মিয়ানমারের বক্তব্য প্রতারণা : গাম্বিয়া

74

নেদারল্যান্ডসের হেগে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) রোহিঙ্গা গণহত্যা ইস্যুতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গাম্বিয়ার দায়ের করা মামলার তৃতীয় দিনের শুনানি বৃহস্পতিবার হয়েছে। শুনানির প্রথমার্ধে গাম্বিয়া যুক্তিখন্ডন করেছে। এর আগে বুধবার আদালতে মিয়ানমার নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরে। মিয়ানমারের ওই বক্তব্যকে ‘ফ্রড’ বা প্রতারণামূলক বলে উল্লেখ করেছেন গাম্বিয়ার পক্ষের আইনজীবী পল রাইখলার। রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতনের জন্য দায়ী সেনাদের বিচার ও সহিংসতা বন্ধে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়ে মিয়ানমারের উপর আস্থা রাখা যায় না বলেও দাবি করেছেন তিনি। বৃহস্পতিবার তৃতীয় দিনের শুনানির শুরুতে গাম্বিয়ার পক্ষ থেকে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন পল রাইখলার। এসময় তিনি রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন বিষয়ে মিয়ানমার বুধবার যে বক্তব্য দিয়েছে তা ‘ফ্রড’ বলে অভিহিত করেন। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে উপযুক্ত পরিবেশ তৈরিতে মিয়ানমার ব্যর্থ হয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
কোনও সেনা রোহিঙ্গাদের নির্যাতনে জড়িত থাকলে সে ব্যাপারে অভ্যন্তরীণভাবে ব্যবস্থা নেওয়ার ব্যাপারে মিয়ানমারের বক্তব্য অবিশ্বাস্য বলে উল্লেখ করেন রাইখলার। তিনি বলেন, তাতমাদাও (মিয়ানমার সেনাবাহিনী) রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গণহত্যায় কোনও সেনা জড়িত থাকলে সে ব্যাপারে ব্যবস্থা নেবে এমন আশ্বাস কিভাবে বিশ্বাস করা যায়, যেখানে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর প্রধান মিন অং হ্লাইংসহ শীর্ষ ছয় সেনা কর্মকর্তা জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন দ্বারা গণহত্যা করার অভিযোগে অভিযুক্ত।
রাইখলার বলেন, মিয়ানমার শুনানির সময় তার সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে ওঠা চরম সহিংসতার বেশিরভাগ অভিযোগকে অস্বীকার করার চেষ্টাও করেনি। মিয়ানমারের আইনজীবী গণহত্যার উদ্দেশ্য প্রমাণের জন্য সাতটি নির্দেশকের কথা বলেছেন। যা গাম্বিয়ার আবেদনেও রয়েছে। এগুলোও মিয়ানমার অস্বীকার করেনি বলে উল্লেখ করেন রাইখলার।
শুনানিতে গাম্বিয়ার পক্ষের প্রধান আইনজীবী আরও বলেন, মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চি আদালতে রোহিঙ্গা বিশেষণটি একবারও ব্যবহার করেননি। তিনি আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) কথা বলতে গিয়ে তাদের মুসলিম হিসেবে তুলে ধরেছেন। খবর বার্তা সংস্থার
এরপর গাম্বিয়ার পক্ষে আইনজীবী পিয়েঁর দ্য আর্জেন বক্তব্য দিতে উঠে বলেন, গাম্বিয়া স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে এই মামলা করেছে। গাম্বিয়া ওআইসির প্রক্সি বা প্রতিভূ হিসেবে মামলা করেনি। গাম্বিয়া ওআইসির সাহায্য চাইতেই পারে। অন্যদেরও সাহায্য চাইতে পারে। সুতরাং গাম্বিয়া ওআইসির সহায়তা নেওয়ায় বলা যাবে না যে ওআইসি এই মামলার আবেদনকারী।
পিয়েঁর দ্য আর্জেন বলেন, গাম্বিয়া ওআইসি মন্ত্রিসভা কমিটির সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর মামলা করেছে বলে মিয়ানমারের আইনজীবী স্টকারের দাবি বিভ্রান্তিকর। মিয়ানমারের সঙ্গে বিরোধ ওআইসির নয়, গাম্বিয়ার। গাম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট জাতিসংঘে গণহত্যার কথা বলেননি বলে যুক্তি দিয়ে বলা হয়েছে, ওআইসির সিদ্ধান্তের পরই গাম্বিয়া মামলা করেছে, কথাটি ঠিক নয়। গাম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট জাতিসংঘে বক্তব্য দেওয়ার পর জাতিসংঘ তদন্ত কমিটির রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে এবং সেই রিপোর্টের তথ্যের ভিত্তিতেই গণহত্যার অভিযোগ নিয়ে গাম্বিয়া আদালতে আসার সিদ্ধান্ত নেয়। তিনি বলেন, মিয়ানমারের আইনজীবী স্টকার বলেছেন, কোনো অপরাধ যদি ঘটেও থাকে, তাহলে গাম্বিয়ার সেই বিষয়ে মামলা করার অধিকার নেই। কূটনৈতিক ব্যবস্থায় তার আপত্তির কথা জানাতে পারে, কিন্তু আদালতে আসতে পারে না। স্টকারের এসব বক্তব্য সঠিক নয়। গাম্বিয়া সনদের স্বাক্ষরকারী হিসেবে সনদ লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আবেদনের অধিকার রাখে।
এরপর প্রফেসর ফিলিপ স্যান্ডস গাম্বিয়ার পক্ষে দাঁড়িয়ে বলেন, ১৯৪৮ সালের গণহত্যা সনদের বাধ্যবাধকতা পূরণ করছে কি না, সে প্রশ্ন তোলার অধিকার গাম্বিয়ার অবশ্যই রয়েছে। এ বিষয়ে তিনি অতীতের রায়ের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, আন্তর্জাতিক সনদের অংশীদার হিসেবে অন্তর্বর্তী আদেশের আবেদন করার অধিকার গাম্বিয়ার রয়েছে। ফিলিপ স্যান্ডস বলেন, গণহত্যার উদ্দেশ্য সম্পর্কে মিয়ানমারের আইনজীবী সাবাস একটি নতুন আইনগত মান নির্ধারণ করার চেষ্টা করেছেন, যেটি পরীক্ষিত নয়। কিছু কিছু কার্যক্রম গণহত্যার নির্দেশিকার ধারণা তৈরি করলেও সব কার্যক্রম গণহত্যার ধারণা প্রমাণ করে না, এমন দাবি ঠিক নয়।
গাম্বিয়ার পক্ষে সবশেষে দেশটির আইনমন্ত্রী আব বকর তামবাদু বলেন, মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের জীবন হুমকির মুখে। গাম্বিয়া প্রতিবেশী না হতে পারে, কিন্তু গণহত্যা সনদের স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে গণহত্যা বন্ধ এবং তা প্রতিরোধে আমাদের দায়িত্ব রয়েছে।
শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এ বিষয়ে গাম্বিয়া ওআইসির কাছে সাহায্য চেয়েছে। সার্বভৌম দেশ হিসেবে গাম্বিয়া একা এই আবেদন করেছে। গাম্বিয়া গণহত্যা সনদের রক্ষক হিসেবে এই আদালতের কাছে জরুরি ভিত্তিতে অন্তর্বর্তী ব্যবস্থার নির্দেশনার দাবি জানাচ্ছে। তামবাদু ছয়টি অন্তর্বর্তী ব্যবস্থার দিকনির্দেশনা দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে তার বক্তব্য শেষ করেছেন।
বিবাদী পক্ষের ভাষ্য
বুধবার আদালতে গণহত্যার অভিযোগ খÐন করে মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি যেসব কথা বলেছেন, তার মধ্যে নতুন কিছু ছিল না। এতদিন ধরে মিয়ানমার সেগুলোই বলে আসছে।
শান্তিতে নোবেলজয়ী এই আইনজীবী বলেন, ২০১৭ সালের আগস্টে স্থানীয় সশস্ত্র গোষ্ঠী পুলিশের উপর হামলা চালানোর পর মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ওই অভিযান চালিয়েছিল, কোনো জাতি বা ধর্মীয় স¤প্রদায় তার লক্ষ্য ছিল না।
আন্তর্জাতিক আদালতের এই বিচারের এখতিয়ার নেই যুক্তি তুলে ধরে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর বিচারকদের বলেন, সেনা সদস্য বা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নিয়মভঙ্গের অভিযোগ থাকলে মিয়ানমার তা সক্রিয়ভাবে তদন্তের পর দায়ীদের বিচার ও শাস্তি দিয়ে থাকে।
তার ভাষ্যে ‘অভ্যন্তরীণ সংঘাতের’ ওই ঘটনায় মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়ে থাকলেও সেগুলো গণহত্যার পর্যায়ে পড়ে না এবং ১৯৪৮ সালের কনভেনশনের অধীনে তার বিচার করা যায় না।
সুচির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমক্রেটিক পার্টির মুখপাত্র মিয়ো নায়ুন্ত বলেন, ‘জটিল রাখাইন ইস্যু নিয়ে খুব বিশদ ও সুনির্দিষ্টভাবে’ মিয়ানমারের পক্ষে মামলা উপস্থাপন করেছেন।
বৃহস্পতিবার আদালত ভবন দ্য হেগের পিস প্যালেসের বাইরে দুই পক্ষের বিক্ষোভকারীরা জড়ো হন। মিয়ানমারের প্রতিনিধি দল আদালত প্রাঙ্গণ ছাড়ার সময় তাদের একদল ‘মা সু, সুস্থ থাকো’ এবং রোহিঙ্গাদের পক্ষে আরেক দল ‘অং সান সু চি, শেইম অন ইউ’ ¯েøাগান দিতে থাকে।
এই আদালতের সিদ্ধান্ত মানার আইনি বাধ্যবাধকতা আছে এবং এটার বিরুদ্ধে আপিল করার কোনো সুযোগ নেই। যদিও সিদ্ধান্ত মানতে বাধ্য করার কোনো ক্ষমতা নেই আদালতের এবং অনেক ক্ষেত্রে এর সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করার বা মানতে ব্যর্থ হওয়ার ঘটনা প্রায়ই ঘটে।
সাময়িক পদক্ষেপের সিদ্ধান্ত আসার পর পূর্ণাঙ্গ মামলা কয়েক বছর ধরে চলতে পারে।