মুজিববর্ষ মুজিবকোট ও নৌকা প্রতীক

477

স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের স্থপতি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। একজন আদর্শ নেতার যেসব বৈশিষ্ট্য থাকার কথা এর সবকটি বৈশিষ্ট্যই জাতির এ মহানায়কের কাছে ছিল। এমনকি তাঁর পোশাকে চলনে, বলনেও ছিল স্বাতন্ত্র্যবোধ। তিনি যখন নির্বাচনের মাঠে তখন নদীমাতৃক বাংলার সাধারণ মানুষের বাহন নৌকাকেই বেচে নেন। সাদা পাঞ্জাবি পায়জামার সাথে কালো কোট গায়ে মুজিব হয়ে উঠতেন অনন্য ব্যক্তিত্বে। আজ মুজিববর্ষ উপলক্ষে মুজিব কোট আর নৌকা প্রতীকের বিষয়টি নিয়েই আলোচনা করা যাক। আগেই বলে রাখি, এ নিবন্ধের তথ্যগুলো নানাসূত্রে থেকে প্রাপ্ত। মুজিব কোট : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান আমৃত্যু একটি কোট গায়ে দিতেন। প্রথম জীবনে বঙ্গবন্ধু কিন্তু এই কোট ব্যবহার করতেন না, তখন তাঁর পরিধেয় ছিল শুধুই পাঞ্জাবি-পায়জামা, মাঝে মধ্যে সাদা ও কালো শেরোয়ানিও পরতে দেখা গেছে। ঠিক কবে থেকে হাতাবিহীন এই কালো কটি পরা শুরু করেছিলেন বঙ্গবন্ধু, সে সম্পর্কে কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে বঙ্গবন্ধুর ছবি ধারাবাহিকভাবে পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, যখন আওয়ামী মুসলিম লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন বঙ্গবন্ধু, তখন থেকেই তাকে অনিয়মিতভাবে এই কটি বা কোট পরতে দেখা গেছে। অবশ্যই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় জেল থেকে বের হয়ে আসার পর থেকে তিনি নিয়মিত এই কালো কটি পরতে থাকেন।
মুজিব কোটের উৎস ও অজ্ঞাত। কারো মতে, জহরলাল নেহেরুর অনুকরণে এই কোট পরা শুরু করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। তবে নেহেরুর পোশাকটি মূলত ভারতের উত্তরাঞ্চলে প্রচলিত আচকানের একটি রূপ। সৈয়দ আনোয়ার আবদুল্লাহর বর্ণনা থেকে জানা যায়, মুজিব কোটের অন্য একটি নির্দেশনা। আত্মীয় সূত্রে বঙ্গবন্ধু’র দাদা সম্পর্কের ছিলেন মাওলানা শামছুল হক। তিনি যখন লালবাগ মাদরাসার মুহতামিম তখন শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকার তরুণ নেতা। বঙ্গবন্ধু দাদার সাথে দেখা করতে প্রায়শই লালবাগ যেতেন। তাঁর সাথে বঙ্গবন্ধুর গভীর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। পাঞ্জাবির ওপরে সব সময় কালো কোট পরতেন শামছুল হক। একদিন লালবাগে তাঁর কামরায় শেখ মুজিব বললেন, দাদা, আপনার কোটটা আমার খুব ভালো লাগে। সঙ্গে সঙ্গে গা থেকে কোটটি খুলে মুজিবকে পরিয়ে দিলেন শামসুল হক। বললেন, “দারুণই তো লাগছে। এখন তোমাকে সত্যিকারের নেতা মনে হচ্ছে। ঠিক আছে, কোটটা তোমাকে দিয়ে দিলাম। এটা পরেই সব সময় মিটিং মিছিলে যাবে।” সেই যে দাদার কালো কোট গায়ে পরেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, আমৃত্যু এই কোট ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব-এর কোটে ৬টি বোতাম ব্যবহার করা হতো। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের জনৈক এক ছাত্র একবার এই ৬ বোতামের রহস্য জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তাঁকে বুকে জড়িয়ে বলেছিলেন, ‘এ প্রশ্ন আগে আমাকে কেউ করেনি-রে তুই-ই প্রথম। এই ৬ বোতাম আমার ছয় দফার প্রতীক।’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর মুজিব কোটের আরো একটি বিশেষত্ব হলো কলারের ভেতরের বোতাম দিয়ে আটকানো আলাদা কাপড়ের ডাবল কলার। কলার বেশি ময়লা হয় বলেই মনে হয় এই ব্যবস্থা। ডিজাইনার বদরুন নাহার সূত্রে ইতিহাস বলছে, বঙ্গবন্ধু’র প্রথম মুজিব কোটটি ছিল খাদি। সেলাই করে দিয়েছিলেন, ১৬ বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের নিউ লাহোর টেইলার্সে। এই টেইলার্স থেকে বঙ্গবন্ধু’র কাপড় সেলাই হতো।
বঙ্গবন্ধু ইংল্যান্ডে গিয়ে সেখানকার সেভিল রয় টেইলার্স থেকেও একবার কোট বানিয়ে আনিয়েছিলেন। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পরও এই মুজিব কোট পরেই ভাষণ দিয়েছেন, বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেনÑ সর্বোপরি নিজেকে বাঙালির ফ্যাশন আইকন হিসেবে বিশে^র দরবারে মুজিব কোট পরে হাজির করেছেন।
নৌকা প্রতীক : হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী আওয়ামী মুসলিম লীগ, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের কৃষক শ্রমিক পার্টি, মাওলানা আতাহার আলীর নেজামের ইসলাম পার্টি ও হাজী মোহাম্মদ দানেশের গণতন্ত্রী দল মিলে ১৯৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বর গঠিত হয় যুক্তফ্রন্ট। এই যুক্তফ্রন্টই ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে প্রথম নৌকা প্রতীক নিয়ে ভোটের লড়াই শুরু করে। তবে এও জানা যায় যে, নৌকার আগে লাঙ্গল প্রতীক চেয়েছিল যুক্তফ্রন্ট। কিন্তু নির্বাচন কমিশন যুক্তফ্রন্টকে লাঙ্গল দেয়নি। কারণ লাঙ্গল ছিল শেরে বাংলার অবিভক্ত ভারতের কৃষক প্রজার পার্টির প্রতীক। পরে নৌকাকেই প্রতীক হিসেবে বেছে নেয় যুক্তফ্রন্ট। কেন বা কে নৌকা নির্বাচিত করেছিল এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত কিছু জানা যায় নাই। তবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর নৌকা প্রীতির একটা ঘটনা আছে। ১৯৪৩ এর দুর্ভিক্ষে গোপালগঞ্জেও সাহায্য আনার জন্য মুসলিম লীগের জাতীয় নেতাদের নিয়ে নিজের এলাকায় একটা সম্মেলনের আয়োজন করেন শেখ মুজিব। বড় বড় নৌকার বাটাম দিয়ে তিনি সম্মেলনের প্যান্ডেল করেছিলেন। প্যান্ডেলে নৌকার একটি অনুষঙ্গ ব্যবহারের এই আইডিয়াটা ছিল অভিনব। পরে আওয়ামী লীগের অনেক অনুষ্ঠানের মঞ্চসজ্জাতেই নৌকা ব্যবহার করা হয়েছে। যুক্তফ্রন্ট ভেঙ্গে গেলে জোটের সবচেয়ে বড় দল এবং নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি আসনজয়ী হিসেবে নৌকা প্রতীক আওয়ামী মুসলিম লীগেরই থেকে যায়। পরে আওয়ামী মুসলিম লীগের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে জন্ম নেয় আওয়ামী লীগ। এই আওয়ামী লীগই নৌকা প্রতীক পায়। ইতিহাস বলে নৌকায় চড়ে নির্বাচন করতে আওয়ামী লীগকে প্রায় ১০ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে নৌকা প্রতীক নিয়ে অংশগ্রহণ করে আওয়ামী লীগ। এ নির্বাচনে সাধারণ পরিষদের ১৬৯টি এবং প্রাদেশিক পরিষদের ২৮৮টি আসনে বিজয়ী হয় আওয়ামী লীগ।
প্রিয় পাঠক আসুন, আমরা ইতিহাসের গৌরব গাঁথা হৃদয়ে ধারণের লক্ষ্যে মুজিব কোট ও নৌকা প্রতীককে হৃদয়ে ধারণ করি।
সূত্র : সৈয়দ আনোয়ার আবদুল্লাহর হুজুর কোটটি খুলে শেখ মুজিবের গায়ে পরিয়ে দিলেন’, মোহসিনা লাইজুর ‘বঙ্গবন্ধু’র ধ্রুপদী স্টাইল’/কমল জোহা খানের ‘যেভাবে এল নৌকা, ধানের শীষ, লাঙ্গল।’

লেখক : সাধারণ সম্পাদক
বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চারনেতা স্মৃতি পরিষদ