মুজিবনগর সরকার ১৯৭১: আন্তর্জাতিক তৎপরতা

1211


স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করতে গিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অসংখ্য অস্থায়ী সরকার গঠিত হয়েছে। যেমন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় চার্লস দ্য গল এর নেতৃত্বে স্বাধীন ফরাসি সরকার এবং পোল্যান্ড প্রবাসী সরকার গঠিত হয় লন্ডনে। প্রিন্স নরোদম সিহানুকের নেতৃত্বে স্বাধীন কম্বোডিয়ান সরকারের সদর দপ্তর ছিল বেইজিংয়ে। প্রবাসী পি.এল.ও সরকারের সদর দপ্তর স্থাপিত হয়েছিল প্রথমে বৈরুত, পরবর্তীতে আম্মান, সর্বশেষ তিউনিশিয়ায়। আফগানিস্তানের মোজাহেদিন সরকারের সদর দপ্তর ছিল পাকিস্তানের পেশোয়ারে। এসব সরকার সমূহের তুলনায় মুজিবনগর সরকার ছিল অনেকটা আলাদা। কারণ প্রচন্ড প্রতিকূলতার মধ্যে স্বাধীন অঞ্চলে নেতৃত্ব দান, দেশ বিদেশে ব্যাপক জনসমর্থন ও সহানুভূতি লাভ, নিজস্ব আয়-ব্যয়ের ব্যবস্থা, স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনা, বিদেশি কূটনৈতিক মিশন স্থাপন, নিজস্ব বেতার কেন্দ্র পরিচালনা এবং শক্তিশালী প্রতিপক্ষ পাকিস্তানে বিরুদ্ধে তুমূল প্রতিরোধ গড়ে তুলে বিজয় অর্জন ইত্যাদি দিক বিবেচনায় মুজিবনগর সরকার ছিল সত্যিই অতুলনীয়। ১৯৭১ সালের ১৭ই এপ্রিল শপথ গ্রহণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের একটি বৈধ কর্তৃপক্ষের সৃষ্টি হয়। শপথ গ্রহণের পর প্রধানমন্ত্রী তাজ উদ্দিন আহমদ তাঁর বক্তব্যে বলেন “আপনারা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিন, আপনার আমাদের সংগ্রাম সাহায্য করেন” বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে মুজিবনগর সরকারের কৌশলী কূটনীতি আমাদের স্বাধীনতার পথ সুগম করে। এই প্রবন্ধ মুজিবনগর সরকারের স্বাধীনতা সপক্ষে আন্তর্জাতিক তৎপরতার একটি বিশ্লেষণ।
বহির্বিশ্বে মিশন স্থাপনের তৎপরতা:
মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রথম দিকেই মুজিবনগর সরকার দিল্লি ও কলকাতায় বাংলাদেশের দুটি মিশন স্থাপন করে। নয়াদিল্লিতে মিশন প্রধান ছিলেন হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী এবং কলকাতায় বাংলাদেশ মিশন প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন জনাব হোসেন আলী। ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার শপথ গ্রহণের পর ১৮ এপ্রিল কলকাতাস্থ পাকিস্তান মিশনের সহকারি কমিশনার জনাব হোসেন আলী ১০ জন সহকর্মীসহ বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন এবং পাকিস্তান মিশন ভবন হতে পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। কলকাতাতেই প্রথম বাংলাদেশ মিশন স্থাপিত হয়। অবশ্য এ দূতাবাসের সহকারী প্রেস সেক্রেটারি আমজাদুল ও শেহাবউদ্দিন ৬ এপ্রিল স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে আনুগত্য ঘোষণা করেন। মুজিবনগর সরকার চট্টগ্রামের এম.এন.এ মুস্তাফিজুর রহমান সিদ্দিকীকে উত্তর আমেরিকায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত নিয়োগ করেন। ৫ আগস্ট ওয়াশিংটন পৌঁছে আগস্টের শেষ দিকে তিনি ১২২৩, কানেটিকাট এভেন্যুতে বাংলাদেশ মিশন স্থাপন করেন। ১৯৭১ সালের ৩ আগস্ট মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদে বৈদেশিক সাহায্য আইনের সংশোধনী পাশ হয়। এই সংশোধনী অনুযায়ী পাকিস্তানে সব ধরনের মার্কিন সাহায্য বন্ধ হয়ে যায়। সংশোধনী পাশে ওয়াশিংটনের বাংলাদেশ ইনফর্মেশন সেন্টার (ওয়াশিংটন প্রবাসী বাঙালি ও তাদের সমর্থকদের সমন্বয়ে গঠিত) ও বাংলাদেশ মিশন অক্লান্ত পরিশ্রম করে।
নিউইয়র্কে নিয়োজিত পাকিস্তানি ভাইস কন্সাল এ. এইচ. মাহমুদ আলী ২৬ এপ্রিল পাকিস্তানি পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। এর বেশ কিছুদিন পর মুজিবনগর সরকার নিউইয়র্কে বাংলাদেশের মিশন স্থাপন করে এবং বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ও নিউইয়র্ক দূতাবাসের প্রধান হিসেবে ঘোষণা করে। মাহমুদ আলী বিচারপতি চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন জাতিসংঘ প্রতিনিধি দলের সদস্য পদে অন্তর্ভূক্ত হন। ২৭ আগস্ট বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী লন্ডনস্থ বেজওয়াটার এলাকায় নটিংহিল গেটের নিকট ২৪ নম্বর পেমব্রিজ গার্ডেন্সে প্রায় ৩০০ বাঙালি এবং বহু বিদেশী সাংবাদিকের উপস্থিতিতে বাংলাদেশ মিশন উদ্বোধন করেন। বিচারপতি চৌধুরী এ মিশনেরও প্রধান নিযুক্ত হন। অন্যদিকে পূর্ব লন্ডনের ১১ নম্বর গোরিং স্ট্রিটে ৩ মে একটি অফিস নেয়া হয় যেখান থেকে বেসরকারি কর্মীরা সাংগঠনিক ও প্রচার কার্য পরিচালনার দায়িত্ব পালন করতেন। ৩০ অক্টোবর লন্ডনের হেনরি নর্টন স্কুলে বাংলাদেশ জাতীয় ছাত্র সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী আনুষ্ঠানিকভাবে এ সম্মেলন উদ্বোধন করেন এবং বিকালবেলার আলাচনা অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। সম্মেলনে ছাত্ররা ঘোষণা করে যে, পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া আর কোন সমাধান তাদের নিকট গ্রহণযোগ্য নয়। নভেম্বর মাসের শেষের দিকে বিচারপতি চৌধুরী লন্ডন থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রত্যাবর্তন করেন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ব্যাখ্যা করার জন্য হার্ভার্ড, নিউইয়র্ক সিটি, কলম্বিয়া, হোফস্ট্রা ও ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় এবং ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (এম আই টি) ও হার্ভার্ড স্কুল অব ল সফর করেন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন। বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশকারী পাকিস্তানের প্রাক্তণ রাষ্ট্রদূত আব্দুর রাজ্জাককে ১৩ সেপ্টেম্বর সুইডেনে বাংলাদেশের প্রতিনিধি নিয়োগ করে তা অনুমোদনের জন্য বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী মুজিবনগর সরকারকে পত্রযোগে অনুরোধ করেন এবং এটা কার্যকর হয়। উপর্যুক্ত দেশ ছাড়াও মুজিবনগর সরকার হংকং মহিউদ্দিন আহমেদ, ফিলিপাইনে কে.কে. পন্নী, নেপালে এ এম মুস্তাফিজুর রহমান, সুইজারল্যান্ডে ওয়ালিউর রহমান, জাপানে এস এম মাসুদকে কূটনৈতিক হিসেবে প্রতিনিধি হিসেবে নিযুক্ত করে।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কূটনৈতিক তৎপরতা :
বহির্বিশ্বে মুজিবনগর সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতা ছিল একটি উল্লেখযোগ্য বিষয়। মুজিবনগর সরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে বহির্বিশ্বে বিশেষ দূত নিয়োগ করে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে বহির্বিশ্বে সমর্থন ও জনমত আদায়ের চেষ্টা করেন। এছাড়াও বাংলাদেশের নাগরিক এবং সহানুভূতিশীল ব্যক্তিবর্গের মাধ্যমে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, সুইডেন, জাপান ও অন্যান্য কতিপয় শক্তিশালী দেশের সমর্থন লাভের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা চালান। এ ধরনের তৎপরতার ফলে ঐসব দেশে মুক্তিযুদ্ধের অনুকূল সংবাদ শিরোনাম প্রকাশিত হয়েছিল। ১৯৭১ সালে ১৮ ফেব্রুয়ারি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের অধিবেশনে যোগদানের জন্য জেনেভায় আসেন। এরপর হতে দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত তিনি দেশে ফিরে আসেননি। মুজিবনগর সরকার কর্তৃক প্রদত্ত তার মূল দায়িত্বই ছিল মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে বহির্বিশ্বে তৎপরতা চালানো। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল বিচারপতি চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর শারীরিক সুস্থতা ও প্রাণহানির আশংকায় বৃটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার আলোকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং বঙ্গবন্ধুর শারীরিক সুস্থতা সম্পর্কে নিশ্চিত হন। বিচারপতি চৌধুরীর তৎপরতায় ১৪ মে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের হাউস অব কমন্সে সর্বসম্মতভাবে প্রস্তাব পাশ হয় যে, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ব্রিটেনের যে প্রভাব রয়েছে তা খাটিয়ে পাকিস্তানকে সেনাবাহিনী প্রত্যাহারে বাধ্য করা ব্রিটিশ সরকারের কর্তব্য।
পাকিস্তানের অত্যাচারী সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ এবং স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের জন্য বিশ্ব জনমতকে প্রভাবিত করার উদ্দেশ্যে ১ আগস্ট লন্ডনের ট্রাফালগার স্কোয়ারে এক বিরাট জন সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। জন সমাবেশে ব্রিটেনের বিভিন্ন এলাকা হতে ২০ হাজারেরও বেশি বাঙালি যোগ দেন। এর পরপরই অপ্রত্যাশিতভাবে লন্ডস্থ পাকিস্তান হাই কমিশনে নিয়োজিত দ্বিতীয় সেক্রেটারি মহিউদ্দিন আহমদ পাকিস্তানের চাকুরি হতে ইস্তফা দিয়ে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। এরপর একে একে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নিয়োজিত বাঙালি কূটনীতিকগণ মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে আনুগত্য পরিবর্তন করতে থাকে। ১আগস্ট বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন ওয়াশিংটনে পাকিস্তানি দূতাবাসের ইকনমিক কাউন্সিলর এ এম এ মুহিত (সাবেক অর্থমন্ত্রী)। ৪ আগস্ট ওয়াশিংটনে অবস্থিত পাকিস্তান দূতাবাস ও নিউইয়র্কে অবিস্থত জাতিসংঘ দপ্তরে পাকিস্তানি মিশনের মোট ১৫ জন বাঙালি কূটনীতিক একযোগে পদত্যাগ করে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। ৫ আগস্ট বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন লন্ডনস্থ পাকিস্তান হাই কমিশনের ডিরেক্টর অব অডিট ও একাউন্টস জনাব লুৎফুল মতিন। বঙ্গবন্ধুর বিচারের প্রতিবাদে ১১ আগস্ট লন্ডনের হাইড পার্কে এক বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এই জনসভায় পাকিস্তান হাই কমিশনের কয়েকজন অফিসার বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। ম্যানিলায় নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত খুররম খান পন্নী এবং নাইজেরিয়ায় নিয়োজিত কূটনীতিক মহীউদ্দিন আহমদ জায়গীরদার ১৩ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে বাংলাদেশের পক্ষে যোগ দেন। ৪ অক্টোবর নয়াদিল্লিস্থ পাকিস্তানি দূতাবাসের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী প্রকাশ্যে বাংলাদেশের আন্দোলন যোগদান করেন। ফলে বাংলাদেশ সরকার তাকে দিল্লির ‘চিফ অফ মিশন’ পদে নিয়োগ করেন। ৮ অক্টোবর লন্ডনস্থ পাকিস্তান হাই কমিশনের ‘পলিটিক্যাল কাউন্সিলর’ রেজাউল করিম বাংলাদেশের পক্ষে যোগদান করেন। আর্জেন্টিনায় পাকিস্তানি দূতাবাসে নিয়োজিত বাঙালি রাষ্ট্রদূত আব্দুল মোমিন ১১ অক্টোবর পদত্যাগ করে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। ৩ নভেম্বর সুইজারল্যান্ডের পাকিস্তানি দূতাবাসের সেকেন্ড সেক্রেটারি ওয়ালিউর রাহমান পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে বাংলাদেশের পক্ষে যোগ দেন। ১ সেপ্টেম্বর বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী নরওয়ের রাজধানী অসলো পৌঁছান। অসলো শহরে ৬ দিন অবস্থানকালে তিনি নরওয়ের প্রধান বিচারপতি, অসলো বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ডিন, অসলোর মেয়র এবং পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রতিমন্ত্রী প্রমুখের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং স্থানীয় টিভিতে সাক্ষাৎকার প্রদানের মাধ্যমে বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের কারণ, বিদ্যমান পরিস্থিতি ও সংগ্রামের অগ্রগতি সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পেশ করেন। ৭ সেপ্টেম্বর বিচারপতি চৌধুরী সুইডেন গমন করেন। সুইডেন পৌঁছে তিনি সেখানকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি, লিবারেল পার্লামেন্টারি পার্টির চিফ হুইপ প্রমুখের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায় সাক্ষাৎকার প্রদান ও সাংবাদিক সম্মেলন করে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন। বিচারপতি চৌধুরীর অনুরোধে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক গুনার মীরডাল স্থানীয় বাংলাদেশ এ্যাকশন কমিটির চেয়ারম্যান পদ গ্রহণ করেন। ১৪ সেপ্টেম্বর বিচারপতি চৌধুরী ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেনে পৌঁছেন এবং পার্লামেন্ট ভবন গিয়ে সেখানকার বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সদস্য, পার্লামেন্টের স্পিকার এবং বৈদেশিক কমিটির সদস্যদের সঙ্গে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম নিয়ে আলোচনা করেন।
মুক্তিযুদ্ধের আন্তর্জাতিক জনমত গঠন :
১৯৭১ সালের ১৩-১৬ মে আব্দুস সামাদ আজাদের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সরকারের একটি প্রতিনিধি দল হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেষ্টে এক আন্তর্জাতিক শান্তি সম্মেলন যোগ দেন এবং পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধের সঠিক চিত্র তুলে ধরেন। এটাই ছিল প্রথম
আন্তর্জাতিক ফোরাম যারা প্রকাশ্যে বাংলাদেশকে সমর্থন দেয় এবং পূর্ব বাংলা না বলে সরাসরি “বাংলাদেশ” শব্দটি ব্যবহার করে। জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে যোগদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১ সালের অক্টোবরে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে ১৬ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল প্রেরণ করে।এ দলে ছিলেন শিক্ষক রাজনীতিবিদ ও কূটনীতিবিদ। ১৬ অক্টোবর হতে ২০ অক্টোবর তারা ওয়াশিংটনে সিনেটর কেনেডি, পার্সী ও কংগ্রেসম্যান গালাকারসহ জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দল বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ৪৭টি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেন। ২৬ জুলাই হাউস অব কমন্সের হাইকোর্ট রুমে স্বাধীন বাংলাদেশের ৮টি ডাকটিকিট প্রকাশ উপলক্ষে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বহির্বিশ্বে মুজিবনগর সরকারের বিশেষ দূত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী সদ্য প্রকাশিত ডাকটিকিটসমূহ প্রদর্শন করেন। দশ পয়সার টিকেটে বাংলাদেশের মানচিত্র এবং পাঁচ পয়সার টিকেটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের প্রতিকৃতি ব্যবহৃত হয়। বিদেশে চিঠিপত্র পাঠাতে ভারত সরকার এই ডাকটিকিটসমূহ ব্যবহারের অনুমতি দেয়। এর ফলে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়েই বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশের মর্যাদা পায়।
পাকিস্তানে সামরিক-বেসামরিক সাহায্য বন্ধের চেষ্টা :
বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতার অন্যতম লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানের সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য বন্ধ করা এবং পাকিস্তানকে কূটনৈতিকভাবে একঘরে করে ফেলা। এজন্য মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই পাকিন্তানে সামরিক সাহায্য স্থগিত করা এবং অর্থনৈতিক সাহায্য বন্ধ করার জন্য বিশ্ববাসীর প্রতি আহব্বান জানান। মে মাসের প্রথম দিকে বঙ্গবন্ধু’র অর্থনৈতিক উপদেষ্টা অধ্যাপক রেহমান সোবহান সরকারের নির্দেশে যুক্তরাষ্ট্রে যান। তিনি ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ সরকারের প্রথম প্রতিনিধি। দ্বিতীয় দফায় তিনি সেপ্টেম্বর হতে নভেম্বর পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করেন এবং বিশ্বব্যাংকের বার্ষিক সভায় তদ্বির, বাংলাদেশের জাতিসংঘ প্রতিনিধি দলে যোগদান, বাঙালি ও মার্কিন শুভানুধ্যায়ীদের সঙ্গে যোগাযোগ, মার্কিন কংগ্রেসে লবিং করা ইত্যাদি দায়িত্ব পালন করেন। এইড কন্সসিয়ার্স এর সদস্য দেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তিনি পাকিস্তানকে বৈদেশিক সাহায্য বন্ধ করার যুক্তি উপস্থাপন করেন। এসব তৎপরতার ফলে জুন মাসে বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফর করে। তাদের রিপোর্টের ভিত্তিতে দাতাগোষ্ঠী পাকিস্তানকে নতুন সাহায্যদানে বিরত থাকে এবং ঋণ রেয়তি দিতেও আপত্তি জানায়। ২ অক্টোবর ওয়াশিংটনে দাতাগোষ্ঠীর সভা বসে। এবারও পাকিস্তানকে সাহায্য প্রদান স্থগিত করা হয়। ১৯৭১ সালের ১৯ আগস্ট কানাডার টরেন্টোতে বাংলাদেশ সংকট নিয়ে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ব্রিটেন, কানাডা, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র প্রভৃতি দেশ জনপ্রিতিনিধিসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের নাম অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তি সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। উক্ত সম্মেলনে মুজিবনগর সরকারের প্রতিনিধি সাংসদ মুস্তাফিজুর রহমান সিদ্দিকী ও এ.এম আব্দুল মুহিতের প্রচেষ্টায় টরেন্টো ডিক্লারেশন অব কনসার্ন নামে যে ঘোষণা দেয়া হয় সেখানে পাকিস্তানে সব ধরনের সাহায্য বন্ধ রাখা এবং সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান দাবি করে বঙ্গবন্ধু’র মুক্তি ও জীবনের নিশ্চয়তা চাওয়া হয়।
মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে তহবিল সংগ্রহ :
মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে বিদেশে তহবিল সংগ্রহ করা ছিল বহির্বিশ্বে মুজিবনগর সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ তৎপরতা। ১৯৭১ সালের ৮ মে যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন এ্যাকশন কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের জরুরী মিটিংয়ে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে বাংলাদেশ ফান্ড নামে একটি তহবিল গঠন করা হয়। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ছিলেন এ ফান্ডের বোর্ড অব ট্রাস্টির সদস্য। এই ফান্ড ৩,৭৬,৫৬৮ পাউন্ড পরিমাণ অর্থ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের জন্য সংগ্রহ করে যা সরাসরি বাংলাদেশ সরকার গ্রহণ করেছিল। এছাড়াও বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন দেশ হতে সরাসরি যে সব অর্থ গ্রহণ করেছিল তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে-বাহরাইনের বাংলাদেশ ক্লাব হতে ১৪৯.৫৭ পাউন্ড ও কাতারের বাংলাদেশ শিক্ষা কেন্দ্র হতে ৩১০০.২৯ পাউন্ড এবং লিবিয়ার বাংলাদেশ শিক্ষা কেন্দ্র হতে ২৮৩২.৪২ পাউন্ড। ভারতে বিভিন্ন শহরে প্রদর্শনী ফুটবল ম্যাচের টিকিট থেকে প্রাপ্ত ৩ লক্ষ টাকা সরকারি ট্রেজারিতে জমা করা হয়। এছাড়াও কলকাতার বিভিন্ন ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানের নিকট হতে মুজিবনগর সরকার বেশ কিছু অর্থ নগদ সাহায্য হিসেবে গ্রহণ করেছিল। এ বিষয়ে ১৫ মে ১৯৭১ মুজিবনগর সরকার কলকাতার বাংলাদেশ মিশন হতে একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি জারি করেছিল। সুতরাং দেখা যায় যে, বিভিন্ন মাধ্যমে বহির্বিশ্ব হতে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের জন্য তহবিল সংগ্রহে মুজিব নগর সরকারের ভূমিকা ছিল অনন্য ।
বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে মানবজাতির সর্ববৃহৎ আন্তর্জাতিক ফোরাম জাতিসংঘের ২৬তম সাধারণ অধিবেশনে প্রেরিত বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল ১ অক্টোবর জাতিসংঘ ভবনের বিপরীত দিকে অবস্থিত চার্চ সেন্টারের একটি বড় হলঘরে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের উদ্দেশ্য ও আদর্শ ব্যাখ্যা করেন। এসময় বাংলাদেশ সমস্যা সমাধানের জন্য তিনটি পূর্বশর্ত উল্লেখ করেন। সেগুলি নিম্নরূপ-
১. গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দান।
২. অবিলম্বে এবং বিনা শর্তে গণতান্ত্রিক পন্থায় নির্বাচিত বাংলাদেশের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দান।
৩. ইয়াহিয়া খানের হানাদার বাহিনীকে বাংলার মাটি থেকে অবিলম্বে অপসারণ।
বহির্বিশ্বে মুজিবনগর সরকারের তৎপরতা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এক সোনালী অধ্যায়। কারণ এ ধরনের তৎপরতার ফলে বহির্বিশ্ব বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং পাক বাহিনীর ধর্ষণ, নির্যাতন ও গণহত্যা সম্পর্কে বিশ্ববাসী দলিলপত্রসহ জানতে পেরেছিল। বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ মিশন স্থাপন, কূটনৈতিক তৎপরতা, প্রতিনিদি প্রেরণ করে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সমর্থন লাভের চেষ্টা, বিদেশে তহবিল সংগ্রহ ইত্যাদি ছিল আন্তর্জাতিক বিশ্বে এসরকারের তৎপরতার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য দিক। তবে এসব তৎপরতার ক্ষেত্রে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী এক অসাধারণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। কারণ একই সঙ্গে তিনি ছিলেন মুজিব নগর সরকারের বিশেষ দূত। বহির্বিশ্বে তৎপরতার ফলে এ সত্যটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যে, বাংলাদেশ সমস্যা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সমস্যা বা শরণার্থী সমস্যা নয় বরং এটা ছিল শোষণ নিপীড়নের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতির স্বাধীনতার সংগ্রাম। মুজিব নগর সরকারের আন্তর্জাতিক তৎপরতা বহির্বিশ্বে উপরোক্ত সত্য প্রতিষ্ঠা করেছিল বিধায় মাত্র ৯ মাসের ব্যবধানে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আত্মসমার্পণের দলিলে স্বাক্ষর করতে বাধ্য হয়। বিশ্বমানচিত্রে অভ্যূদয় হয় স্বাধীন সার্বভৌম “বাংলাদেশ”।
লেখক ঃ শিক্ষক, ইতিহাস বিভাগ, চট্টগ্রাম কলেজ।