মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ আর চেতনা আলাদা বিষয়

57

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন বলেছেন, আমরা হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনকের মাধ্যমে দেশ ও স্বাধীনতা পেয়েছি। তার মাধ্যমে চেতনা ধারণ করেছি। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নারকীয় হত্যার মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হত্যা করতে চেয়েছিল। দেশকে বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতিতে রূপ ফেলে দিয়েছিল একটি মহল। সুতরাং মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ আর চেতনা এক জিনিস নয়। দুটোই আলাদা বিষয়। যা তরুণ প্রজন্মদের কাছে তুলে ধরতে হবে।
তিনি গতকাল শুক্রবার বেলা ১১ টায় চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক মিলনায়তনে ‘বিজয়ের শেষ ৩ দিন কেমন ছিল চট্টগ্রাম’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনা উদ্বোধনকালে এসব কথা বলেন। বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস) চট্টগ্রাম অফিস এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। অনুষ্ঠান সঞ্চালনায় ছিলেন বাসসের চট্টগ্রাম ব্যুরো প্রধান কলিম সরওয়ার। আলোচনায় অংশ নেন মুক্তিযোদ্ধা ডা. মাহফুজুর রহমান, মোহাম্মদ হারিছ, এবিএম খালেকুজ্জামান দাদুল, আবু সাঈদ সর্দার, জাহাঙ্গীর চৌধুরী, প্রফেসর মোহাম্মদ মইন উদ্দিন, ফেরদৌস হাফিজ খান রুমু, নাসিরুদ্দিন চৌধুরী, রেজাউল করিম চৌধুরী, মোহাম্মদ শাহাবুদ্দিন, মোজাফফর আহমদ, মুক্তিযোদ্ধা ও চিত্র সাংবাদিক মনজুরুল আলম মঞ্জু।
মেয়র আরও বলেন, তরুণরা এ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আজকে দেশকে কিভাবে স্বাধীন করেছি তার বিষয়ে জানবেন। আমরা স্বাধীন সার্বভৌম দেশের নাগরিক। মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর পেছনে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনকের ভূমিকা বলিষ্ঠ। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মধ্যে গভীর ষড়যন্ত্র ছিল। যারা পাকিস্তানের পক্ষে ছিল তাদের ব্যর্থতার প্রতিশোধের জন্য এ হত্যাকান্ড ঘটিয়েছিল। শিশু রাসেলের বয়স ছিল ১০ বছর। তাকে বেয়নেট দিয়ে নিষ্ঠুর, অমানবিকভাবে হত্যা করা হয়েছিল। তার একমাত্র কারণ বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ সন্তান ছিল।
আলোচনা সভায় মুক্তিযোদ্ধারা মুক্তিযুদ্ধের নির্মম দৃশ্য, সঙ্গী হারানোর বেদনা, বাড়িঘরে পাকিস্তানি বাহিনীর গান পাউডার ছিটিয়ে আগুন দেওয়া, স্বজনদের নির্মম আত্মদানের বর্ণনা দেয়ার পাশাপাশি কান্নায় ভেঙে পড়েন।
মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ হারিছ বলেন, এ মহান মুক্তিযুদ্ধের নেতা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। চট্টগ্রামে ৩ ডিসেম্বর থেকে ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত যুদ্ধ হয়। বিহারিরা যে বাঙালিকে কলোনিতে ধরে নিয়ে গেছে সে ফিরে আসেনি। ট্রেন দাঁড় করিয়ে বাঙালিদের বেছে বেছে হত্যা করেছিল তারা। চট্টগ্রামের এসব ঘটনার প্রতিশোধ নেওয়ার স্পৃহা থাকলেও সুযোগ পাইনি।
মুক্তিযোদ্ধা-গবেষক ডা. মাহফুজুর রহমান বলেন, চট্টগ্রামে ফৌজদারহাট, পতেঙ্গা, আমিন জুট মিল এলাকায় একসঙ্গে একই সময়ে অপারেশন হয়েছিল। ৩ ডিসেম্বর বন্দরের অয়েল ডিপোতে বিমান আক্রমণ হয়। আমি ভেবেছিলাম পাক বাহিনীর বিমান! তখন যোগাযোগ ব্যবস্থা বলতে গেলে ছিলই না। আফসোস করতাম, হাতে যদি একটি রাইফেল থাকতো গুলি করে বিমান ফেলে দিতাম। তিনি আরও বলেন, মুক্তিযোদ্ধারা জানত যেকোনো সময় একটি বুলেট বিঁধতে পারে। মৃত্যুভয় তুচ্ছ করে যুদ্ধে গেছি আমরা। জনগণও ভীত ছিল না। তারা মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিত। খাবার দিত।
মুক্তিযোদ্ধা জাহাঙ্গীর চৌধুরী বলেন, ৭৩ বছর বয়সে এখনো কাজ করে যাচ্ছি। সিটি কলেজের ছাত্র ছিলাম। হাতি দেখে কেউ বলে মুলার মতো, কেউ বলে কুলার মতো। তেমনি মুক্তিযোদ্ধারাও অনেকে অনেককে চিনতেন না। অনেক অপারেশন সম্পর্কে জানতেন না। যাকে যেভাবে শিক্ষা দেয়া হয়েছিলো সেভাবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
মুক্তিযোদ্ধা আবু সাঈদ সর্দার বলেন, জাতীয়ভাবে ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস হলেও, চট্টগ্রাম মুক্ত হয় ১৭ ডিসেম্বর। ১৪-১৭ ডিসেম্বর আমি ছিলাম আগ্রাবাদ এলাকায় মৌলভী সৈয়দের বেইস ক্যাম্পে। তখন ওয়ারল্যাস ছিল না বলে খুব দূরের খবর পেতাম না। ১৪ ডিসেম্বর ৩০০ গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা একত্রিত হই মুহুরী পাড়ার বিলে। হঠাৎ একটি মাইক্রোবাস আসে। বাঙালি চালক ছিলেন। দুইজন বিহারিকে পাই। তাদের ধরে মাটির দোতলায় আমাদের গোয়েন্দা সেলে নিয়ে যাই। তাদের তথ্য মতে একটি বাড়ি থেকে চারজন হিন্দু মেয়েকে উদ্ধার করি। কিছু অস্ত্রও পাই।
তিনি বলেন, ১৭ বার আমার বাড়িতে সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী পাক সেনা নিয়ে হামলা চালিয়েছিল। জল্লাদ জাফরুল্লাহ ও খোকা বারবার এ বাড়িতে এসেছিল। জল্লাদ খোকা আমার মায়ের নাকে রিভলবার ঢুকিয়ে বলেছিল, তোর পোয়া হডে? (তোমার ছেলে কোথায়?) বলতে বলতে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন তিনি। অথচ আমার মা একজন ধার্মিক মহিলা ছিলেন। দেশের পরিস্থিতি নিয়ে তেমন ভাবতেন না করে সবসময় জিকিরে মগ্ন থাকতেন।
মুক্তিযোদ্ধা এবিএম খালেকুজ্জামান দাদুল বলেন, চট্টগ্রামে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয় লালদীঘি মাঠে। ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ নাটক মঞ্চস্থ হয়েছিল সেখানে। আমারও সুযোগ হয়েছিল অভিনয়ের। ১৪ ডিসেম্বর হাটহাজারী থেকে দেওয়ানবাজার চলে আসি। পুলিশ লাইন, কাজীর দেউড়িসহ আশেপাশের বাজার থেকে খাবার কেড়ে নিয়ে আসছিল পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসররা। আমরা খবর পেয়েছিলাম আবুল ফজলদের তালিকা করে মেরে ফেলা হবে। তখন কন্যা, যুবকদের গ্রামে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন মা-বাবারা। ত্রাসের রাজত্ব ছিল। সার্কিট হাউসের টর্চার সেলের চেয়ার দেখি। মূল্যবান ডকুমেন্ট পাই। যাতে লেখা ছিল কাদের মারতে হবে। আমি সেখানে সকাল ৯টা ২৬ মিনিটের দিকে স্বাধীন দেশের পতাকা অর্থাৎ আমার দেশের পতাকা ওড়াই। সাথে ছিল চট্টগ্রাম কলেজের এক ছাত্র শামীম। তিনি বলেন, রাজাকার, পাক আর্মিরা অনেক ছেলেকে বলাৎকার করেছিল। অসুস্থ অবস্থায় তাদের মেডিকেলে ফেলে যেত। এ কথাটা কেউ বলে না।
জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মোহাম্মদ শাহাবুদ্দিন বলেন, মুক্তিযুদ্ধের শেষ তিন দিন মিরসরাইয়ের দক্ষিণাঞ্চলে ক্যাম্পে অবস্থান করি। শুনছি প্রচুর মিলিটারি শহর অভিমুখে যাচ্ছে। মানুষের মধ্যে আতঙ্ক, উদ্বেগ ও ভয় দুটোই ছিল। কারণ রাজাকার, মুক্তিযোদ্ধা, সিভিল মানুষ সবার হাতে অস্ত্র ছিল না। রাতে কিছু বাড়ি লুট হয়। রাজাকার আতাউস সোবহানের জল্লাদখানায় করুণ অবস্থা দেখেছি। চারদিকে মানুষের মাথার খুলি, রক্তের দাগ।
মুক্তিযোদ্ধা রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, মুক্তিযুদ্ধ বিরাট উপাখ্যান। চট্টগ্রাম শহরে ছিলেন গেরিলা যোদ্ধারা। এর জন্য বেইস গড়ে তুলতে হয়। চট্টগ্রাম শহরে ১৪ ডিসেম্বর থেকে আতঙ্ক ছিল। আবার ভেতরে ভেতরে উল্লাসও ছিল। বোমারু বিমানে করে মুক্তিযোদ্ধারা বোমা বর্ষণ করেছিল। ছোট ছোট বাচ্চারা ভবনের ছাদে উঠে হাততালি দিত। জনগণের সাহস বেড়েছিল। জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। তাদের ধারণা বদ্ধমূল হয়েছিল বিজয় সন্নিকটে। আশঙ্কার কারণ রাজাকার আল বদররা সুশীল সমাজের তালিকা করেছিল মেরে ফেলার জন্য। ১৫ ডিসেম্বর শুনতে পাই কুমিরা যুদ্ধে পাকিস্তান বাহিনী পিছু হটেছে। কুমিরা ফৌজদারহাটে প্রাণপণ যুদ্ধ হয়। তাদের আশঙ্কা ছিল পাক বাহিনী শহরে ঢুকে পড়লে পরাজিত করা কঠিন হবে।
স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, চান্দগাঁওয়ের ইউনুচ রাজাকার রাইফেল নিয়ে ঘুরত আর বলতো- হট যাও হট যাও। একদিন একজন মুক্তিযোদ্ধা মিস ফায়ার দিলে ইউনূস রাজাকার রাইফেল ফেলে পালান।
নগর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মোজাফফর আহমদ বলেন, মুক্তিযুদ্ধের কথা বললে আমার মায়ের কথা বলতে হয়। তার চার সন্তানকে যুদ্ধে পাঠিয়েছিলেন। অথচ আমার মা লেখাপড়া জানতেন না। আফসোস মীর কাশিম আলীকে অল্পের জন্য ধরতে পারিনি।
মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক মনজুরুল আলম মঞ্জু বলেন, আমি পদকের জন্য যুদ্ধ করিনি। দেশ স্বাধীনের জন্য যুদ্ধে যাই। পতাকার জন্য যুদ্ধ করি। অনেকের নামে স্কয়ার, সড়ক হচ্ছে। মিত্র ও মুক্তিবাহিনীর নামে স্কয়ার করার জন্য মেয়রের প্রতি অনুরোধ জানাই। কারণ মিত্রবাহিনীর সহায়তা, অবদান ভোলার নয়।