মুক্তিযুদ্ধে দক্ষিণ চট্টগ্রাম কমান্ডার সার্জেন্ট মহি আলম চৌধুরী ও চট্টগ্রামের মুক্তিযুদ্ধ

261

জামাল উদ্দিন

দক্ষিণ চট্টগ্রামের কমান্ডার ফ্লাইট সার্জেন্ট মহি আলম চৌধুরী। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধের প্রথম পর্যায়ে তিনি চট্টগ্রামে ছিলেন এবং এখানে থেকেই যোদ্ধাদের সংগঠিত করে যুদ্ধে অংশ নেন। প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে তিনি ভারত চলে যান। ভারত থেকে ১নং সেক্টরের অধীনে দক্ষিণ চট্টগ্রামের দায়িত্ব নিয়ে চট্টগ্রামে ফিরে আসেন। জুন মাস থেকে সার্জেন্ট মহি আলম চৌধুরী গ্রæপ ব্যাপক গেরিলা তৎপরতার মাধ্যমে পটিয়া, বোয়ালখালী, চন্দনাইশ, আনোয়ারা, বাঁশখালী তথা দক্ষিণ চট্টগ্রামে হানাদার বাহিনীকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখে। শুধু দক্ষিণ চট্টগ্রাম নয়, আনোয়ারার সাগর উপকুলীয় এলাকাটি ছিল আনোয়ারা থানা রাজাকার কমান্ডার জালাল চৌধুরী প্রকাশ জৌল্লার নিয়ন্ত্রিত। পারকি থেকে দক্ষিণে গহিরা পর্যন্ত কয়েক শত রাজাকার, আলবদর এ এলাকায় কয়েকটি ক্যাম্প করে অবস্থান করতো। এসব রাজাকারদের কারণে চট্টগ্রাম বন্দর তথা বঙ্গোপসাগরে নৌ-কমান্ডোরা অপারেশন কার্যক্রম পরিচালনা করতে বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়ো। সম্পূর্ণ এলাকা থেকে রাজাকার, আলবদর মুক্ত করতে সার্জেন্ট মহি আলম চৌধুরী একের পর এক অপারেশন পরিচালনা করেন। ফলে চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরে নৌ-কমান্ডোদের পরিচালিত অপারেশন ‘জেকপট’ পরিচালনার পথ সুগম হয়। এই অপারেশনে বেশ কয়েকটি দেশি-বিদেশি জাহাজ ধ্বংস হয়ে সাগর ও নদীতে তলিয়ে যায়। অপারেশনের খবর দ্রæত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। পৃথিবীর মানুষ তখনই জানতে পারে যে বাঙালিরা স্বাধীনতা যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। সার্জেন্ট মহি আলমের ভূমিকা যেমন অনালোচিত রয়ে গেছে, তেমনি তিনি হয়ে আছেন উপেক্ষিত। এই নায়ক গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ঘুরে ছুটিতে আসা বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিক, ইপিআর ও আনসার সদস্য, প্রাক্তন সৈনিক, ছাত্র, তরুণদের সংগঠিত করে গড়ে তুললেন এক বিরাট মুক্তিসেনা দল। একের পর এক গেরিলা অপারেশন চালিয়ে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীকে এমনভাবে ব্যতিব্যস্ত করে তুললেন যে, পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে তখন সার্জেন্ট মহি আলম হয়ে উঠেছিলেন যমদূত।
সার্জেন্ট মহি আলমের দুর্ভেদ্য দুর্গগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল ১. চন্দনাইশ উপজেলার বরকল, বরমা, কানাইমাদারি ও কেশুয়া এলাকা নিয়ে, ২. আনোয়ারা উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধাদের দুর্গ নামে খ্যাত বারখাইন, তৈলারদ্বীপ ঘাঁটি এলাকা যা ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি। এইসব ঘাঁটি ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে পটিয়া, চন্দনাইশ, আনোয়ারা, বাঁশখালী তথা দক্ষিণ চট্টগ্রামের মুক্তিযুদ্ধ।
সার্জেন্ট মহি আলম চৌধুরীর গুরুত্বপূর্ণ অপারেশন : ২৩ সেপ্টেম্বর আনোয়ারা থানার প্রথম অপারেশন পরিচালিত হয়। অপারেশনের প্রধান কমান্ডার ছিলেন সার্জেন্ট মহি আলম চৌধুরী। যোদ্ধারা তিনভাগে বিভক্ত হয়, প্রথম গ্রæপের দায়িত্বে থাকেন প্রধান কমান্ডার সার্জেন্ট মহি আলম, তাঁর সাথে ছিলেন পটিয়ার আবদুস সবুর ও আনোয়ারার মোহাম্মদ নাসিম, দ্বিতীয় গ্রæপের দায়িত্বে থাকেন পটিয়ার (বর্তমান চন্দনাইশ) সুবেদার আবু ইসলাম, তৃতীয় গ্রæপের দায়িত্ব নেন পটিয়ার আইয়ুব ও এমএ মজিদ। কমান্ডার সার্জেন্ট মহি আলম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন পটিয়া, বোয়ালখালী থানার এফ এফ গ্রæপ ও আনোয়ারা থানার কমান্ডার কাজী মোহাম্মদ ইদ্রিছ পরিচালিত এফ এফ ৩৬ গ্রæপ ও কমান্ডার আবদুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে এফ এফ ৩৫ গ্রæপ। আনোয়ারা থানার উল্লেখিত দুটি গ্রæপের সদস্যরা হলেন; কাজী মোহাম্মদ ইদ্রিছ-হাজীগাঁও, নুরুল ইসলাম আবু-বারখাইন, আবদু রাজ্জাক-বরুমচড়া, নুরুল আমীন-বারখাইন, মো. আবুল কাসেম-বরুমচড়া, মোহাম্মদ নাছিম-বটতলী, নুরুল আলম-বটতলী, মোহাম্মদ সফি-বরুমচড়া, সৈয়দ নুর-বটতলী, তরুণীসেন মিত্র-বোয়াল গাঁও, মোহাম্মদ হোসেন বাবু-পীরখাইন, সিরাজুল ইসলাম খান-শোলকাটা, সমরপাল-খাসখামা, আবদুছ ছালাম-জুঁইদÐী। স্থানীয়দের মধ্যে ছিলেন ফেরদৌস আহমদ (সেনাবাহিনি)-তেকোটা, আবদুল আলীম (সেনাবাহিনি)-মামুর খাইন, আবু ছায়াত (আনসার)-তেকোটা, মীর আহমদ-তেকোটা, মোঃ ইউসুফ-পীরখাইন, বদরুজ্জামান-তেকোটা, আবদুল মান্নান-তেকোটা, আবুল হাশেম মাস্টার-বারখাইন, লোকমান আহমদ শাহ-বারখাইন, মোহাম্মদ আলম-বারখাইন, আহমদ কবির চৌধুরী-বারখাইন, মোঃ শাহজাহান চৌধুরী-পীরখাইন, আবু মুসলীম খান। পটিয়া থানার এফ এফ গ্রæপের সদস্যরা হলেন সুবেদার আবু ইসলাম গ্রæপ, ও বোয়ালখালীর আবদুল মজিদ গ্রæপের সদস্যদের মধ্যে মাহফুজুর রহমান খান, মোজাহের, মঞ্জু, আবদুল হক, নুরুল হক, নাসির উদ্দিন, নুরুল হক, কবির আহমদ, আহামদ মিয়া, আহামদ হোসেন, এনু মিয়া, সাজি মিয়া, আবু তাহের, আবুল বশর, বদিউল আলম, আমিনুল হক, শফি, ইদ্রিছ, বাচন আলী, আবদুল মোনাফ, আবুল, আবদুল হামিদ, আবদুল আলীম, মীর আহামদ, মো. ইউনুছ, আবদুল মোতালেব, নুরুল আলম, বদরুজ্জামান, লোকমান, ফজল, শাহজাহান, হাবিব, ফেরদৌস, রঞ্জিত, বাবুল, দিলীপ, ইসহাক, মোঃ আলম, রফিক, সোলায়মান, আবদুর রশিদ ও চন্দন কুমার লালাসহ ১৩৩ জন মুক্তিযোদ্ধা অংশগ্রহণ করেন। এই অপারেশনে ছয়জন পাঞ্জাবি মিলিশিয়া, বিপুলসংখ্যক পুলিশ, রাজাকার, আলবদর ও আলশামস্ বাহিনীর শক্তিশালী কেন্দ্র ছিল এ থানা। এই অপারেশনে সম্মুখযুদ্ধে ৩ জন পুলিশ ও ১২ জন রাজাকার নিহত হয়। বন্দি করা হয় বিপুল সংখ্যক পুলিশ, রাজাকার। এ যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে আসে ৬টি স্টেনগান ও ৬৬টি রাইফেল।
পশ্চিম আনোয়ারায় রাজাকার ক্যাম্পে সাঁড়াশি অভিযান : ৯ নভেম্বর, সার্জেন্ট মহি আলম রাজাকার অধ্যুসিত সমগ্র পশ্চিম আনোয়ারার পাঁচটি রাজাকার ক্যাম্পে একসাথে অপারেশনের পরিকল্পনা করেন। অপরদিকে মেরিন একাডেমিতে ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর শক্তিশালী ক্যাম্প। গহিরা থেকে পারকী হয়ে পশ্চিম পটিয়ার জুলধা পর্যন্ত বঙ্গোপসাগর ও কর্ণফুলীর তীরবর্তী এলাকা শত্রæদের হাত থেকে মুক্ত রাখার জন্য এই অপারেশন পরিচালনা করা হয়। অপারেশনে প্রায় ৪৫ জন রাজাকারকে হত্যা করে তাদের ব্যবহৃত অস্ত্র কেড়ে নেয়। এছাড়া তাঁরই নেতৃত্বে আনোয়ারা উপজেলায় রাজাকার, আলবদরদের বিভিন্ন ক্যাম্প ও স্থাপনায় একের পর এক অপারেশন পরিচালনা করে শত্রæ বাহিনীকে পর্যদস্ত করা হয়। এছাড়াও সার্জেন্ট মহি আলম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধারা আরো প্রায় অর্ধশত অপারেশন পরিচালনা করেন মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ নয় মাসে।
১৭ নভেম্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাদের সহযোগি রাজাকার ও আলবদরদের সহযোগিতায় আনোয়ারার বিভিন্ন গ্রামে ব্যাপকভাবে ঘর-বাড়ি জ্বালাতে শুরু করে। এক পর্যায়ে শত্রæবাহিনী বারখাইন গ্রামের আবদুল মাবুদ চৌধুরীর বাড়িস্থ সার্জেন্ট মহি আলম চৌধুরূর ক্যাম্পে আক্রমণ করে ক্যম্পটি জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ধ্বংস করে দেয়। সার্জেন্ট মহি আলম চৌধুরী মুক্তিযোদ্ধা অজিত, বকর, কাসেম, রুস্তম, রাজ্জাক, আবু তাহের, কাজী ইদ্রিছ সহ আরও অনেককে সাথে নিয়ে শঙ্খ নদের পাড় ধরে চলে যান বাঁশখালী থানার চাঁদপুরের ‘কুÐ চা-বাগানে’। এখানে তাঁর সাথে যোগ দেন বাঁশখালীর মুক্তিযোদ্ধারা। কুÐ চা বাগানের অনতিদূরে রাজাকার ঘাঁটি। এই ঘাঁটিতে প্রায় চার শতাধিক রাজাকার থাকতো। তারা প্রতিনিয়ত এলাকায় লুটপাট, নির্যাতন চালাতো। কিন্তু স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা তাদের বিরুদ্ধে কোন অভিযান পরিচালনায় সাহসিকতার দৃষ্টান্ত রাখতে পারেনি। এই ব্যর্থতার জন্যে সার্জেন্ট আলম বাঁশখালীর মুক্তিযোদ্ধাদের চরমভাবে ভর্ৎসনা করেন। মুহূর্তেই তিনি সাথী যোদ্ধাদেরকে রাজাকার ঘাঁটি অপারেশনের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেন। পরিকল্পনানুযায়ি যোদ্ধাদের একটি দল চাঁদপুর ঘাটের দিকে এগুতে থাকলে বিচক্ষণ কমান্ডার মহি আলম চৌধুরী গতিপথ পরিবর্তন করার নির্দেশ দেন। চাঁদপুরঘাটে সরাসরি না গিয়ে ফকিরের চরসংলগ্ন শঙ্খ নদ পাড়ি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। উল্লেখ্য যে, এই সময় মুক্তিযোদ্ধা তাহের উদ্দিনের অস্ত্র হতে একটি গুলি অতর্কিতে ফায়ার হয়ে যায়। এ কারণে সার্জেন্ট মহি আলম চৌধুরী মুক্তিযোদ্ধা তাহের উদ্দিনের উপর চরম উত্তেজিত হয়ে তাকে মেরে ফেলার হুমকি দেন। কারণ গুলির শব্দে শত্রপক্ষ সতর্ক হয়ে গেলে পরিস্থিতি হয়ে যাবে ভযাবহ। অপারেশন স্থগিত করে তিনি পুনরায় দলবল নিয়ে রাত ১০টার দিকে কুÐ রেস্ট হাউসে ফিরে যান। সবাই ক্লান্ত, ক্যাম্পে কর্তব্যরত পাহারাদার ছাড়া সকলেই ঘুমিয়ে পড়েন। শুধু ঘুমোননি সার্জেন্ট মহি আলম চৌধুরী। গভীর রাতে তিনি সকলকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলেন এবং নির্দেশ দিলেন নিজ নিজ অস্ত্রশস্ত্র সাথে নিয়ে শীতের কাপড়-চোপড় পরিধান করতে। সবাই প্রস্তুত। কোথায় যাবে তিনি ছাড়া কেউ জানেন না। তাঁর এক দেহরক্ষী মোহাম্মদ নাসিম তখন অস্ত্রের খোঁজে পটিয়ায় অবস্থান করছেন, অপর দেহরক্ষী বটতলীর নুরুল আলম আছেন সাথে। তাঁকেও এবার সাথে নিচ্ছেন না। বললেন, তুমি ক্যাম্প পাহারায় থেকো। সেদিন সাথে ছিলেন না তাঁর সার্বক্ষণিক সাথী অপারেশন কমান্ডার রশিদ আহমদও, মাত্র তিন দিন আগে বিয়ের পিঁড়িতে বসে তিনি ছিলেন বাড়িতে। সকলকে দাঁড় করিয়ে চা-বাগান ত্যাগ করার পূর্ব মুহূর্তে যোদ্ধাদের উদ্দেশে সংক্ষিপ্ত বক্তেব্যে তিনি বলেন, মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য আমি প্রাণ দিতে প্রস্তুত এবং আমি জানি যে কোন মুহূর্তে আমার মৃত্যু হতে পারে। কিন্তু শত্রæর হাতে নয়, আমাকে শত্রæরা আঘাত করতে পারবে না। আমার মৃত্যু হবে, আমার আপনজনদের হাতে। সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে এমনই সন্দেহের কথাও বলে ফেললেন দক্ষিণ চট্টগ্রাম কমান্ডার সার্জেন্ট মহি আলম চৌধুরী। বক্তব্যের সর্বশেষে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণ করিয়ে দেন, দেশটি এমনভাবে হানাদার মুক্ত করতে হবে যাতে স্বাধীন দেশে প্রত্যেকে ঘরের দরজা খোলা রেখে ঘুমোতে পারে। তিনি আরো বলেন, আমি বেঁচে নাও থাকতে পারি, তোমরা মুক্তিযোদ্ধারা দেশ হানাদার মুক্ত করেই ঘরে ফিরবে, এই আমার অনুরোধ। এরপর তিনি কুÐ চা বাগান ত্যাগ করেন, তখন মধ্যরাত, সকলকে সাথে নিয়ে তিনি ছুটলেন আক্রমণস্থলের উদ্দেশে। অনেকক্ষণ পায়ে হাঁটার পর ভোর রাতের দিকে চাঁদপুর রাজাকার ক্যাম্পের কাছাকাছি পৌঁছে যান। তখনই যোদ্ধারা বুঝতে পারলেন তাদের টার্গেট হবে এই ক্যাম্প। বাঁশখালী থানার চাঁদপুরের গুনাগরিস্থ সাহেবের হাটের রাজাকার ক্যাম্প। আক্রমণ স্থলটি এমনই নিচু রাস্তা, কিছু উঁচুতে ওঠার পর একটি মাঠ, একপাশে টিনশেড পাকা দালান। ঐ দালানে হানাদারদের দোসর রাজাকারদের ক্যাম্প। এমন সময় বেছে নিলেন যখন ক্যাম্পে রাতের সেন্ট্রিরা ডিউটি পরিবর্তন করতে যাবে। ডিউটি পরিবর্তনের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে সার্জেন্ট মহি আলম চৌধুরী নিজেই নিচু রাস্তা পার হয়ে উপরের মাঠ অতিক্রম করে একবারে ক্যাম্পের দরজায় চলে যান। সার্জেন্ট আলম ক্যাম্পের দরজা নক করলে রাজাকাররা দরোজা খুলে দেয়। সামরিক পোশাক পরিহিত সার্জেন্ট মহি আলম আলম নিজেকে পাকিস্তানি বাহিনির অফিসার পরিচয়ে উর্দুতে রাজাকারদের বকাঝকা শুরু করেন। ইত্যবসরে তাঁর স্টেনগানের অতিরিক্ত ম্যাগজিন ও গ্রেনেড সাথে থাকা মুক্তিযোদ্ধা আবু বকরকে হাতের ইশারায় তাঁর পাশে ডেকে নেন। সাথে সাথেই তিনি স্টেনগান হতে ব্রাশফায়ার ও গ্রেনেড নিক্ষেপ শুরু করলে বেশ কয়জন রাজাকার হতাহত হয়। এরই মধ্যে অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধারাও ক্যাম্পের দু’পাশে অবস্থান নিয়ে গোলাগুলি শুরু করেন। সফল অপারেশন সমাপ্তির পথে এমনই সময় পেছন দিক থেকেই একটি গুলি এসে তাঁর পিঠে বিদ্ধ হয়। গুলি লাগার সাথে সাথে তিনি বলে উঠলেন, ‘আহা-আল্লাহ, আমাকে গুলি মারলো ক্যাডা’, তারপরও অবিচল এই যোদ্ধা রক্তাক্ত দেহ নিয়ে সকলকে পজিশন প্রত্যাহার করার সংকেত দেন। এই সময়ও তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশে সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে বলেন- ‘আমি তোমাদের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছি, তোমরা দেশ হানাদার মুক্ত করেই ঘরে ফিরবে।’ গুরুতর আহত আলম সাহেবকে মুক্তিযোদ্ধারা গায়ে থাকা শতরঞ্জি পেঁচিয়ে কাঁধে করে পাহাড়ের দিকে রওয়া হয়। নিকটেই ছিল পাহাড়ের ঝর্ণা, ওখানেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
এমনই মুহূর্তে ভীতসন্ত্রস্ত রাজাকারেরা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে ক্যাম্প ছেড়ে দিগি¦দিক পালাতে থাকে। সহযোদ্ধারা সার্জেন্ট মহি আলম চৌধুরী’র লাশ নিয়ে পাশে পাহাড়ের মধ্যে ঢুকে পড়ে এবং তাঁর লাশ কোনাই গাছের পাশে দাফনের ব্যবস্থা করে। তাঁকে লটমণি পাহড়ে দাফন করা হয় পাহাড়ের ঐ টিলাটির আজকের পরিচয় ‘আলম টিলা’। সেদিন তিনি কেনইবা দেহরক্ষী পরিত্যাগ করে অপারেশনে গেলেন এবং তাঁর পেছনে কোন রাজাকার না থাকা সত্তে¡ও কেন পেছন দিক থেকে সার্জেন্ট আলম গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারালেন? এই নিয়ে দেশ হানাদার মুক্ত হওয়ার অনেক বছর পরও স্বয়ং মুক্তিযোদ্ধারাই প্রশ্ন তোলেন সার্জেন্ট মহি আলম চৌধুরী কার গুলিতে যুদ্ধের মাঠে শহীদ হলেন? এই প্রশ্নের উত্তর মিলবে না, শুধু এটুকুই বলা যায়, হে স্বাধীনতার বীরযোদ্ধা, তুমি হাজার বছর ধরে শান্তিতে ঘুমাও কোনাই গাছের ছায়ায়, আর তোমার হত্যাকারিরা অপরাধের যন্ত্রণায় ক্ষত-বিক্ষত হোক জনম জনম ধরে।
সার্জেন্ট মহি আলম চৌধুরীর পরিচয় : সার্জেন্ট মহি আলম চৌধুরীর জন্ম বরিশাল জেলার মেহেদীগঞ্জ থানার উলানিয়া গ্রামের চৌধুরী পরিবারে। ১৯৪১ সালের ১ জানুয়ারি তিনি জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম আবদুল হক চৌধুরী এবং মাতার নাম ফররুখ মহল বেগম। নানার বাড়ি গৌরনদী মিয়া বাড়ি। ছয় ভাই তিন বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন মেজ। শৈশব থেকে সুঠাম দেহের অধিকারি মহি আলম চৌধুরী ছিলেন ডানপিটে আর দুর্দান্ত সাহসি। তাঁর বাবা আবদুল হক চৌধুরী জমিদার পরিবারের সন্তান হওয়া সত্তে¡ও জাকজমকপূর্ণ জীবন পছন্দ করতেন না, সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন। মহি আলম চৌধুরীর প্রথম শিক্ষা জীবন শুরু হয় উলানিয়া জুনিয়ার মাদ্রাসায়। এখান থেকে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করে ভর্তি হন উলানিয়া করোনেশন হাইস্কুলে। ১৯৫৬ সালে উক্ত বিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সাথে এসএসসি পাস করেন। অতঃপর উচ্চ শিক্ষার জন্য ভর্তি হন চট্টগ্রাম ইসলামিয়া কলেজে। থাকতেন চট্টগ্রামে মামার বাসায়। অতঃপর তিনি পাকিস্তান এয়ার ফোর্সে যোগদান করে কর্মজীবন শুরু করেন করাচিতে। ১৯৬৭ সালে করাচি থেকে এসে মামাতো বোন দেলোয়ারা বেগম (বেবী)-এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। বিয়ের পর আবার কর্মস্থল করাচিতে চলে যান। তখন তিনি উচ্চশিক্ষা লাভে করাচির এক কলেজে ভর্তি হন। সেখান হতে বিএ পাস করেন এবং এমএ ক্লাশে ভর্তি হন। ১৯৭১ সালে ছুটি নিয়ে বাড়িতে চলে আসেন। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ১৭ নভেম্বর ১৯৭১ রাতে মাত্র ৩০ বছর বয়সে চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে এক অপারেশনে শহীদ হন।

লেখক: মুক্তিযুদ্ধ গবেষক, লেখক ও প্রকাশক