মুক্তিযুদ্ধে পশ্চিম পটিয়ার তিন আলোকস্তম্ভ

312

নাসিরুদ্দিন চৌধুরী

আমি মুক্তিযুদ্ধের কথা বলছি। আমার লেখালেখি পড়ে যারা বলেন, মুক্তিযুদ্ধ তো কবে শেষ হয়ে গেছে। এত বছর পরে আবার মুক্তিযুদ্ধের কথা কেন? তাদের উদ্দেশে আমার বিন¤্র জবাবÑ মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়নি। মুক্তিযুদ্ধ অনির্বাণ, অবিনাশী। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে আমাদের জীবনে। তবেই না মুক্তিযুদ্ধের পথ থেকে আমরা বিচ্যুত হবো না। স্বাধীন বাংলাদেশে সাতচল্লিশ বছরের পথ চলায় কতবারই তো হোঁচট খেতে খেতে মুক্তিযুদ্ধ আবার উঠে দাঁড়িয়েছে আপন শক্তিতে। কখনো মোশতাক, কখনো জিয়া, কখনো এরশাদ, কখনো নিজামী, মুজাহিদ, কখনো সাকা মুক্তিযুদ্ধকে ধামাচাপা দিতে চেয়েছে, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ ঠিকই জাতির জীবনে ফাল্গুধারার মতো প্রবহমান ছিলো নিরন্তর। সুতরাং মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের শেকড়, মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির প্রাণশক্তি। একজন বাঙালি বেঁচে থাকতেও মুক্তিযুদ্ধের পতাকা ভূলুণ্ঠিত হতে দেবেনা এদেশে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় স্থিত থাকলেই এদেশকে আর কেউ কখনো বেপথু করার দুঃসাহস পাবে না।
আজকে আমি পটিয়ার তিনজন জ্যেষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধার কথা বলবো। অধ্যক্ষ আহমদ মনীর, ডাক্তার শামসুল আলম, মাস্টার রফিকুল আলম চৌধুরীÑপশ্চিম পটিয়ার মুক্তিযুদ্ধের জ্বল জ্বল করা তিনটি নাম। কিন্তু শুধু পশ্চিম পটিয়ায় সীমাবদ্ধ ছিলো না তাদের কর্মকৃতি। সমগ্র দক্ষিণ চট্টগ্রাম, এমনকি শহর এবং ভারতের হরিণা, আগরতলায় যারা মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করতেন, তাঁদের কাছেও অজ্ঞাত ছিলো না এই নামগুলির মাহাত্ম্য। তাঁরা হয়তো গ্রæপ কমান্ডার ছিলেন না, কিন্তু কত মুক্তিযোদ্ধা গ্রæপকেই না তাঁরা গাইড করেছেন, পরিচালনা করেছেন। মুক্তিযোদ্ধা গ্রæপ সৃষ্টির উৎসই তো ছিলেন তাঁরা। তাঁরা যদি বেইজ সৃষ্টি করে না রাখতেন, তাহলে মুক্তিযোদ্ধা গ্রæপের অস্তিত্ব কিভাবে টিকে থাকতো। ভারত থেকে গ্রæপ নিয়ে কমান্ডাররা দেশে এসে তাঁদেরই আশ্রয় নিতেন। তাই অনেক মুক্তিযোদ্ধার চেয়েও বড় মুক্তিযোদ্ধা তাঁরা, অনেক কমান্ডারেরও বড়ো কমান্ডার ছিলেন তাঁরা।
মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে যখন ভারত থেকে সব মুক্তিযোদ্ধাকে বিভিন্ন গ্রæপে বিন্যস্ত করে দেশাভ্যন্তরে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছিলো, তখন টেকনাফ, চকরিয়া, বাঁশখালী, সাতকানিয়া, চন্দনাইশ এবং আনোয়ারার মুজিব বাহিনী (বিএলএফ) গ্রæপগুলি দ্বারক পেরপেরায় মনীর ভাইয়ের শেল্টারে এসে দু’চারদিন স্থিতির পর স্ব স্ব গন্তব্যের উদ্দেশে রওনা হয়েছিলো। এফএফ গ্রæপও মনীর ভাইয়ের শেল্টারে যাত্রাবিরতি করেছে। সেটা অনেকটা ট্রানজিট ক্যাম্পের মত হয়েছিলো। দু’একটি গ্রæপ জিরির মধুবাবুর শেল্টারে যাত্রাবিরতি করে।
পশ্চিম পটিয়া আসলে মুক্তিযুদ্ধের মুক্তাঞ্চল ছিলো। এই মুক্তাঞ্চলের মধ্যে আহমদ শরীফ মনীর এবং ডাক্তার শামসুল আলম দু’টি বেইজ সৃষ্টি করে মুক্তিযোদ্ধাদের নির্ভরতার প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন। পাঁচরিয়া দিঘির পাড় ও মনসার টেক থেকে পশ্চিমে চরলক্ষ্যা, শিকলবাহা, বড়উঠান, দৌলতপুর, শাহমীরপুর, চাপড়া, বাণীগ্রাম, নলান্ধা, লাখেরা, কোলাগাঁও, মোহাম্মদ নগর, থানা মহিরা, দক্ষিণ-পশ্চিমে জিরি, ভেল্লাপাড়া, মালিয়ারা, কৈয়গ্রাম এবং দক্ষিণ দিকে কর্ত্তালা-বেলখাইন, বুধপুরা, সাঁইদাইর, আশিয়া, পিঙ্গলা, দ্বারক, কাশিয়াইশ পর্যন্ত এই বিস্তীর্ণ এলাকা যেন মুক্তিযুদ্ধের জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়েছিলো। সেখানে মুক্তিযোদ্ধারা দিনরাত প্রকাশ্যে চলাফেরা করতেন, হাটে-মাটে-ঘাটে নির্ভয়ে মানুষ মুক্তিযুদ্ধের আলোচনায় মেতে থাকত। প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে ঘোরাফেরা করতেও কেনো বাধানিষেধ ছিলো না। লাখেরা অয়ারলেস স্টেশনে তো দিনের বেলাতেই অপারেশন করেন মুক্তিযোদ্ধারা। জিরি মাদ্রাসা অপারেশন যখন হয়, তখনো দিবাবসান হয়নি, গ্রামে গৃহস্থ বাড়িতে সাঁঝবাতি কোথাও জ্বলেছে কোথাও জ্বলেনি, মৌলভী সাহেব মাত্র আজান দেয়ার জন্য মিম্বরে উঠে দাঁড়িয়েছেন, এমন সময়েই মুক্তিযোদ্ধারা যমদূতের ন্যায় উদয় হন মাদ্রাসার গেট পেরিয়ে। সেদিন কাজীর হাট ছিলো, মুক্তিযোদ্ধারা হাটুরের ছদ্মবেশে মাথায় তরকারির ঝাঁকায় করে লুকিয়ে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যান। মুক্তিযোদ্ধা রুহুল আমিন, যিনি এখন রাঙামাটি থাকেন, তাঁর বাড়ি ছিলো পূর্বদিকে মাদ্রাসার অনতিদূরে; কিছু অস্ত্র আগেই তাঁর বাড়িতে নিয়ে রাখা হয়েছিলো।
দু’টি উদাহরণ দিলাম এটা বুঝানোর জন্য যে, পশ্চিম পটিয়া সত্যিই মুক্তিযোদ্ধাদের অভয়ারণ্য ছিলো। বিনিনেহারা ও দ্বারক পেরপেরায় দুটি বৃহৎ শেল্টার গড়ে উঠেছিলো। বিনিনেহারা ডা. শামসুল আলম ও তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র মাস্টার রফিকুল আলম চৌধুরীর বাড়ি এবং দ্বারক পেরপেরায় বিখ্যাত সমাজসেবক ব্রজেন্দ্রলাল বর্ধনের বাড়ি। এই বর্ধন বাবুর বাড়িটকে শেল্টার হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন পার্শ্ববর্তী সাঁইদাইর গ্রাম নিবাসী জনাব আহমদ শরীফ মনীর। তিনি পশ্চিম পটিয়া অঞ্চলের আওয়ামী লীগের একজন বিশিষ্ট ও প্রভাবশালী নেতা। তিনি ১৯৭০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে এমএ পাস করে গ্রামের বাড়িতে এসেছিলেন। পরীক্ষা দিয়ে উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের পর তিনি চলে এসেছিলেন। এর মধ্যে সত্তরে নির্বাচনের তোড়জোর শুরু হলে জনাব মনীর পটিয়া থেকে প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য পদপ্রার্থী জনাব সুলতান আহমদ কুসুমপুরীর নির্বাচনী কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়েন। অবশ্য তাঁকে পটিয়া থেকে জাতীয় পরিষদ সদস্য পদপ্রার্থী অধ্যাপক নুরুল ইসলাম চৌধুরীর নির্বাচন পরিচালনার জন্যও ৪টি ইউনিয়নের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিলো। কুসুমপুরী সাহেবের সমগ্র নির্বাচন পরিচালনা যারা করেন, তাদের মধ্যে আহমদ শরীফ মনীর ও মাস্টার রফিকের ভূমিকা ছিলো অগ্রগণ্য। বিভিন্ন নির্বাচনী জনসভায় উভয়ে বক্তৃতা করতেন। মনীর সাহেব ঠান্ডা মেজাজে যুক্তিপূর্ণ বক্তৃতা করতনে, আর রফিক সাহেব গরম বক্তৃতা করতেন। রফিক সাহেব সুবক্তা ছিলেন। দীর্ঘক্ষণ বক্তৃতা করতে পারতেন। নির্বাচনে পূর্বে ফকিরা মসজিদে একটি জনসভায় তিনি ২ ঘণ্টা ধরে অনর্গল বক্তৃতা করে যান। ঐ জনসভায় ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীর পিতা কফিলুদ্দিন চৌধুরী এবং এমএ আজিজ এসেছিলেন। ডা. শামসুল আলম আর রফিক সাহেবের বাড়ির সম্মুখস্থ পুকুরের পশ্চিম পাড়ে দোভাষীর বাড়ি নিয়ে সেখানেও একটি বিরাট শেল্টার সৃষ্টি হয়েছিলো। বাড়ির সবাই-রফিক সাহেবের পিতা ওদুদ সাহেব, বড় ভাই ফেরদৌস সাহেব, মেজ ভাই দিদার সাহেব; দোভাষীর বাড়ির ফরিদ ভাই, তৈয়ব ভাই, তাহের ভাই, বর্তমানে আমেরিকা প্রবাসী বকর ভাই ও কাসেম ভাইÑএরা সবাই কুসুমপুরীর নির্বাচনের সক্রিয় কর্মী। তাঁদের বাড়ির অতি নিকটবর্তী ফকিরা মসজিদ তখন পশ্চিম পটিয়ার রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু। আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের আনাগোনায় ফকিরা মসজিদে যেন মেলা বসে যেত। বিনিনেহারা নিবাসী আমার প্রিয় বন্ধু ইউসুফ এস্কারীও রফিক সাহেবদের সঙ্গে মিশে থাকতেন প্রায় সর্বক্ষণ। কুসুমপুরীর গ্রাম গোরণখাইনের তাঁর পুত্র ইউসুফ, ইদ্রিস, এয়াকুব, তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র এনামুল হক শিকদার, আবুল বশর, একরামুল হক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নেতা রায়হান ফিরদাউস মধু, বর্তমানে কানাডা প্রবাসী হাসান আবুল কাশেম, আমার ঘনিষ্ঠ দোসর জুলফিকার, নুরুল আলম, জিরির ইমাম শরীফদা (মনীর ভাইয়ের বড় ভাই), আহমদ নবী সওদাগর, সবুর ভাই, বশর ভাই, ফজল ভাই, ফরিদ ভাই, ইসহাক, ফরিদ, আনোয়ার, আবু তাহের বাঙালি, ফজলুল হক, এমদাদুল হক, ইউসুফ এবং এমনি আরো অসংখ্য রাজনৈতিক কর্মী, সমর্থকের ভিড়ে ফকিরা মসজিদ গমগম করতো। ছালেহ আহমদ খলিফার দোকানে বসতো ডা. মুসলিম, ওদুদ সাহেব, সবুর ভাইসহ বয়স্কদের আড্ডা আর জনকল্যাণ সংঘের মাঠে তরুণ-যুবাদের মেলা। আহমদ শরীফ মনীর তখন পশ্চিম পটিয়ার রাজনীতির সেন্ট্রাল ফিগার। তাঁকে মানুষ ‘শেখ সাহেব’ সম্বোধন করতে আমি শুনেছি। এইভাবে গড়িয়ে গড়িয়ে রাজনীতি স্বাধীনতা যুদ্ধে পৌঁছে যায়। তারপর ক্র্যাকডাইনÑপঁচিশে মার্চের গণহত্যা এবং বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার সঙ্গে জাতি মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
ডা. শামসুল আলমের বাড়ি নির্বাচনের সময় থেকে উৎসবমুখর ছিলো। তাঁরা চাচা-ভাতিজা দু’জনেই বিপুল উৎসাহে নির্বাচনোত্তর সমস্ত কর্মকাÐ এবং অসহযোগে পর্যন্ত মেতে থাকেন। ডা. সাহেব ছিলেন মানবতাবাদী জনদরদী চিকিৎসক। তাঁর পিতা হাজি আলী আকবর সওদাগর তাঁকে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি করানোর সময় বলেছিলেন, তোমাকে ডাক্তারি পড়াচ্ছি জনগণের সেবা করার জন্য, পয়সা কামানোর জন্য নয়। তোমাকে আমার কাছে ওয়াদা করতে হবে, তুমি ডাক্তারি পাস করে শহরে থাকতে পারবে না, গ্রামে থাকবে। মানুষের সেবা করতে হবে তোমাকে। টাকা পয়সার লোভ করতে পারবে না। ডাক্তার শামসুল আলম পিতৃ আজ্ঞা মেনে ডাক্তারি পাস করে সেই যে গ্রামে এসে চিকিৎসা আরম্ভ করলেন আর শহরমুখো হন নি। রোগীরা যে যা দিতো তাই নিয়ে তিনি তাদের চিকিৎসা করতেন। কোন রোগী টাকা দিতে না পারলে তাকে বিনা পয়সায় চিকিৎসা করেছেন। টাকা-পয়সার জন্য চাপাচাপি করেন নি। এমনই মহৎ মানবদরদী চিকিৎসক ছিলেন তিনি।
ডা. শামসুল আলম ১৯৪১ সালের ১ জানুয়ারি বিনিনেহারা পৈতৃক বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। পড়াশোনায় তিনি অসামান্য কৃতিত্বের পরিচয় দেন। বড় ভাই ড. আবদুস সবুর চৌধুরীর অনুপ্রেরণা ও তত্ত¡াবধানে তাঁর শিক্ষাজীবন অতিবাহিত হয়। তিনি চরকানাই স্কুল থেকে কৃতিত্বের সাথে মাধ্যমিক পাস করেন। চট্টগ্রাম কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে চট্টগ্রাম মেডিকেলের প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী হিসেবে তিনি এমবিবিএস পাস করেন। কৃতি ছাত্র হিসেবে তিনি জাতীয় অধ্যাপক ডা. নুরুল ইসলামে ¯েœহস্পর্শ লাভ করার সৌভাগ্য অর্জন করেন। এমবিবিএস পাস করে কিছুদিন বরিশাল মেডিকেলে কাটিয়ে গ্রামে চলে আসেন।
মেডিক্যাল কলেজে পড়ার সময় তিনি ছাত্রলীগ করতেন। তখন থেকে তিনি রাজনীতির খোঁজখবর রাখতেন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যে বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাজনীতি গড়ে উঠছিলো, তার সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে নিয়েছিলেন। তারপর গ্রামে এসে ৬ দফা আন্দোলনের সময় থেকে আবার রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে যান।
মাস্টার রফিক কমার্স কলেজে ছাত্রলীগ করতেন। ৬৮-৬৯ থেকে তিনি ঘনিষ্ঠভাবে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েন।
৬৮ সালে বি.কম পাস করে গ্রামে এসে কিছুদিন চরকানাই হাইস্কুলে শিক্ষকতার পর আওয়ামী লীগে ঢুকে সক্রিয় রাজনীতিতে অবতীর্ণ হয়েছিলেন মাস্টার রফিক। সুলতান আহমদ কুসুমপুরী স্বয়ং সভাপতি হয়ে মাস্টার রফিক সাধারণ সম্পাদক করে কুসুমপুরা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ কমিটি গঠন করেছিলেন।
২৬ মার্চ যুদ্ধ শুরু হবার পরও কালারপোল, ফকিরা মসজিদ, বুধপুরা হাটে মানুষে মানুষে সয়লাব ছিলো। ততদিনে ফকিরা মসজিদ, বিনিনেহারা প্রাইমারি স্কুল এবং বুধপুরায় কাঠের ডামি রাইফেল দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ শুরু হয়ে গিয়েছিলো। ফকিরা মসজিদে প্রশিক্ষণ দিতেন গোরণখাইনের আনসার কমান্ডার মুন্সি মিয়া এবং বুধপুরায় প্রশিক্ষণ দিতেন বুধপুরার হাবিলদার সুলতান এবং সাঁইদাইরের হাবিলদার লতিফ ও তাঁর ভাইÑ যিনি সুবেদার ছিলেন, তাঁর নাম আমি জানতে পারিনি।
তো মে মাসের কোনো এক রাতে গুলিবিদ্ধ ক্যাপ্টেন করিমকে নিয়ে বিনিনেহারা ডা. শামসুল আলমের বাড়িতে হাজির হয়েছিলেন আমার চাচা কমান্ডার আহমদ নবী। বেঙ্গুরায় ক্যাপ্টেন করিম গুলি খাওয়ার পর সেখানে থেকে তাঁকে কাঁধে করে সুঠাম দেহের অধিকারী নবী সাহেব প্রথমে হুলাইন নিয়ে যান এবং পরে সেখান থেকে বিনিনেহারা নিয়ে গিয়েছিলেন। ক্যাপ্টেন করিমকে চিকিৎসা করে সারিয়ে তোলেন ডা. শামসু। ক্যাপ্টেন করিম পটিয়া আসার পর পটিয়ায় মুক্তিযুদ্ধের নানামুখী কর্মকাÐে তীব্র গতিবেগ সঞ্চারিত হয়। তিনি নিজে যেমন প্রচÐ সাহসী, দক্ষ সংগঠক এবং সমরবিদ ছিলেন, তেমনি বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ইপিআর এর অবসরপ্রাপ্ত ও পালিয়ে থাকা জেসিও এনসিও এবং জওয়ানদের একত্রিত করে এক বিশাল দুঃসাহসী, অজেয় বাহিনী গঠন করেছিলেন। ক্যাপ্টেন করিম আসলে বিমান বাহিনীর সার্জেন্ট ছিলেন, কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা তাঁকে ক্যাপ্টেন ডাকা শুরু করলে তিনি ক্যাপ্টেন করিম নামে পরিচিত হয়ে ওঠেন।
সাখেরা অয়ারলেস স্টেশন, জিরি মাদ্রাসা অপারেশন ইত্যাদি ডা. শামসুর বাড়ি থেকেই সমন্বয় ও পরিচালনা করা হয়েছে। রফিক সাহেব কমার্স কলেজে পড়াশোনা, চরকানাই স্কুলে শিক্ষকতা এবং কুসুমুপুরী সাহেবের নির্বাচনী কাজকর্ম করে ব্যাপকভাবে পরিচিতি হয়ে উঠেছিলেন। তিনি বহু মানুষকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন। এই পরিচিতি কাজে লাগিয়ে তিনি যাচাই বাছাই করে মুক্তিযোদ্ধা রিত্রæুট করতেন এবং তাদেরকে ক্যাপ্টেন করিমের কাছে সোর্পদ করতেন। তিনি শাহজাহান ইসলামাবাদীর গ্রæপের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য বরকলেও যেতেন।
ডা. শামসু আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা, ক্যাপ্টেন করিমের যোগাযোগ সমন্বয় এবং শেল্টার তত্ত¡াবধান করতেন। পরিবারে সবাইকে দোতলা বাড়ির নিচতলায় রেখে তিনি দোতলায় করিম সাহেবের সঙ্গে অবস্থান করতেন। মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে তিনি ভারতেও গিয়েছিলেন।
ক্যাপ্টেন করিম ডা. শামসুর বাড়ি থেকে পরে দ্বারক পেরপেরায় মনীর ভাইয়ের শেল্টারে চলে যান। সেখানে বেশ কিছুদিন ছিলেন এবং সেখানে অবস্থান করে বিভিন্ন জায়গায় কিছু অপারেশন করেন। বর্ধন বাবুর পরিবারের সবাই মুক্তিযুদ্ধের সক্রিয় কর্মী হয়ে ওঠেন। তাঁর পুত্র দুলালদা, বুলুভাই, আমার বন্ধু চুলু, কালু সকলকেই নানা কাজ দিতেন মনীর ভাই। বাড়ির পার্শ্ববর্তী স্কুলে একটি ট্রেনিং সেন্টারও স্থাপন করেন মনীর ভাই। বিভিন্ন স্থান থেকে মুক্তিযোদ্ধারা আসতেনÑ তাদেরকে আনা নেয়া, তাদের অস্ত্র শস্ত্র বহন করা, মুক্তিযোদ্ধাদের থাকা-খাওয়ার তত্ত¡াবধানে লেগে থাকতেন বর্ধন বাবুর ছেলেরা, এমনকি মেয়ে ও বউঝিরাও। দুলালদাকে মুক্তিযোদ্ধাই বলা যায়, তিনি ট্রেনিংও নেন, অপারেশনেও যান।
বৌদ্ধপল্লী পিঙ্গলায় তেমিয় বাবু, শচীন বাবু, দুলাল বাবু, মিলন বাবুদের বাড়িও শেল্টার হিসেবে ব্যবহার করতেন মনীর ভাই। পটিয়া, বোয়ালখালী, রাউজানের যেসব মুক্তিযোদ্ধা করিম সাহেবের সঙ্গে কাজ করতেন, তাঁরা মনীর ভাই থেকে আদেশ-নির্দেশ গ্রহণ করতেন। মনীর ভাই নিজেও কোন কোন অপারেশনে অংশগ্রহণ করেছেন। তাঁকে দক্ষিণ চট্টগ্রামের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সমন্বয়কারী বলা যায়।
স্বাধীনতার পর তাঁর বন্ধু নুরুদ্দিন জাহেদ মঞ্জু চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনায় যোগ দিলে মনীর ভাইও একদিন তাঁর সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় গিয়ে আর আই চৌধুরী সঙ্গে দেখা করেন এবং আর আই চৌধুরী তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় যোগদান করতে বলেছিলেন। কিন্তু চট্টগ্রামে নতুন দল জাসদের সাংগঠনিক কাঠামো সৃষ্টি ও রাজনীতি বিকশিত করায় দায়িত্ব গ্রহণ করায় তাঁর পক্ষে আর বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করা সম্ভব হয়নি। আরো পরে তিনি জিরিতে নবপ্রতিষ্ঠিত খলিল-মীর কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব নিয়ে কলেজটিকে দাঁড় করান।
মাস্টার রফিক স্বাধীনতার পর চিনি ও খাদ্য শিল্প সংস্করে চাকরিতে যোগদান করে জেনারেল ম্যানেজার হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন।
মনীর ভাই তাঁর বড় ভাই ইমাম শরীফদার এনায়েত বাজার বাটালি রোডস্থ সাগর হোটেলে ও বাসা উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন জাসদের রাজনীতি চর্চার জন্য। জাসদ ও জাসদের অঙ্গ দল সমূহের লিয়াজোঁ অফিস হয়ে উঠেছিলো সাগর হোটেল। টেকনাফ থেকে শুভপুর এবং খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবান থেকে জাসদে যোগদানেচ্ছু মুক্তিযোদ্ধা, ছাত্রলীগ-নেতাকর্মী এবং কোন কোন ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ কর্মীরা দিন নেই রাত নেই অবিরাম ¯্রােতের মত আসতেন সে হোটেলে। ঢাকা থেকে কেন্দ্রীয় নেতা কাজী আরেফ আহমদ, মার্শাল মণি, আ.স.ম. আবদুর রব, শাহজাহান সিরাজ, আ ফ ম মাহবুবুল হক, নূরে আলম জিকু, মির্জা সুলতান রাজা, হাসানুল হক ইনু, শরীফ নুরুল আম্বিয়া, মমতাজ বেগম, আবদুল্লাহ সরকার, আবদুল মালেক শাহীদুল্লাহ, মুবিনুল হায়দার চৌধুরী, খালেকুজ্জামান, খাগড়াছড়ি থেকে হুকা হাতে উপেন্দ্রলাল চাকমা-কে না পদধূলি দিয়েছেন সাগর হোটেলে। জাসদ করতে গিয়ে মনীর ভাই একাধিকবার কারাবরণ এবং আশির দশকে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হন। নিউ মার্কেটে এলাকায় মিছিল করার সময় পুলিশের গুলিতে তিনি আহত হন। চট্টগ্রামের রাজনীতিতে নেতৃত্বের বিপুল সম্ভাবনা জাগিয়ে বর্তমানে তিনি শহরে একটি ছোট বাসায় অবসর জীবন যাপন করছেন। তাঁর সহধর্মিণী অধ্যাপক দিলদার বেগম কলেজ শিক্ষক; তিনি হাটহাজারী কলেজ থেকে অধ্যক্ষ হিসেবে অবসর গ্রহণ করেছেন।

লেকক : সিনিয়র সাংবাদিক, মুক্তিযুদ্ধা