মিয়ানমারের দুনীর্তিগ্রস্ত সেনাবাহিনী সারা বিশ্বে কলংকিত হয়েছে

51

দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদ এবং অন্যান্য মিডিয়াগুলি অহরহ অনুসন্ধানী রিপোর্ট করে যাচ্ছে যে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীই মিয়ানমারের সব জাতিগত দাঙ্গা-হাঙ্গামার প্রধান হোতা। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় এবং সেনাবাহিনীর পরিচালনায় এই বর্বর অবিচার এবং অত্যাচার সংখ্যালঘুুদের উপর দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর থেকে বিভিন্ন মাত্রায় চলতে থাকলেও সারা বিশ্ব-মানবতা এই পর্যন্ত এর বিরুদ্ধে কোন কার্যকর এবং শাস্তিমূলক ব্যবস্থা করতে পারেন নাই।
মনে হচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন শক্তিধর দেশগুলি মিয়ানমারে আঞ্চলিক আধিপত্য কায়েমের মাধ্যমে ইহার প্রাকৃতিক সম্পদ লুঠে নেওয়ার একটি দীর্ঘস্থায়ী বন্দোবস্ত করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। যে কারণে মিয়ানমার বিশ্বের শক্তিশালী দেশগুলির দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে তার মধ্যে রয়েছে (ক) মিয়ানমার দক্ষিণ এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার কৌশলগত সুবিধাজনক অঞ্চলে অবস্থিত (খ) মিয়ানমারের সাথে চীন এবং ভারতের দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে, (গ) মিয়ানমারের একটি দীর্ঘ সমুদ্র উপকূল রয়েছে (ঘ) দেশটির প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে (ঙ) এবং দেশটির কোন অঞ্চলেই জনসংখ্যার চাপ নেই। সারা দেশে বিক্ষিপ্তভাবে তারা বাস করে। মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন শ্রেণী সুপরিকল্পিত অসাধু পন্থায় সম্পদ আহরণের জন্য সবসময় উদগ্রীব। মিয়ানমারের সাথে গভীর সম্পর্কের মাধ্যমে যেসব দেশ অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছে তাদের মধ্যে প্রথম স্থানে রয়েছে চীন। তারপর রয়েছে জাপান ও ভারত। চতুর্থ স্থানে রয়েছে দূরের রাশিয়া। উপরোক্ত দেশগুলি রোহিঙ্গাদের উপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বর্বর অত্যাচার, নিপীড়নের ব্যাপারে একটি শব্দও উচ্চারণ করতে রাজি নেই। বরং জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে চীন ও রাশিয়া ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগ করে রোহিঙ্গা সমস্যার উপর চলিত আলোচনা বন্ধ করে দিয়েছে। বারবার সশস্ত্র গ্রুপকে মিয়ানমারকে নিয়ন্ত্রণে আনার কৌশল হিসাবে ব্যবহার করেছে। ২০১১ সাল পর্যন্ত মিয়ানমার আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্র প্রায় বিচ্ছিন্ন ছিল। ঐ সময়ে মিয়ানমার সীমান্তে মিয়ানমার বিরোধী সশস্ত্র গ্রুপগুলিকে দমনের জন্য চীন অনবরত মিয়ানমার সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত সরকারকে সাহায্য সহযোগিতা করেছে। তখন চীনের সশস্ত্র সাহায্য না পেলে মিয়ানমারের সামরিক সরকার টিকে থাকাটাই দুরূহ হয়ে পড়ত। ইহা ছাড়াও চীন ইতিমধ্যে মিয়ানমারে বিভিন্ন অর্থনৈতিক প্রকল্পে বিশাল অংকের পুঁজি বিনিয়োগ আরম্ভ করে। অবশেষে সম্প্রতিক কালে রোহিঙ্গা সমস্যা সৃষ্টি হওয়ার পর মিয়ানমার যখন বিশ্বের অসহনীয় চাপের সম্মুখীন হয় তখন চীন মিয়ানমারকে আশ্রয় দেওয়ার ব্যাপারে এমন কোন কৌশল নেই যা প্রকাশ্যে এবং অপ্রকাশ্যে গ্রহণ করে নাই। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ভোটাভুটিতে ভেটো দেওয়ার ব্যাপারে কার্পণ্য করে নাই। রাশিয়াও চীনকেই অনুসরণ করেছে। চীন ও রাশিয়া নিরাপত্তা পরিষদে ভেটো দেওয়ার ফলে মিয়ানমার আপাততঃ রক্ষা পেলেও চীন ও রাশিয়া যুগ যুগ ধরে সংগ্রাম, ত্যাগ, তিতিক্ষা এবং লক্ষ লক্ষ রাজনৈতিক কর্মীদের জীবন বিসর্জন দিয়ে বিশ্বের সর্বহারা, নির্যাতিত এবং অত্যাচারিত মানুষের শেষ আশ্রয় স্থল হিসেবে যে সুনাম অর্জন করেছিল তার সর্বনাশ হয়েছে, সে সুনাম ফিরিয়ে পাওয়ার আর কোন উপায় নেই। ভারতও এই পর্যন্ত রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে এমন কোন পদক্ষেপ নেয় নাই যাতে মিয়ানমার সরকার অসন্তুষ্ট হতে পারে। অবশ্য রোহিঙ্গাদের জন্য ভারত এই পর্যন্ত কি পরিমাণ রিলিপসামগ্রী পাঠিয়েছে তার প্রতিনিয়ত হিসাব দিতে ভুলেন না। আবার ভারতের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ ও ভারতের বন্ধুত্ব তুঙ্গে বলতেও দ্বিধা করেন না। যাই হউক বর্তমানে চীনের সাথে মিয়ানমার এমন শক্তিশালী সম্পর্কে আবদ্ধ, এই সময়ে চীন কার্যকরী এবং আন্তরিক পদক্ষেপ গ্রহণ করলেই অবশ্যই রোহিঙ্গা সমস্যার একটি সন্তোষজনক মীমাংসা হয়ে যাবে। কাজেই চীন কতটুকু আন্তরিক হবে তার উপরই নির্ভর করছে কত দ্রুত রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান হবে।
একথা বিশ্ব জনমতের কাছে পরিষ্কার হয়েছে যে শুধু চীন, রাশিয়া, ভারত এবং জাপানের সহিত মিয়ানমারের দৃঢ় বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ককে ব্ল্যাক মেইল করে দৃঢ় ভাবে বিশ্বজনমতের প্রতি মিয়ানমার অবজ্ঞা দেখাচ্ছে। চীন বি.আর.আই. বা বেল্ট এবং রোড় প্রজেক্ট এর আওতায় মিয়ানমারের বিশাল অর্থনৈতিক প্রকল্প সমূহের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে এবং মিয়ানমার সেনাবাহিনীতে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র সরবরাহ, ফান্ড এবং ট্রেনিং দেওয়া অব্যাহত রেখেছে।
ভারত ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত মিয়ানমারের সেনাবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত মিয়ানমার সরকার থেকে উল্লেখযোগ্য দুরুত্ব বজায় রেখেছিল। পরবর্তী কালে সামরিক কৌশলগত এবং ব্যবসায়িক স্বার্থের কথা চিন্তা করে ভারত মিয়ানমারের সাথে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ থেকে ঘনিষ্ঠতর করতে আরম্ভ করে। ২০১৩ সাল থেকে মিয়ানমারে যৌথভাবে ভারত বিভিন্ন অর্থনৈতিক প্রজেক্টসমূহে অর্থ বিনিয়োগ আরম্ভ করে। মিয়ানমারের উত্তর পূর্ব অঞ্চলে বিদ্রোহ দমাতেও ভারত কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করে। ভারতের মূল উদ্দেশ্য মিয়ানমারের অভ্যন্তরের চীনের প্রচন্ড প্রভাবে রশি টেনে ধরা। ইতিমধ্যেই ভারত এবং মিয়ানমার যৌথভাবে ৪৮৪ মিলিয়ন ডলারের একটি প্রকল্প শুরু করেছে যার উদ্দেশ্যে হলো, সমুদ্র পথে ভারতের কলকাতা বন্দর মিয়ানমারের সিতওয়া (ঝওঞঞডঊ) বন্দরের সাথে সংযোগ করা। মিয়ানমারের এই সমুদ্র বন্দর রাখাইন প্রদেশে অবস্থিত। যখন এই প্রজেক্টের কাজ শেষ হবে তখন মিয়ানমারের এই বন্দরের সাথে চীনের ‘পালিতোয়া’ (চধষবঃধি) সমুদ্রবন্দরের সংযোগ স্থাপিত হবে, পরে দক্ষিণ পূর্ব ভারতের মিজোরামের সাথে স্থল পথে পালিতোয়ার সাথে সংযোগ স্থাপিত হবে। জাপানের সাথে মিয়ানমারের সম্পর্ক সবচাইতে নিবিড়। কারণ উভয় দেশ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় ব্রিটিশবিরোধী ছিল এবং উভয় দেশ ব্রিটিশের বিরুদ্ধে সক্রিয়ভাবে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল। উভয়ের বন্ধুত্বে তখন থেকে কোন ফাটল দেখা যায় নাই। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর জাপান যখন আবার অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠল, তখন থেকেই জাপানের বৈদেশিক ঋণ সংস্থা ঙউঅ (ঙাবৎংবধং উবাবষড়ঢ়সবহঃ অংংরংঃধহপব) এর মাধ্যমে মিয়ানমারকে অর্থনৈতিক সহায়তা অব্যাহতভাবে দিতে তাকে।
২০১৩ সালে জাপানের প্রধানমন্ত্রী সিনজো আবে মিয়ানমারে প্রথম সফরে যান। তখনই মিয়ানমারকে শুধু উচ্চমানের অবকাঠামো নির্মাণের জন্য ৫.৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ বরাদ্দ দেন ইহা ছাড়াও জাপানের বিভিন্ন ফার্মও কোটি কোটি ডলার মিয়ানসারে বিনিয়োগ করেছে এবং অহরহ তারা বিনিয়োগ করে যাচ্ছেন। জাপানের মারুবেনি কোম্পানী কয়লা খাতে ১.৭ বিলিয়ন ডলার একাই বিনিয়োগ করেছে। ইহা ছাড়াও মারুবেনি ৩.৫০ বিলিয়ন ডলারের অন্য এক পাওয়ার প্লান্টে উল্লেখযোগ্য অংশ বিনিয়োগ করেছে।
মিয়ানমার সেনাবাহিনী ১৯৬২ সালে জাতিগত দাঙ্গা-হাঙ্গামা দমন করে মিয়ানমারে শৃংখলা কায়েমের প্রতিশ্রæতি দিয়ে দেশের ক্ষমতা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দখল করেছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখলের পরেও হাঙ্গামা দমনের তেমন কোন লক্ষণ দেখা যায় নাই। বরং প্রতিটি মুহ‚র্তে এই দাঙ্গা-হাঙ্গামা বেড়েই চলেছে এবং এর সাথে গণহত্যাও যোগ হয়েছে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর বর্তমানে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী সরাসরিভাবে মিয়ানমারের প্রেসিডেন্টকে লিখিতভাবে দৈনন্দিন ঘটনা, দুর্ঘটনা সম্পর্কে রিপোর্ট দিয়ে থাকেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী সকল জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে এবং সীমাহীন ক্ষমতার অধিকারী। বর্তমানে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর কিছু উচ্চস্তরের অফিসার এবং অবসরপ্রাপ্ত কিছু অফিসার রয়েছে যারা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে জঘন্য ধরনের অপরাধে অপরাধী সাব্যস্ত এবং সে অপরাধ অহরহ চলমান রয়েছে। বর্তমানে এম.ই.এইচ.এল. এবং এম.ই.সি. নামে দু’টো কোম্পানী রয়েছে, কোম্পানীগুলির পরিচালনাবোর্ড সম্পূর্ণভাবে ঐসব উচ্চপদস্থ সামরিক অফিসার এবং কিছু অবসরপ্রাপ্ত অফিসার কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হয়। এই কোম্পানীগুলির কারও কাছে জবাবদিহিতা নেই। কোম্পানীগুলিতে সেনাবাহিনীর বিরাট কায়েমী স্বার্থ রয়েছে। যেহেতু মিয়ানমারের শান্তি কায়েম হলে সেনাবাহিনীর কায়েমী স্বার্থে আঘাত লাগবে এবং বিদেশি যেসব রাষ্ট্র মিয়ানমারে অস্ত্র বিক্রয় করেছে তারাও অবিশ্বাস্য উচ্চমূল্যে অস্ত্র বিক্রয় করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে। এই অবস্থার জন্য মিয়ানমারে শান্তিস্থাপন করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
মিয়ানমারের যুদ্ধাবস্থা বিদেশি অনেক সরকার এবং অস্ত্র বিক্রেতা কোম্পানীর বিরাট অংকের আয়ের পথ খুলে দিয়েছে। কাজেই মিয়ানমার সেনাবাহিনী এবং সরকারকে বিশ্বের যেকোন প্রতিকূলতা থেকে রক্ষা করা সেসব বিদেশি সরকার এবং অস্ত্র বিক্রেতাদের নিজেদের আয়ের স্বার্থে জরুরি হয়ে পড়েছে। কাজেই বর্তমান বিশ্বে মিয়ানমারকে সমর্থনকারীর সংখ্যা অহরহ বাড়ছে। সম্প্রতি সিঙ্গাপুর মিয়ানমারে বিনিয়োগকারী হিসাবে চীনকেও ছাড়িয়ে গেছে।
আসলে সবকিছুর উপর স্বীয় জাতির স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়ার নীতি যাকে রাজনৈতিক ভাষায় জবধষ-চড়ষরঃরশ বলে আখ্যায়িত করা হয়। সে অবস্থা বর্তমান বিশ্বের সর্বত্র পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিশ্বের সমস্ত শক্তিশালী দেশগুলি যদি জবধষ-চড়ষরঃরশ এর ফাঁদে আটকা পড়ে তাহলে বিশ্বে যে বিশৃংখলা সৃষ্টি হবে, তা বন্ধ করা কারও পক্ষে সম্ভব হবে না। সারা বিশ্বের রাজনীতি ব্যবসা-বান্ধব হয়ে পড়েছে। যদি রাজনীতি অচিরেই ‘মানবমূল্যবোধ’ বান্ধব না হয় তাহলে বিশ্বের ভবিষ্যৎ বড়ই অন্ধকার।

লেখক : কলামিস্ট