মুজাফরাবাদ গণহত্যা দিবস

121

সঞ্জয় চৌধুরী

কালের পরিক্রমায় দিনের পর আসে মাস, মাসের পর আসে বছর, আর বছরের পর আসে যুগ। এভাবে স্বাধীনতাত্তোর চারটি যুগ হারিয়ে গেছে আমাদের জীবন থেকে। এতগুলো যুগ আমাদের থেকে হারিয়ে গেলেও হারিয়ে যায়নি ’৭১ এর একটি দিন ৩ মে মুজাফরাবাদ গণহত্যা দিবস। এ দিনে পাকহানাদার বাহিনী অত্র গ্রামের নিরীহ তিনশতাধিক লোককে পাখির ঝাঁকের মত ভারী মেশিনগান দিয়ে তাঁদের বুককে ক্ষতবিক্ষত করে গুলি করে হত্যা করে। সেদিন হায়েনার দল এই গ্রামের তিনশতাধিক শহীদের রক্তে হোলি উৎসবে মেতে উঠছিল। অপরাধ শুধু একটাই,এটি ছিল হিন্দু অধ্যুষিত শিক্ষিত একটি গ্রাম। দিনটি ছিল সোমবার এবং আকাশ ছিল মেঘাচ্ছন্ন। সারারাত জেগে গ্রাম পাহাড়া দেয়ার পর একটু বিশ্রাম নেয়ার জন্য গ্রামবাসীরা যার যার ঘরে চলে যায়। কিন্তু কেউ কি জানত, এই বিশ্রামই হবে তাঁদের শেষ বিশ্রাম। ঐদিন খুব ভোরে পাঞ্জাবীরা চারদিক থেকে গ্রামে সশস্ত্র আক্রমণ চালায়, আর এর সমাপ্তি ঘটায় সন্ধার দিকে, চলতে থাকে হত্যা, ধর্ষণ ও লুটতরাজ ও ঘরে ঘরে অগ্নিসংযোগ ইত্যাদি। গ্রামের দিকে তাকালে দেখাযেত চারদিকে শুধু লাশ আর লাশ। শকুনরা চেটে খাচ্ছে সেই মৃত মানুষের দেহ। দুর্গন্ধে ভারী হয়ে ওঠেছে বাতাস।তারা গ্রামের ঘরবাড়ি এমনভাবে জ্বালিয়ে দিয়েছিল যে, চোখের পলকে একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত পর্যন্ত দেখা যেত। শিশু থেকে পৌঢ় পর্যন্ত কেউ এই নির্যাতন থেকে রেহায় পাইনি। মা, মেয়েকে পালাক্রমে ধর্ষণ করে গায়ে আগুন লাগিয়ে তাঁদের হত্যা করে। স্বামীর সামনে স্ত্রীকে ধর্ষণ, আর এর প্রতিবাদ করতে গিয়ে স্ত্রীর সামনে স্বামীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এমনকি পিতার মৃত্যু অবধারিত জেনেও পুত্র পিতার প্রাণভিক্ষা চাইলে একসাথে দুইজনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এক পূজারীকে পূজারত অবস্থায় মন্দির থেকে বাইরে এনে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ বলতে বললে তিনি হাসিমুখে ‘জয়বাংলা’ বলতে গিয়ে তাঁর মুখের ভিতর বন্দুকের নল ঢুকিয়ে তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হয়। শিক্ষাবিদ রায়মোহন বিশ্বাস যিনি গ্রামের শিক্ষাবিস্তরে অগ্রজ ভূমিকা পালন করতেন। সবসময় সাদাসিধে জীবনযাপন করতেন। ২ মে দিবাগত রাতে সারারাত গ্রাম পাহাড়া দিয়ে বিশ্রাম না নিয়ে কাক ডাকা ভোরে একটি জাল হাতে নিয়ে নিজের পুকুরে মাছ ধরতে যান।পরনে ছিল লুঙ্গী আর কোমরে ছিল গামছা। হঠাৎ দেখেন পাকিস্তানি কয়েকজন সৈন্য হাতে স্টেনগ্যান নিয়ে তাঁর সামনে হাজির। এই অবস্থা থেকে পালানোর কোন সুযোগ নেই। স্থানীয় একজন রাজাকার সৈন্যদের পরিচয় করিয়ে দেন তিনি জাতে হিন্দু এবং পেশায় একজন শিক্ষক।এরপর পাকসৈন্যরা তাঁর কোমরের গামছা খুলে দুই হাত বেঁধে স্ত্রী, পুত্র ও কন্যার সামনে তাঁকে গুলি করে হত্যা করে। তাঁকে হত্যা করা হচ্ছে দেখে তাঁরই দুই সহোদর রাজবিহারী বিশ্বাস ও প্রানহরি বিশ্বাস সৈন্যদের কাছে ভাইয়ের প্রাণভিক্ষা চান। নিষ্ঠুর সৈন্যরা প্রাণভিক্ষা তো দূরের কথা উক্ত দুই ভাইকে ও একসঙ্গে লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে। আমি মনে করিএই তিন ভাইয়ের রক্ত একই শ্রোতধারায় স্বাধীনতার উদিত লাল সূর্যের সাথে মিশে একাকার হয়ে এদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে এক উজ্জ্বল স্বাক্ষর বহন করেছে। গ্রামের বাসিন্দা বাবু স্বপন ঘোষ (সাবুল) মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত দিনগুলোর বর্ননা দিতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে বলেন, তখনকার দিনে তিনি দশম শ্রেণিতে পড়তেন। বাড়িতে পাক্ সৈন্যরা ঢুকতেই তিনি নিরূপায় হয়ে একটি গাছে লুকানো অবস্থায় দেখলেন পার্শ্ববর্তী বাড়িতে বাবার সম্মুখে কন্যার ইজ্জত হনন করা হচ্ছে।এইটি দেখে বাবা পাকহানাদার বাহিনীর হাত থেকে নিজ মেয়েকে বাঁচাতে গিয়ে তাঁদের রোষানলের স্বীকার হন এবং গাছের সঙ্গে বেঁধে রাইফেলের গুলিতে ক্ষতবিক্ষত করা হয় তাঁর শরীর।মেয়ের সামনে বাবার মৃত নিথর দেহ মাটতে লুটিয়ে পড়ল। এর মধ্যে তিনি গাছের উপর থেকে দেখলেন পাক-হানাদার বাহিনী তাঁদের পুকুরের এক পাড় থেকে অপর পাড়ে আশ্রয়রত অবস্থায় দুইজন পুরুষ ও দুইজন মহিলাকে দেখে ব্রাশ ফায়ার করলে এই চারজনের মৃতদেহ গড়িয়ে গড়িয়ে পুকুরে লুটিয়ে পড়ে। পাক-হানাদার বাহিনী চলে যাওয়ার পর তিনি গাছ থেকে নেমে প্রতিবেশী পেটান ঘোষকে নিয়ে নিজের হাতে এই চারটি লাশকে পুকুরের পানি থেকে তুলে পাড়ের উপর সৎকার করেন। সেদিনের স্মৃতি বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি আরো বলেন স্থানীয় যে সব নরপিশাচদের সহযোগিতায় পাক-হানাদার বাহিনী ৩ মে মুজাফরাবাদ গ্রামে গণহত্যা চালিয়েছে সারাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সঙ্গে সঙ্গে এ সমস্ত নরপিশাচদের ও বিচারের আওতায় আনার জন্য তিনি সরকারের কাছে উদাত্ত আহবান জানান। রূহিনী দত্ত যিনি পালাকীর্তন করতেন এষং পল্লীগীতি গাইতেন। পাক্ সৈন্যদের গ্রাম আক্রমণের কথা শুনে বাড়িসংলগ্ন পেছনের পুকুরে নাক উঁচু করে পানিতে লুকিয়েছিলেন তিনি। বাড়িতে যখন হানাদার বাহিনী প্রবেশ করে তখন এ খবরটি তাঁকে দিতে তাঁর স্ত্রী আসেন পুকুর ঘাটে।এ ঘটনাটি একজন রাজাকারের চোখে পড়ে যায়। সে তখন পাক্ সৈন্যদের ডেকে আনে এবং পাক্ সৈন্যরা পুকুরে বৃষ্টির মত গুলি বর্ষণ করে।কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে রূহিনী দত্ত ডুব দেয় এপাড় থেকে ওপাড়ে।এভাবে আর বেশিক্ষণ থাকতে পারলেন না তিনি।
অবশেষে শেষ ডুবের পর উপরে উঠে আসতে পারেন নি তিনি। তাঁর রক্ত পানির সাথে মিশে সেই মিলিত প্রবাহের শক্তি এদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সফলতার দিকে এগিয়ে নিয়ে গেছে বলে আমি মনে করি। মধ্যম পাড়ার নির্মল সেন ছিলেন খুবই সাহসী এবং প্রতিবাদী।৩মে সকালে তিনি নিজবাড়ির একটি গাছতলায় বসে হস্তশিল্পের কাজ করছেন। হঠাৎ দূরে পাক্ হানাদার বাহিনীদের দেখে নিরুপায় হয়ে পালানোর সময় দেখেন, এক জায়গায় মহিলাদের উপর অমানবিক নির্যাতন চলছে। তবুও তিনি প্রাণ বাঁচানোর জন্য পাশে একটি ঝোঁপে লুকিয়ে পড়েন। ঐ ঝোঁপ থেকে তিনি দেখলেন একজন সৈন্য অস্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে আছে। সেই তেজী নির্মল সেন ঐ সৈন্যকে একাকী দেখে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন।এতে ঐ সৈন্য যখন মার খেয়ে একদম দুর্বল হয়ে পড়ে তখন তাকে জানে মেরে ফেলার জন্য নিয়ে যাওয়ার পথে একটি ঘরের মধ্যে নারী নির্যাতনে লিপ্ত দুই তিনজন সেনা সদস্য জানালা দিয়ে তা দেখে ফেলে। নির্মল সেন কতৃক একজন সৈন্যকে মেরে ফেলার জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে দেখে ঐ দুই তিনজন সৈন্য নারী নির্যাতনরত অবস্থায় ঘর থেকে বেরিয়ে আসে এবং পরবর্তীতে নির্মল সেনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাঁকে শারীরিকভাবে নির্যাতন শুরু করে। নির্মল সেন এই নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে অবশেষে তাঁকে বাঁচানোর জন্য বাবা উপেন্দ্র সেনকে ডাক দিলে পিতা ছেলের আর্তনাদ আর সহ্য? করতে না পেরে লুকিয়ে থাকা ঝোঁপ থেকে বেরিয়ে এসে সৈন্যদের কাছে পুত্রের প্রাণভিক্ষা চান। এতে প্রাণভিক্ষা তো দূরের কথা পিতা পুত্রকে এক সাথে বেঁধে কিছুদূর নিয়ে গিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ ভাবে একদিনে এ গ্রামে কত যে লৌহমর্ষক ঘটনা ঘটেছে তা হিসেব রাখা কষ্টসাধ্য।বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে একদিনে এক গ্রাম থেকে তিন শতাধিক শহীদের আত্মদান আর ২য় ঘটেছে কিনা আমার জানা নেই। হয়তো বা ইতিহাসের পাতা উল্টালেও তার ব্যতিক্রম হবে না।বর্তমানে পটিয়ার মাননীয় সংসদ সদস্য ও মহান জাতীয় সংসদের মাননীয় হুইপ আধুনিক পটিয়ার রূপকার জনাব সামশুল হক চৌধুরীর সহযোগিতায় এ দিনটিকে স্থানীয়ভাবে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় পালন করা হচ্ছে। হয়তো বা মৃত্যুর পরপার থেকে এইসব শহীদরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে এবং তাঁদের অতৃপ্ত আাত্মা খোঁজ নিচ্ছে স্বাধীনতার এই ঊনপঞ্চাশ তম বছরে এসে তাঁদের পরিবার পরিজনরা কি অবস্থায় আছে?
তাঁদের জীবন মান উন্নয়নকল্পে আমি মাননীয় সংসদ সদস্য জনাব সামশুল হক চৌধুরীর সহযোগিতা কামনা করছি। এ দিনটির চেতনা সৃষ্টিকারী সংগঠন ‘সমন্বয়’ এবং সাথে বধ্যভূমি সংরক্ষণ পরিষদ এবছর কোভিড-১৯ করোনাজনিত বৈশ্বিক মহামারীর কারণে অনুষ্ঠান সংক্ষিপ্ত করে তিন শতাধিক শহীদের স্মরণে শহীদ পরিবার ও নিম্ন আয়ের জনগণের কাছে ত্রাণ দেয়ার যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে আমেরিকায় বসবাসকারী সমন্বয়ের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ড. প্রদীপ ঘোষ ও প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আমার পক্ষ থেকে ৩ মে উদ্যাপন পরিষদ -২০২০ কে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। জয় হোক তিন শতাধিক শহীদের আত্মদান।

লেখক : শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট