মুক্তিযোদ্ধা মীর রমজান আলী

33

আজ ৪ মার্চ। ২০১২ সালের এই দিনে রাত ১.৪০টায় এই মহৎপ্রাণ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। কিভাবে তাকে আখ্যায়িত করি? একজনের মধ্যে এত গুণ! দেশের জন্য জীবনবাজী রেখে যুদ্ধ করেছেন। এজন্য তো আজীবন শ্রদ্ধার পাত্র। তিনি আজীবন সমাজের একজন সংগঠক, সমাজসেবক, লেখক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট হিসেবে কাজ করেছেন। ছোট বড় সকলের নিকট বন্ধুভাবাপন্ন ছিলেন। কড়া কথা বলেন নি কখনো। কোন সিদ্ধান্ত পছন্দ না হলে বুঝিয়ে সুঝিয়ে সঠিক পথে নিয়ে আসার চেষ্টা করেছেন।
বহু আগে থেকেই বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে তাঁর সাথে দেখা হত। ২০০৭ সালে রোটার‌্যাক্ট ক্লাব অব চিটাগাং গ্রীন সিটিতে যোগদানের পর মীর রমজান আলী’র একমাত্র ছেলে মীর নাজমুল আহসান রবিনের মাধ্যমে আস্তে আস্তে তাঁর সান্নিধ্যে যায়। আগাগোড়া অসাম্প্রদায়িক এক ব্যক্তিকে আমি খুঁজে পাই মীর রমজান আলীর মাঝে। তাঁর চিন্তা-চেতনা সবকিছু ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শের একটি অসাম্প্রদায়িক দেশ গড়ে তোলা।
১৯৭৮ সালে লায়ন্স ক্লাবের মাধ্যমে সামাজিক কর্মকান্ডে প্রবেশ করেছিলেন এবং আমৃত্যু লায়নিজমের সাথে জড়িত ছিলেন। প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে ১৯৮৬ সালে জাতিসংঘের অঙ্গ সংগঠন ফেডারেশন অব ইউনেস্কো ক্লাবস্ বাংলাদেশ গঠন করেন। ঢাকা ও চট্টগ্রামের জাতীয় দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকায় নিয়মিত লেখক ছিলেন। আজকের সুর্যোদয়ের নিয়মিত কলামিস্ট ছিলেন। এছাড়াও বাংলাদেশ বেতার চট্টগ্রামের বিশেষ সংবাদদাতা ছিলেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত জাতীয় পত্রিকা দৈনিক প্রভাতের চট্টগ্রাম ব্যুরো চীফ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৪৮ সালের ৫ আগস্ট পবিত্র রমজান মাসে তাঁর জন্ম। বাবা-মা মরহুম মীর আহসান আলী ও মরহুমা আয়জুন্নেসা খাতুন তখন তাঁদের সদ্যোজাত পুত্রের নাম রেখেছিলেন ‘রমজান’। বৃহত্তর ঢাকার অধুনা মুন্সিগঞ্জ জেলার অন্তর্গত ঐতিহ্যবাহী বিক্রমপুর অঞ্চলের শ্রীনগর থানার বিশ্ববিশ্রুত বাঙালি বিজ্ঞানী স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু খ্যাত রাডিখাল ইউনিয়নভুক্ত দামলা গ্রামের অভিজাত, ঐতিহ্যবাহী ’মীর বাড়ি’র ধারা মেনে ’রমজান’ এর আগে যুক্ত ’মীর’ এবং সম্ভবত পিতৃ নামের অনুসরণে শেষাংশে যুক্ত হল আলী, যার ফলে বলাবাহুল্য তার পুরো নামটি হয়ে দাঁড়াল-মীর রমজান আলী। রমজান সাহেব ঢাকার অধুনালুপ্ত, স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পোগোজ স্কুল থেকে মেট্রিক, চট্টগ্রাম সিটি কলেজ থেকে আই.এ এবং নারায়নগঞ্জের তোলারাম কলেজ থেকে বি.এ পাস করেন। পুরনো ঢাকার ২৫/১ বাহাদুরপুর লেইন, ফরিদাবাদে তাদের পৈত্রিক বাড়ি রয়েছে। ১৯৭৪ সালের ২৮ এপ্রিল ২৬ বছর বয়সে তিনি মুন্সিগঞ্জের লৌহজং থানার যশোলদিয়া জমিদার বাড়ির ডা. গাজী আবুল কাশেম (চুন্নু গাজি)’র দ্বিতীয় কন্যা ডা. রওশন আরা আক্তার (নাজমা)’র সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯৯৫ সালের ২১ সেপ্টেম্বর সামান্য একটি টিউমার অস্ত্রোপচার করতে গিয়ে অ্যানেস্থেসিয়া প্রয়োগে ভুলের কারণে তার সহধর্মিণীর দুঃখজনক অকালমৃত্যু ঘটে। সেই থেকে তিনি তার সন্তানদের জন্য একাধারে বাবা এবং মা দুই-ই ছিলেন। মীর রমজান আলীর দুটি গ্রন্থও প্রকাশিত হয়েছে। যার মধ্যে প্রবন্ধটি ১৯৭৫ সালের বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডকে ঘিরে স্মৃতিচারণমূলক বই ’স্মৃতির দুয়ারে তুমি’ (প্রকাশ কাল ১৯৯১) এবং দ্বিতীয় বই তার প্রয়াত স্ত্রীর মৃত্যুর পর স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থ ’কেমন আছো জানতে ইচ্ছে করে’ (প্রকাশকাল ১৯৯৭) প্রকাশিত হয়েছে। এ ছাড়াও মাইজভান্ডার শরীফ : ঐশ প্রেক্ষিত’ নামে একটি বইয়ের প্রকাশক ছিলেন। মীর রমজান আলী ’৭১ এর আগে ও পরে দীর্ঘদিন তিনি ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন। তাঁর ভগ্নিপতি ডা. মোশাররফ হোসেন ছিলেন ১৯৭০ ও ১৯৭৩ সালের জাতীয় সংসদের সদস্য ও বোন আশরাফুন্নেসা ছিলেন বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ও জাতীয় সংসদের সদস্য ছিলেন।
মীর রমজান আলী ইউনেস্কো ক্লাবস ও লায়ন্স ক্লাব ইন্টারন্যাশনালের প্রতিনিধি হিসেবে জার্মানি, থাইল্যান্ড, ভারত প্রভৃতি দেশ সফর করেছেন। মীর নাজমুল আহসান রবিন তার বাবা মীর রমজান আলীর বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত কলামগুলোকে একই মলাটে আবদ্ধ করে ’মীর রমজান আলীর রচনা সমগ্র’ নামে একটি বই প্রকাশ করেছে ২০১২ সালে তাঁর মৃত্যুর পর। মীর রমজান আলীর স্মৃতির প্রতি আমরা বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই।
লেখক : প্রবন্ধিক