যখন বৃদ্ধ বয়সে এ কাহিনী বলতেন তখন তাঁর দন্তহীন মুখে যে হাসি ফুটে উঠতো তা দেঁতো হাসিকেও মাত করে দিতে দেখেছি। তখনও প্রাচীন হস্তাক্ষর পড়ার ক্ষমতা তাঁর হয়নি। পুঁথি খানি যে কি বই তা কিছুতেই ঠিক করা গেলনা। নানা স্তোক বাক্যে চাষাটিকে ভুলিয়ে তিনি হস্তগত করলেন —- সাত রাজার ধন এক মানিক। আহার ইেন, নিদ্রা নেই, পাঠোদ্ধারের প্রচেষ্টা অবিরাম গতিতেই চললো। এক সপ্তাহের অদম্য প্রচেষ্টায় জানা গেল পুঁথিটি আলাওলের “পদ্মাবতী”। এটি আলাওলের কোন মৌলিক রচনা নয় । পারসী কবি মালিক মুহম্মদ জায়সী রচিত হিন্দি কাব্য ‘পদুমাবৎ’ এর বাংলা ভাবানুবাদ এটি। অনুবাদ হলেও এর পান্ডিত্য, কবিত্ব সৌন্দযৃবোধ ও ভাষার চাতুর্য আলাওলের নৈপুণ্য ও সৃজনশীলতার পরিচায়ক। ইতিহাসবিদ সাবেক চবি উপাচার্য প্রফেসর ড. আবদুল করিম ‘পদ্মাবতী’ প্রসঙ্গে বলেন “এ পুঁথির আবিষ্কার তাঁর জীবনের মোড় ঘুড়িয়ে দেয় । নতুন নতুন আবিষ্কারের নেশা তাঁকে পেয়ে বসে। সাহিত্যের গবেষেণায় তিনি সম্পূর্ণভাবে নিজেকে লিপ্ত করেন। ফলে বাংলা সাহিত্যে এক নতুন যুগের সূচনা হয়। এই যুগ সূচনা করেন স্বয়ং আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ”।
আবদুল করিমের সাহিত্য চর্চা শুধু পুঁথি সংগ্রহে সীমাবদ্ধ ছিলনা। তিনি লিখেছেন ও প্রচুর। বাংলা-১৩০২ সালে পূর্ণিমায় ‘অপ্রকাশিত প্রাচীন পদাবলী’ দিয়ে শুরু করে ১৩০৭, ১৩০৯, ১৩১০, ১৩১২ ও ১৩১৮ সনের সাহিত্য পরিষদ পত্রিকায় তাঁর সংগৃহীত পুঁথির বিবরণ প্রকাশিত হয় । এছাড়াও পূর্ণিমা, জ্যোতি, সাধনা, আরতি, নবনূর, সুধা, প্রকৃতি, মোহাম্মদী, আল এসলাম, মাহে নও, আশা, সাহিত্য পরিষদ পত্রিকা, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি পত্রিকা ইত্যাদি পত্রিকায় তাঁর লেখা গুরুত্ব সহকারে প্রকাশিত হয়েছিল। পুঁথি- সাহিত্য, ভাষা-সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য ভিত্তিক তথ্যবহুল তাঁর লেখা মূল্যবান প্রবন্ধ সংখ্যা ছয় শতাধিক। মুন্সী আবদুল করিমের এহেন অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ চট্টগ্রামের পন্ডিত সমাজ “চট্টল ধর্মমন্ডলী” ১৯০৯ সালে তাঁকে ‘সাহিত্য বিশারদ’ উপাধি দিয়ে সম্মানিত করেন। ১৯২৩ সালে নদীয়ার পন্ডিত সমাজ ‘সাহিত্য সভা’ তাঁকে ‘সাহিত্য সাগর’ উপাধিতে ভূষিত করেন।
আবদুল করিম পুঁথি সংগ্রহ করে জীবৎকালে কিংবদন্তীতে পরিনত হয়েছিলেন । পুঁথির খবর যেদিকে আবদুল করিম ছুটতেন সেদিকে। এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রামের গবেষক আবদুল হক চৌধুরীকে আবদুল করিম লিখেন (০২/১০/১৯৪৪ তারিখে)-“ তেতুঁল দেখিলে যেমন জিহবায় জল আসে, পুঁথির নাম শুনিলেও আমার তাহা না দেখা পর্যন্ত সোয়াস্তি থাকেনা”। বস্তুত: পুঁথি সংগ্রহের নেশায় অনেকটা পাগল ছিলেন সাহিত্য বিশারদ। তাই নানারকম প্রতিকূলতাকে কাটিয়েও তিনি পুঁথি সংগ্রহ করেছেন। তাঁর কথায়- “হিন্দু বাড়ি গিয়া এমনও দেখিয়াছি গোড়া হিন্দু আমাকে পুঁথি ছুঁইতে দেয় নাই, সে পাতা মেলিয়া ধরিয়াছে আর আমি নোট লিখিয়া লইয়াছি” । আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ সম্পাদিত গ্রন্থগুলো হল- কবি বল্লবের ‘সত্যনারায়ণের পুঁথি’, দ্বিজরতি দেবের ‘মৃগলুদ্ধ’, রামরাজার ‘মৃগলুদ্ধ সম্বাদ’, দ্বিজ মাধবের ‘গঙ্গামঙ্গল’, আলীরাজা কানু ফকীরের ‘জ্ঞানসাগর’, বাসুদেব ঘোষের ‘শ্রীগৌরাঙ্গ সন্ন্যাস’, শেখ ফয়জুল্লাহর ‘গোরক্ষবিজয়’, আলাওলের ‘পদ্মাবত্মী, মুসলমান বৈষ্ণব কবি, নারায়ণ দেবের ‘পাঁচালি’, কালকেতুর ‘চৌতিশা’।
তাঁর সংগৃহীত পুঁথিগুলির মধ্যে বেশ কিছু বিভিন্ন গুণী গবেষকের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে সেগুলোর মধ্যে আলাওলের ‘পদ্মাবতী’ (আংশিক) সৈয়দ হামজার ‘মধুমালতী’ মীর ফয়জুল্লাহর ‘সুলতান জমজমা’ শাহ মুহম্মদ সগীরের ‘ইউসুফ জোলেখা’, সৈয়দ সুলতানের ‘ওফাতে রসুল’, শেখ জাহিদের ‘আদ্য পরিচয়’, শেখ চান্দের ‘রসুল বিজয়’, নসরুল্লাহ খোন্দকারের ‘শরীয়ত নামা’, দৌলত উজির বাহরাম খাঁর ‘লাইলী-মজনু’, ‘ইমাম বিজয়’, ননা গাজী চৌধুরীর ‘ইবলিসনামা’, আফজল আলীর ‘নসিহত নামা’, মোহাম্মদ আকিলের ‘মুসানামা’, নওয়াজিস খানের ‘গুলে বকাওলী’, আলাওলের ‘তোহফা’, ‘সিকান্দরনামা’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। মাতৃভাষা বাংলার জন্য আবদুল করিমের ছিল নাড়ির টান বাংলা ভাষার গুরুত্ব সম্পর্কে তিনি যেমন লিখেছেন তেমনি বিভিন্ন সভা সমিতি সম্মেলনেও অভিমত দিয়ে গেছেন। ‘নবনূর’ পত্রিকায় (১৯০৩) ‘বাঙালা ভাষায় মুসলমানী সাহিত্য’, ‘আল এসলাম’ পত্রিকায় (১৯১৮) ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য বনাম ও বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য’ শীর্ষক প্রবন্ধ, ১৯১৪ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত বাংলা সাহিত্য সম্মেলনে পঠিত অভিভাষণ: ‘বাংলার মুসলমানগণের মাতৃভাষা’ শিরোনামে ও আবদুল করিম মাতৃভাষা বাংলার গুরুত্ব বিষয়ে তাঁর দৃঢ় অবস্থান ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন,“ বাঙালা ভাষা ভিন্ন অন্য কোন ভাষা বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষা ও জাতীয় ভাষা হইতে পারেনা” । তিনি আরো বলেন, “বাংলার হিন্দুদিগের মতো বাংলার মুসলমানদরেকেও বাঙালি ভিন্ন আর কিছু বলা যায়না। এই ভাষাতে তারা চিন্তা করে সংসারের যাবতীয় কাজ কর্ম করে”।
১৯৪৭ সালে পকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর নভেম্বরের প্রথম দিকে বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানিয়ে মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিম উাদ্দনের কাছে ২০ জন বিশিষ্ট নাগরিকের পক্ষ থেকে যে স্মারকলিপি দেয়া হয়েছিল সেখানেও আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ, কবি জসীম উদ্দিন, ড. মুহম্মদ এনামুল হক, আবুল কালাম শামসুদ্দীন, অধ্যাপক গণেশ বসু, সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ, লীলা রায়, অধ্যাপক অতুল সেন প্রমুখ স্বাক্ষর করেছিলেন। ২২ আগস্ট ১৯৫২ সালে কুমিল্লায় পূর্ব পাকিস্তান সাংস্কৃতিক সম্মেলনে প্রথম অধিবেশনে প্রদত্ত সভাপতির ভাষণে সাহিত্য বিশারদ বলেছিলেন, “ আজ বোধ হয় তাহারা দেশকে পাপে ডুবাইতে চাহেন, যাঁহারা প্রশ্ন তুলিয়াছেন বাংলা ভাষা আমাদের সংস্কৃতির বাহন হইতে পারেনা”।
সাহিত্য বিশারদ জীবিতাবস্থায় ১৯৫০ সালে তাঁর সংগৃহীত মুসলমান রচিত পুঁথি গুলি (৬৯৫টি) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে দান করেন। ১৯৫৩ সালে তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর ভাইপো ড. আহমদ শরীফ হিন্দু রচিত পুঁথি গুলি (৩৮১ টি) রাজশাহী বরেন্দ্র গবেষণা যাদুঘরে দান করেন। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদেও তাঁর সংগৃহীত অনেক পুঁথি দেয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, তাঁর শ্রেষ্ঠ কীর্তি সংগ্রহ আলাওলের ‘পদ্মাবতী’র প্রকাশনা তিনি দেখে যেতে পারেন নি। তাঁর মৃত্যুর দীর্ঘদিন পর ১৯৭৭ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এটির আংশিক প্রকাশিত হয়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর সংগৃহীত পুঁথি, বই, পত্র পত্রিকা, ম্যাগাজিন ইত্যাদির এক বিশাল সংগ্রহশালা সযত্নে সংরক্ষণ করা হয়েছে। বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির নিরলস সাধক মুন্সী আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ ১৯৫৩ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর সকাল ১০.৪৭ মিনিটে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। উল্লেখ্য এ সময়ও তিনি চট্টগ্রামের অলিখিত কাহিনী তথা চট্টগ্রামের অতীত ইতিহাস নিয়ে লেখালেখিতে মগ্ন ছিলেন। চট্টল মনীষা বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সাধক আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদের স্মৃতির প্রতি বিন শ্রদ্ধা জানাই।

লেখক : ছড়াকার, ভাষা আন্দোলন গবেষক