মিষ্টি রোদ মাখানো

101

সবুজ পাতার খামের ভিতর / হলুদ গাঁদা চিঠি লিখে
কোন পাথারের ওপার থেকে/ আনল ডেকে হেমন্তকে?
আনল ডেকে মটরশুঁটি / খেসারি আর কলাই ফুলে
আনল ডেকে কুয়াশাকে / সাঁঝ সকালে নদীর কূলে।
সকাল বেলায় শিশির ভেজা / ঘাসের ওপর চলতে গিয়ে
হালকা মধুর শীতের ধোঁয়ায় / শরীর ওঠে শিশিরিয়ে।
হেমন্ত তার শিশির ভেজা / আঁচল তলে শিউলি বোঁটায়
চুপে চুপে রঙ মাখাল / আকাশ থেকে ফোটায় ফোটায়।
হেমন্ত নিয়ে কবি সুফিয়া কামালের উল্লেখিত কিশোর কবিতায় যে চিত্র আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে তা খুব চির চেনা গ্রামের চিত্র। এত সুন্দর সুনিপুণ ভাষায় তিনি হেমন্তকে চিত্রিত করেছেন, যা এক কথায় অতুলনীয়। হেমন্তের মিষ্টি রোদ মাখানো আসল রূপ দেখতে হলে আমাদের গ্রামে যেতে হবে। কবি বলেছেন, আমাদের গ্রামখানি ছবির মতন। বাংলাদেশকে নিয়ে কবি বলেছেন, ধানের দেশ, গানের দেশ, প্রাণের দেশ, বাংলাদেশ। কত রূপেই না কবি দেশের ছবি এঁকেছেন। এঁকেছেন হেমন্তের ছবি।

বাংলার ছয়টি ঋতুর ভেতর হেমন্ত একটু ভিন্ন মেজাজ নিয়ে আমাদের সামনে হাজির হয়। শরতের শেষে হেমন্তের আগমনে খাল-বিল-ঝিলে নীল-সাদা শাপলারা মাথা উঁচিয়ে হেসে ওঠে। কোথাও পদ্মফুলের পাপড়িগুলো নিজের আগমনী বার্তা জানান দেয়। শাপলা ফোটা বিলে দুধসাদা বকগুলো এক পায়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে মাছের আশায়। ডাঙায় শিউলি ফুলের মধুর হাসিতে মন-প্রাণ খুশিতে নেচে ওঠে। আকাশে অলস সাদা মেঘের ভেলা ঘুরে বেড়ায় আপন মনে। সে সাদা মেঘকে কখনো মনে হয় ভেড়ার পাল। আবার কখনো মানুষের আদলে ফুটে ওঠে রবি ঠাকুরের শ্মশ্রুমন্ডিত মুখ।

হেমন্তের মোহনীয় রূপে কবি না হয়ে উপায় আছে ? এমনিতেই বাঙালি স্বভাব কবি । গ্রীষ্মের দাবদাহ নেই। শীত আসি আসি করছে। বাতাসে ঠান্ডা আমেজ। এই নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ায় শরীর মন জুড়িয়ে যায়। উঠোনের মিষ্টি নরম রোদ গায় মাখিয়ে বসে থাকতে কার না ভালো লাগে বলো? জানালার পাশে উঁকি দেয়া সুপুরি গাছের চারার পাতায় পাতায় রোদ ঝিলিক দিয়ে ওঠে। যেন পাতারা নড়ছে আর আয় আয় বলে ডাকছে, ছুটে এসো খোকা, ছুটে এসো। নরম রোদ গায় মাখিয়ে আমার পাশে বসো। তখন ছুটে যেতে ইচ্ছে করে খোলা মাঠে। মাঠের বাছুরটির পেছন পেছন ছুটে গিয়ে ইচ্ছে হবে টুপ করে একটা ডিগবাজি খাই। আহারে হেমন্ত! মনে হবে এমন হেমন্ত যদি সারা বছর জুড়ে থাকতো। তা কি আর হয়? আমাদের যে ছয় ঋতু। একেক ঋতুতে একেক রূপে সাজে বাংলার প্রকৃতি। এটাই বাংলার বৈশিষ্ট্য।

হেমন্তের নরম মাটির গন্ধ আর নানা বর্ণের ফুলের সৌন্দর্যের বর্ণনা পাওয়া যায় জীবনানন্দের কবিতায়। হেমন্তের প্রকৃতির বাহারি সজ্জা। এ ঋতুতে ফোটে অপরাজিতা, ছাতিম, গন্ধরাজ, হাসনাহেনা, মল্লিকা, শিউলি, কামিনী, হিমঝুরি, মধুমঞ্জুরি ইত্যাদি ফুল। এগুলো ছাড়াও আমাদের দেশের বনে-বাদাড়ে, ঝোঁপঝাড়ে লতাগুল্মের ভেতরে ফোটে নাম না জানা কত ফুল। রূপে-গুণে অপূর্ব হল অপরাজিতা। প্রাকৃতিকভাবে জন্ম নেয় এ ফুল। সৌখিনতার বশে অনেকেই টবে চাষ করেন নীলাভ অপরাজিতার। গভীর রাতে ছাতিমের পাগলকরা গন্ধে কেড়ে নেয় মন। এ ঋতুর আরেক ফুল কাঞ্চন। রকমফেরে ভিন্ন হলেও সব কাঞ্চনই মনোমুগ্ধকর। নাম শুনেই মন প্রাণ জুড়িয়ে যায়। চারদিকে তীব্র গন্ধ ছড়িয়ে দিয়ে এ সময় ফোটে দেব কাঞ্চনের হালকা বেগুনি বা সাদাটে ফুল। এ ছাড়া রক্তকাঞ্চন এবং সাদা কাঞ্চনের সৌন্দর্যের গড়নেও চোখ ফেরানো ভার। প্রকৃতিতে লুকিয়ে থাকা মল্লিকা, হিমঝুরি আর অশোক আড়মোড়া ভেঙে এই ঋতুতেই জানান দেয় তাদের রূপের-সৌন্দর্যের-গন্ধের। পথের ধারে আকন্দ ফুলের ঝাড়। এ ছাড়া আরো কত ঘাসজাতীয় বা বনজপাতির
ফুল এই ঋতুতেই ফোটে। এ ঋতুতেই বাহারি রঙের পাতা বাহার মেলে ধরে তাদের পরিপূর্ণ সৌন্দর্য।
তাই বলা যায়, এই হেমন্তঋতু ঋতুরাজ বসন্তের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। হেমন্ত তুমি আবার এসো। তুমি এসে দূর করে দেবে আমাদের সমাজের সব অশুচি আর মন্দকে। তোমার আগমনে আমরা আবার হেসে উঠবো, নেচে উঠবো গানে গানে।