মুক্তিযুদ্ধ এবং আমাদের সাহিত্য

288

স্বাধীনতাহীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে
দাসত্ব শৃঙ্খল বল কে পরিবে পায় হে
কে পরিবে পায়
রঙ্গলাল বন্দোপাধ্যায়ের এই কবিতায় কবির ব্যক্তিগত স্বাধীনতার প্রতি মানসিক, শারিরীক ক্ষুধাই শুধু প্রতিফলিত হয়নি বরং প্রতিটি মানুষের স্বাধীনতার প্রতি যে তীব্র আকাঙ্ক্ষা তারও বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। ১৯৪৭ সালের পর থেকে যে শাসক গোষ্ঠির সঙ্গে মানসিক অন্তর্দ্ব›দ্ব -সংঘাত, ঘাত-প্রতিঘাতের সৃষ্টি হয়েছিলো তা ক্রমেই স্ফুলিঙ্গের মতো ছড়িয়ে পড়েছে বাঙালি মনে। এ যেন সেই দাবানল যা অভীষ্ট লক্ষ্যে উপনীত না হওয়া পর্যন্ত পুড়িয়ে দেবে দেহ, মন, আত্মা, মাঠ-ঘাট, কলকারখানা। সেই পরিক্রমার পথ ধরে ভাষা আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের পরে নির্দিষ্ট ভূখÐ, পতাকা পেয়েছি ঠিকই, কিন্তু তার আগে দীর্ঘকালের অপশাসন, রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন, অন্যায়, বঞ্চনার কারণে আমাদের মন ও চেতনা, এমনকি সত্তা জুড়ে ছিলো আগ্নেয়গিরি সদৃশ ক্ষোভ, ঘৃণা। আমাদের সাহিত্যে তারই প্রতিফলন ঘটেছে। আর মুক্তিযুদ্ধ প্রধান অনুষঙ্গ হয়ে আমাদের প্রবন্ধ, নাটক এবং গল্প উপন্যাসে উঠে এসেছে বার বার। মুক্তিযুদ্ধ এমন এক ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মকে লালন পালন করতে হয় সংস্কৃতি ও শিল্পে। সেই ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা এখনো চলছে।
স্বাধীনতার পরবর্তী পর্যায়ে জনগণের মধ্যে যে সচেতনাবোধ, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকার প্রবণতা আমরা লক্ষ্য করি তা একদিনে হয় নি। সেটি বহুপ্রাচীনকালের গর্ভ থেকে সিঞ্চিত হয়ে ছুরির মতো তীক্ষ্ণ এবং ধারালো হয়েছে। ৩০ লক্ষ শহীদের আত্মত্যাগ, সর্বহারা হওয়ার বেদনা, মা বোনের সম্ভ্রম লেখকদের মনকে করেছে ক্ষত-বিক্ষত। সেই রক্তক্ষরণের আর্তি বাংলা সাহিত্যে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। ১৯৭১ সালে ৩০ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার পর আমাদের দেশে নতুন উদ্যমে, নতুন প্রেরণায়, নতুন চেতনায় সাহিত্য আন্দোলন শুরু হয়। আমাদের সাহিত্য পায় নতুন ভাষা, নতুন বিষয়। তাই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে রচিত সাহিত্য আমাদের প্রাণের নিঃশ্বাসের মত। এই সাহিত্য শুধু বাংলা সাহিত্য নয়, বিশ্বসাহিত্যেও এক নতুন তরঙ্গ তুলেছে বলে অনেকের অভিমত।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধ সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছে কবিদের। এর কারণ হতে পারে কবিতার সংক্ষিপ্ত পরিসরে বিশাল বিস্তৃতি টানার অবকাশ। তাই সাহিত্যের অন্যান্য শাখার চেয়ে কবিতায় মুক্তিযুদ্ধের দ্রোহের অগ্নির মাত্রা যেন বেশি।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমাদের প্রধান কবিদের লেখা কবিতাগুলো জনপ্রিয়তা সর্বকালের সকল কবিতাকে ছাড়িয়ে গেছে। আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর ‘মাগো ওরা বলে’ কবিতাটি বাংলা ঘরে ঘরে আবৃত্তি হয়। রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর ‘কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প’ কবিতায় যন্ত্রণাময় বিশাল এক অধ্যায়ের বর্ণনা করেছেন মাত্র কয়েকটি লাইনে। “বাতাসে লাশের গন্ধ পাই” কবিতাটিতে “জাতির পতাকা খামচে ধরেছে আজ সেই পুরোনো শকুন” অতীত বিস্মৃতির ভেতর যেন বর্তমান যোগসূত্র স্থাপন করে শিল্পের ভেতর মূর্ত হয়েছে দ্রোহ এবং দেশপ্রেম। মুক্তিযুদ্ধের সেই ঘৃণা, ক্ষোভ, দহনের ভেতর পুড়ে যাচ্ছে কবি ও পাঠকের জীবনদৃষ্টি…

আজো আমি বাতাসে লাশের গন্ধ পাই,
আজো আমি মাটিতে মৃত্যুর নগ্ননৃত্য দেখি,
ধর্ষিতার কাতর চিৎকার শুনি আজো আমি তন্দ্রার ভেতরে-
এ দেশ কি ভুলে গেছে সেই দুঃস্বপ্নের রাত, সেই রক্তাক্ত সময়?

কবি শামসুর রহমানের ‘সন্ত্রাসবন্দী বুলেটবিদ্ধ দিনরাত্রি’ ‘স্বাধীনতা তুমি’ এ কবিতাগুলোর আকুতি বা আবেদন সার্বজনীন। যার বৈপ্লবিক চেতনা শেষ হবার নয়। কালোত্তীর্ণ এ কবিতাগুলোর দেহ জুরে বেয়োনেটের সুদূরপ্রসারী রক্তপাত। যা ধারণ করছে নির্মম অত্যাচারের ভয়ংকর সব চিত্র…

কখনো নিঝুমপথে হঠাৎ লুটিয়ে পড়ে সেই গুলির আঘাতে,
মনে হয় ওরা গুলিবিদ্ধ করে স্বাধীনতাকেই।
দিন-দুপুরেই জীপে একজন তরুণকে কানামাছি করে
নিয়ে যায় ওরা;
মনে হয় চোখ-বাঁধা স্বাধীনতা যাচ্ছে বধ্যভূমিতে।
বেয়নেটবিদ্ধ লাশ বুড়িগঙ্গা কি শীতলক্ষ্যায় ভাসে;
মনে হয়, স্বাধীনতা— লখিন্দর যেন
বেহুলা-বিহীন
জলেরই ভেলায় ভাসমান।
মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে কবিরা সমকালকে ধারণ করার পাশাপাশি নতুন মূল্যবোধ, নতুন স্বপ্নের চিত্র এঁকেছেন শব্দের তুলিতে। এই মুল্যবোধ, দর্শন মানব মনে সঞ্চার করেছে প্রাচীন রক্তের আদিমতা। পৃথিবীর মানুষ বাঙালিকে জেনেছে বীর যোদ্ধা হিসেবে।
“রাষ্ট্রপ্রধান কি মেনে নেবেন আমার প্রস্তাবগুলো
পররাষ্ট্রনীতির বদলে প্রেম, মন্ত্রীর বদলে কবি
মাইক্রোফোনের বদলে বিহবল বকুলের ঘ্রাণ?”
শহীদ কাদরীর “রাষ্ট্রপ্রধান কি মেনে নেবেন?” এই কবিতার শিরোনাম থেকে শুরু করে প্রতিটি লাইনে যে আত্মপীড়ন, জিজ্ঞাসা তা মুক্তিকামী মানবিক মনের গহীন থেকে হঠাৎ করে উঠে আসা কোন দীর্ঘশ্বাস নয়। এই পরিবর্তন, দ্বন্দ্বযুদ্ধ, হৃদয়ভিত্তিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া ইতিহাসের বাঁক থেকে সৃষ্ট হওয়া দীর্ঘ সময়ের ক্ষোভের প্রতিফলন। পুর্ব অভিজ্ঞতার জাগরণ না থাকলে এমন কবিতার সৃষ্টি প্রায় অসম্ভব।
নির্মলেন্দু গুনের ‘স্বাধীনতা এই শব্দটি আমাদের কী করে হলো’ কবিতাটিও জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠেছে। এই কবিতার শিরোনাম বলে দেয় স্বাধীনতা শব্দটি হঠাৎ করে বাঙালির চেতনায় উদ্ভূত হয়নি। চেতনাহীনকে জাগ্রত করার জন্য দীর্ঘ সংগ্রাম, রক্তাক্ত নদী পার হতে হয়েছে। শোষণের সেই অধার্মিকতা আমাদের জাতির গুনগত কাঠামো পরিবর্তন করে সাহিত্যের অপ্রশস্ত পথকে করেছে সুপ্রশস্ত, দৃঢ়। কবি তাই কলমে লিখে রেখে যাচ্ছেন শ্রেষ্ঠ বিকেলের গল্প। এই দীর্ঘ সোনালি বিকেলের ছায়া ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ছুঁয়ে যাবে নিশ্চিতভাবে।
যখন সমাজ জীবনে শ্রেণী বর্ণকে কেন্দ্র করে সংকট ব্যাপক আকার ধারণ করেছিলো তখন মুক্তিযুদ্ধের অসা¤প্রদায়িকতা বৈষম্য দূর করে সামষ্টিক চিন্তার পথকে উন্মোচিত করেছে। সমগ্র বিচ্ছিন্নতাকে আড়াল করে একীভূত করেছে আমাদের দ্বান্দ্বিকতা। পাকিস্তানী শোষণের স্মৃতির বিপরীতে উজ্জীবিত চেতনা বাঙালিকে দিয়েছে পর্যবেক্ষণ শক্তি। গতিশীল করেছে সাহিত্য জগতকে। তাইতো শামসুর রাহমানের “অভিশাপ দিচ্ছি” কবিতায় রক্তের বদলে রক্ত কিংবা চোখের বদলে চোখ নয় বরং শত্রুকে দেখার সম্পূর্ণ নতুন এক উদার দৃষ্টিভঙ্গি এবং মানসিকতা তৈরি হয় পাঠকের মধ্যে।
“অভিশাপ দিচ্ছি ওদের তৃষ্ণায় পানপাত্র প্রতিবার
কানায় কানায় রক্তে উঠবে ভরে, যে রক্ত বাংলায়
বইয়ে দিয়েছে ওরা হিংগ্র জোয়ারের মত”
একজন কবির কণ্ঠেই কেবল এমন বহুমাত্রিক উচ্চারণ প্রতিধ্বনিত হতে পারে। যেখানে হিংসাকে ছাপিয়ে অহিংসামন্ত্র পাঠে মগ্ন হন পরম শত্রুও। দৃষ্টিভঙ্গির এই পরিবর্তন জীবনের মূল্যবোধের বিপর্যয় রোধ করে।
আবার কখনো কখনো কবি সমস্ত বহির্জগত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মেতে ওঠেন আত্মমগ্নতায়। যুদ্ধের চেতনা সামাজিক পরিমন্ডলে যে গণতন্ত্রের সূচনা করেছে তাতে ব্যক্তির ব্যর্থতাবোধ, স্বপ্ন, নিজস্বতা সমষ্টির মধ্যে আন্দোলন তৈরি করবে এটাই স্বাভাবিক। সেই প্রয়াসেই যেন কবি নিজেকে গুটিয়ে ফেলেন চারদেয়ালে।
“এ লাশ আমরা কোথায় রাখবো? কবিতাটিতে কবি সমস্ত পৃথিবী থেকে নিজেকে পৃথক করে বর্তমান সমাজের ব্যক্তিসত্তাকেই যেন স্বীকার করে নিজস্বতার মধ্যে বিলীন হতে চান। পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন শৃঙ্খলিত মনের স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গি। ব্যক্তির গর্বিত আত্মপ্রকাশ আমাদেরকে স্বাধীন পথ চলতে সাহসী করে তুলে।
সিকান্দার আবু জাফরের “জনতাকে দেখছি” কবিতায় কবি ভিসুভিয়াসের অগ্ন্যুৎপাতের সাথে মুক্তিযুদ্ধকে তুলনা করেছেন। বৃষ্টির নরম গন্ধ আর বিপ্লবের মধ্যে বিপরীতধর্মী সম্পর্ক বিদ্যমান থাকলেও সেই নরম উৎসবে মত্ত সরল মানুষের মনে বিপ্লবের ব্যাকুলতা কেমন করে স্বাধীনতাবোধ জাগিয়ে তুলল সেই পটভূমি দেখতে পাই এই কবিতায়।
প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত হয়েছে অসংখ্য কবিতা। বর্তমানের কবিতাগুলো যেন মুক্তিকামী মানুষের আর্তনাদের যন্ত্রণায় কেঁপে ওঠা শব্দমালা। আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর “আমি কিংবদন্তির কথা বলছি” মহাদেব সাহার “ ফিরে আসা গ্রাম” আবুল হাসানের ‘উচ্চারণগুলি শোকের’ এমন অসংখ্য কবিতা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে প্রকাশিত।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা শুধু সাহিত্যে নয়, স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর থেকেই মুক্তিযুদ্ধের উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। “ওরা এগারো জন” মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রথম চলচ্চিত্র। এই চলচ্চিত্র সেই সময়কার বাস্তবতার চরম দলিলপত্র। যুদ্ধের রাতগুলোর বিবর্ণতা, গোলাগুলি, ধর্ষণ সবকিছুতে যেন দেশটির সংগ্রাম ও নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্র ধারণ করা হয়েছে। যদিও ছবিটির শিল্পমান নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে কিন্তু সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশটির সংকটময় পরিস্থিতি তুলে ধরার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হয়েছে এই চলচ্চিত্রে। “আগুনের পরশমণি” “জয়যাত্রা” “জীবন থেকে নেয়া” এসব ছবিতে যুদ্ধকালীন সংকট, দেশ ত্যাগ, জ্বালাও-পোড়াও এমনকি চালের দামের উর্ধ্বগতি, যুদ্ধপরবর্তী জনগণের মধ্যে হঠাৎ করে শ্রেণী বৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করার চিত্র, দরিদ্র জনগণের হাহাকারও দেখতে পাই।
আমাদের কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস, ছড়া, চলচ্চিত্র, নাটক, প্রবন্ধ, স্মৃতিচারণ, শিশুসাহিত্যে সুদূরপ্রসারি প্রভাব ফেলেছে মুক্তিযুদ্ধ। আমাদের জাতীয় সত্তায়, আমাদের অনন্ত রক্তের ভেতরে মিশে আছে মুক্তিযুদ্ধের আবেগ। এই আবেগের ফলে আমাদের সাহিত্যে নতুন ধারা প্রবর্তিত হয়েছে এবং অনাদিকাল প্রবাহিত থাকবে। যতই দিন এগুতে থাকবে ততই আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ নতুন নতুন সাহিত্য সৃষ্টির প্রেরণা যোগাবে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ফসল হিসেবে একটি স্বাধীন ভূখন্ড, লাল সবুজের যে পতাকা আমরা পেয়েছি, সেই ভূখন্ডকে অখন্ড রাখার এবং সেই পতাকা বয়ে বেড়াবার শক্তি যোগাবে মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্য। মুক্তিযুদ্ধের পর মাত্র ৪৬ বছর অতিক্রম করেছি আমরা। কালজয়ী সাহিত্য রচনার জন্য এটি যথেষ্ট সময় নয়। ভাবীকালের কোনো কবি কিংবা কথাশিল্পীর হাতেই হয়তো রচিত হবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সর্বকালের সেরা সাহিত্য। কারণ ভূখন্ড আর পতাকার লড়াই শেষে সকল ধরনের অমানবিক, অপশক্তি, কূপমন্ডুকতা, ধর্মান্ধ মৌলবাদীতার বিরুদ্ধে বাঙালির মুক্তির সংগ্রাম, মানুষের মুক্তির সংগ্রাম চলতেই থাকবে।