মুজিববর্ষে আমাদের প্রত্যাশা স্বাধীনতার অর্থ সম্মান নিয়ে ইজ্জত নিয়ে বাস করা

587

এমরান চৌধুরী

বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা, বিশ্বের নির্যাতিত মানবের প্রেরণার বাতিঘর, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, আগুন ডানার পাখি, স্বাধীনতার কবি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শততম জন্মবার্ষিকী পালিত হচ্ছে এ বছর। এখন থেকে শত বছর পূর্বে ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার (বর্তমানে জেলা) পাটগাতি ইউনিয়নের টুঙ্গিপাড়া গ্রামে এক ধর্মপ্রাণ মুসলিম পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। শততম জন্মবার্ষিকী হিসেবে এ বছরের নাম দেওয়া হয়েছে মুজিব বর্ষ। এই শততম জন্মবার্ষিকী তথা মুজিববর্ষের ক্ষণ গণনা শুরু হয়েছে ১০ জানুয়ারি থেকে। স্বাধীনতা লাভের পর যেদিন বঙ্গবন্ধু স্বদেশে ফিরে এসেছিলেন সেই ঐতিহাসিক ১০ জানুয়ারি তারিখে এই ক্ষণগণনার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা, দেশরতœ শেখ হাসিনা। এ বছরের ১৭ মার্চ থেকে ২০২১ সালের ২৬ মার্চ পর্যন্ত নানা আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে পালিত হওযার কথা মুজিব বর্ষ। এই উপলক্ষে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে নেওয়া হয়েছিল নানা কর্মসূচি। এ কর্মসূচি রাজধানী ঢাকা ছাড়িয়ে আটষট্টি হাজার গ্রামের প্রতিটি গৃহকোণ পর্যন্ত পালনের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছিল।
মুজিববর্ষ উপলক্ষে সারাদেশ থেকে প্রকাশিত হয়েছিল হাজার হাজার গ্রন্থ ও পত্র-পত্রিকা। আয়োজিত হওয়ার অপেক্ষায় ছিল নানা সভা-সেমিনার। সারাদেশের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়েও আয়োজিত হতো নানা প্রতিযোগিতা। কিন্তু বৈশ্বিক মহামারী কারণে সকল কর্মসূচি স্থগিত বা সীমিত করা হয়েছে। এই সীমিত সুযোগে বাঙালি প্রতিদিন এই বিশাল মাপের মানুষটিকে নানাভাবে সম্মান জানিয়ে যাচ্ছে। প্রতিদিন বিভিন্ন মিডিয়া তুলে ধরছে বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামী জীবনের বিচিত্র চালচিত্র। কৈশোরে বঙ্গবন্ধু কেমন ছিলেন? কৈশোর থেকেই তিনি ছিলেন বন্ধুপ্রিয়, পরোপকারী, সাহসী, অন্যায় আর অসত্যের বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ। দেশ, মাটি ও মানুষের প্রতি সীমাহীন দরদ তাঁকে তাড়া করত সবসময়। ফলে তিনি স্কুলজীবনেই নেতৃত্বগুণে বন্ধুদের কাছে মিয়া ভাই হয়ে ওঠেছিলেন। অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে কিশোর বয়সেই কারাগারের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন। জীবন ও যৌবনের সব আহ্লাদ বিসর্জন দিয়ে তিনি দিনের পর দিন জেল খেটেছেন। বাংলার মানুষকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করার লক্ষে ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের জনপদের এমন কোন গৃহকোণ নেই যেখানে তিনি ছুটে যাননি। এভাবে তিনি একটি নির্জীব জাতিকে স্বাধীনতার জন্য জাগিয়ে তুলেছিলেন। পলাশীর আম্রকাননে স্বাধীনতা হারিয়ে বাঙালিরা ভুলেই গিয়েছিলেন কীভাবে বুক টান করে দাঁড়াতে হয়। বঙ্গবন্ধু তাঁর দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সেই নুয়ে পড়া বাঙালিকে কীভাবে শির উন্নত করে চলতে হয় কীভাবে বলতে হয় ‘ অন্যায়ের কাছে নত নাহি হবে শির /ভয়ে কাঁপে কাপুরুষ লড়ে যায় বীর সবই শিখিয়েছিলেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এদেশের মানুষের ন্যায্য অধিকার আদায়ে দীর্ঘ ২৪ বছর সংগ্রাম করেছেন। আপোসহীন এ নেতা নিজের জীবনবাজি রেখে আমাদের উপহার দিয়েছেন একটি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। কিন্তু এই স্বাধীন দেশের মাটিতে তিনি মাত্র সাড়ে তিন বছরের মতো সময় বাংলাদেশের মানুষকে সেবা করার সুযোগ পেয়েছিলেন। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট এদেশের কিছু দানবের হাতে তিনি নির্মমভাবে শাহাদাতবরণ করেন। তাঁর এই অকাল বিদায়ে বাঙালি জাতির যে কী অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে তা আমরা সঠিক সময়ে বুঝতে না পারলেও বিশ্ববাসী তা ঠিক সময়েই বুঝতে পেরেছিল। তাইতো বিশ্বের এক মহান নেতা চরম ক্ষোভের সঙ্গে বলেছিলেন, ‘ বাঙালিদের আর বিশ্বাস করা যায় না।’ আসলেই তাই যে ব্যক্তি তার পিতাকে হত্যা করতে পারে, যেদেশের মানুষ তাদের জাতির সবচেয়ে শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি, জাতির জনককে হত্যা করতে পারে তাদের দ্বারা যে কোনো নিষ্ঠুর আর জগন্য কাজ করা মোটের ওপর অসম্ভব নয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সারা জীবন নানা সভা সমাবেশে বক্তব্য রেখেছেন। দেশ, মাটি ও মানুষের কল্যাণের স্বার্থে তিনি যে সব বক্তব্য রেখেছেন তার প্রতিটি লাইন গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর সেসব বক্তব্য থেকে কিছু কথা উদ্ধৃত করছি :
š নেতা হিসাবে নয়, ভাই হিসাবে আমি আমার দেশবাসীকে বলছি—আমাদের সাধারণ মানুষ যদি আশ্রয় না পায়, খাবার না পায়, যুবকরা যদি চাকরি বা কাজ না পায় তাহলে আমাদের এই স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যাবে। (শিশু, জাতীয় শোক দিবস সংখ্যা ১৯৯৯, পৃষ্ঠা-৪২)
š বাংলার মাটি থেকে দুর্নীতি উৎখাত করতে হবে। দুর্নীতি আমার বাংলার কৃষক করে না। দুর্নীতি আমার বাংলার মজদুর করে না। দুর্নীতি করে শিক্ষিত সমাজ। আজ যেখানে যাবেন দুর্নীতি। রাস্তা খুঁড়তে যান—দুর্নীতি। খাদ্য কিনতে যান—দুর্নীতি। জিনিস কিনতে যান —দুর্নীতি।( তথ্যউৎস, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা -৪৩)
š আমরা এখন স্বাধীন হয়েছি। কিন্তু স্বাধীনতার অর্থ সম্মান নিয়ে ইজ্জত নিয়ে বাস করা—উচ্ছৃঙ্খলতা নয়। ( ঐ, ৪৪)।
বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল শোষণমুক্ত, দুর্নীতিমুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত একটি সুশীল বাংলাদেশে বিনির্মাণ। সেই বাংলাদেশ গঠনের লক্ষ্যে তিনি কাজও শুরু করেছিলেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশকে পৃথিবীর বড় বড় পরাশক্তির কোনো রকম সাহায়্য ছাড়া তিনি তুলে আনতে শুরু করেছিলেন। সে লক্ষ্যে তিনি দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক দিয়েছিলেন। যে বিপ্লবের লক্ষ্য ছিল অর্থনৈতিক মুক্তি। তিনি বিশ্বাস করতেন অর্থনৈতিক মুক্তি ছাড়া ভৌগোলিক স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে পড়ে। তিনি বিশ্বাস করতেন সোনার বাংলা গড়তে হলে সোনার মানুষ চাই। তিনি এও বিশ্বাস করতেন এদেশের নতুন প্রজন্ম সোনার মানুষ হয়ে গড়ে ওঠবে এবং তাদের হাতে গড়ে ওঠবে বঙ্গবন্ধুর কাঙক্ষিত সোনার বাংলা। কিন্তু এদেশের মীর জাফরের উত্তরসূরিরা বঙ্গবন্ধুকে তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলা দেখে যাওয়ার সুযোগ দেয়নি। মাত্র পঞ্চান্ন বছর বয়সে থামিয়ে দেওয়া হয় বাংলাদেশের এই প্রাণভোমরাকে। থমকে পড়ে বাংলাদেশের উন্নয়নের চাকা
বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্যকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা এখন বাংলাদেশের উন্নয়নের চাকাকে উন্নতির শিখরে পৌঁছে দিতে দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। তাঁর গতিশীল নেতৃত্বের গুণে বাংলাদেশ আজ মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হতে চলেছে। দৈনিক প্রথম আলোর এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ‘গত ১০ বছরে আমাদের মাথাপিছু আয় বেড়েছে ১০৬ ভাগ, দশকজুড়ে আমাদের প্রবৃদ্ধির গড় ৬.৮৮, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। দেশে দারিদ্র্য কমেছে প্রায় ১১ ভাগ। গড় আয়ু বেড়েছে। খাদ্য উৎপাদনে এখন আমরা স্বাবলম্বী। আমাদের ছেলেমেয়েরা প্রায় সবাই স্কুলে যায়। মেয়েদের স্কুলে যাওয়ার হার ছেলেদের চেয়ে বেশি। আমাদের দেশে প্রায় সবাই স্বাস্হ্যসম্মত পায়খানা ব্যবহার করে।’( প্রথম আলো ০১/০১/২০২০) এই প্রতিবেদন পড়ে আমরা খুবই আনন্দিত,কারণ বাংলাদেশে যেভাগে এগিয়ে চলেছে তাতে বঙ্গবন্ধুর কাঙ্ক্ষিত সোনার বাংলার স্বপ্নপূরণ সময়ের ব্যাপারমাত্র।
বাংলাদেশের এ অসীম উন্নয়ন, মহকর্মযজ্ঞ অর্থবহ হবে না যদি সমাজ থেকে নৈরাজ্য দূর না হয় । বাংলার প্রতিটি গৃহকোণের মানুষ যতক্ষণ আশ্বস্ত না হয় তাদের পড়ুয়া মেয়েটির পথেঘাটে,স্কুল-কলেজে-ভার্সিটিতে কোনো নিরাপত্তার অভাব হবে না। সে ক্লাস শেষে বা নিজ নিজ কাজের শেষে নিরাপদে বাড়িতে ফিরে আসবে। বঙ্গবন্ধু যেমন বলেছিলেন স্বাধীনতার অর্থ সম্মান নিয়ে ইজ্জত নিয়ে বাস করা। আজ আমাদের দেশে সবকিছু থাকার পরও যেন কিছু একটা নেই। দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই চললেও তার গতি আশাব্যন্জক নয়। সর্বনাশা মাদকের বিরুদ্ধে আমাদের নিয়ত লড়াই চালিয়ে যেতে হচ্ছে। সবচেয়ে স্পর্শকাতর যে বিষয়টি তাহলো আমাদের মাতৃজাতি না ঘরে না বাইরে কোথাও নিরাপদ নয়। এভাবে আমাদের মেয়েরা যদি নির্যাতনের শিকার হয়, হত্যার শিকার হয়, ইভটিজিং -এর মুখোমুখি হয়, মা-বাবারা যদি সন্তানদের স্কুল-কলেজে যেতে নিরাপত্তার অভাববোধ করে। ইজ্জত আর সম্মান নিয়ে যদি মা-বোনেরা বাঁচতে না পারে তাহলে নিঃসন্দেহে আমাদের সকল আনন্দ নিরানন্দে পরিণত হবে। আমরা আশা করব মুজিববর্ষে সকল মা-বোন নিরাপদে থাকবে তাঁদের সম্মান নিয়ে, ইজ্জত নিয়ে এবং সকল প্রকার অন্যায় অবিচারের মূল উৎপাটনে সরকার আরো কঠোর হবে।
লেখক : শিশুসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক