মিষ্টি দাদুর দুষ্টু নাতি

441

সাধেন সাহেব সব সময় হাসি খুশি থাকা একজন মানুষ। নিজের একান্ত অনুভূতিগুলো কাউকে জানানোর মতো স্পৃহা কখনো পোষণ করেনি। নিজেকে গুটিয়ে রাখতেই স্বাচ্ছন্দবোধ করে সাধেন সাহেব। আগে শহরে দোকানদারী করলেও বয়সের ভারে গ্রাম থেকে শহরে আসা যাওয়ার কষ্টটা শরীরে বহন করছে না আর। শেষমেষ বেচা বিক্রি করেই গ্রামের পথ ধরলো একেবারে। শহরের দম বন্ধ পরিবেশ, যন্ত্র দানবের হাঁক ডাক এসব যেন অসহ্য। গ্রামের সুশীতল সবুজ মোড়ানো রূপ বাহারী পরিবেশ নিজের কাছে শ্রেয় মনে করে।
শৈশবটা গ্রামে কাটলেও কৈশোরে পড়তেই সেই সুযোগ আর ছিলো না। অল্প বয়সেই বাবাকে হারিয়ে নেমে পড়তে হয়েছিল জীবন সংগ্রামে। কখনো আত্মীয় বাড়ি, কখনো দোকানের চাকরী করে বড় হতে হয়েছে সাধেন সাহেবকে। জীবনের কঠিনতম সময় পার করতে হয়েছে কিশোর বয়সেই। এখন সেসব স্মৃতি অতীত। সেই দিনের দুঃসহ স্মৃতিগুলো মনের আয়নায় ভেসে উঠলে আবেগ তাড়িত হয়ে যায় মন। পরে নিজেকে সামলে বলে এটাই জীবন, এটাই বাস্তবতা। এখন বাকি জীবনটা আদরের নাতি নাতনীদের সঙ্গে আনন্দ উল্লাসে কাটিয়ে দিতে চায় সাধেন সাহেব। গ্রামে ছোট্ট একটা ব্যবসার দোকান নিয়ে বসেছে। দোকানটা যতটা না আয়ের জন্য তার চেয়ে নিজের সময়টুকু ব্যয় করার জন্য। ইচ্ছে হলে যায়,আবার মন না চাইলে যায় না দোকানে। ছেলেরা নিষেধ করলেও নিজের ইচ্ছেতে দোকান খুলে বসেছে। বাড়ি থেকে অতি নিকটে দোকান। সকালে ঘর থেকে বের হলেই আদরের নাতি-নাতনীরা বায়না ধরে বসে প্রতিদিন।
নাতনীর বয়স দশের কাছাকাছি আর নাতির বয়স সবে চার পেরুল মাত্র। দোকানে যাক আর না যাক কাপড় চোপড় পড়ে বের হতে দেখলেই জড়িয়ে ধরে নাতি। বায়না দিয়ে বসে আমার জন্য কেক আনবে, চিপস আনবে, জুস আনবে আরো কতো কী। দাদুও সায় দেয় আনবে বলে।
আনুক আর না আনুক সায় না দিলে নাছোড় বান্ধা নাতি। পাশাপাশি নাতনীও বলে ওঠে আমার জন্য এটা ওটা আনবে। দাদুও হাসি মুখে মেনে নিয়ে বের হতে হয় ঘর থেকে। দাদু অন্যদের কাছে বলে বেড়ায় এটাই তো আনন্দের। দাদু নাতির খুনসুটিও হয় কখনো কখনো। নাতি যখন বায়না ধরে বলে এটা ওটা আনবে তখন দাদু বলে আনতে পারবো না,আমার কাছে টাকা নেই। হয়েছে, দাদুর সাথে কথা বলাবলি বন্ধ নাতির।
আবার যখন ঘরে ফিরে দুটো মিষ্টি জুস হাতে নিয়ে তখন নাতির উল্লাস দেখে কে? এক লাফে উঠে যায় দাদুর কাঁধে। খুশিতে টেনে দেবে চুল, ঝুলিয়ে পড়বে চুল ধরে, গলা ধরে দাদু যে কোন ব্যথা পাবে বা পাচ্ছে ওদিকে ভ্রæক্ষেপ নেই কোন। যদি বলে যে আমি ব্যথা পাচ্ছি, নাতি বলে ওঠে পাও। সেই আরো জোর জবরদস্তি করে বেশি, ব্যথা পেলেও নাতির এসব দুষ্টামিতে মোটেও রাগান্বিত হয় না দাদু। কখনো কখনো নাতিকে ওর মা মারতে উদ্যত হলে উল্টো বকা দেয় দাদু, বলে যে, এগুলো আমার আর আমার নাতির ব্যাপার,তুমি কে মাথা ঘামানোর? তখন যেন অসহায়ের মতো চেয়ে থাকে ছেলেকে শাসন না করে নিজেই শাসিত হয়ে। এগুলোতে আপনি ব্যথা পাচ্ছেন না? দাদু বলে ব্যথা পেলে আমি পাচ্ছি, আমি কী তোমার কাছে অভিযোগ করতে গেছি? যে তুমি মারতে আসছো? নাতির নাম সুমিষ্ট।
সুমিষ্টের মা গোস্সা করে বলে, আমাকে পরে আর কিছু বলতে পারবেন না।
সুমিষ্টের মা কী বলছে, দাদু কী বলছে ওদিকে কোন খেয়াল নেই সুমিষ্টের। সেই আছে তার মতো করে খেলতে। যতক্ষণ না নিজের ইচ্ছায় না থামে সুমিষ্ট। দাদু যদি বলে থাম একটু আমার কাজ আছে, একটু বাইরে যাবো, সুমিষ্ট বলে চলো আমিও যাবো তোমার সাথে। তুমি কী করবে আমার সাথে? তুমি যেটা করবে আমিও ওটা করবো। তুমি তো ছোট, পারবে? হ্যাঁ পারবো বিজ্ঞের মত করে উত্তর দেয় সুমিষ্ট। দাদু হাসে আর দেখে ছোট্ট নাতির কান্ডখানা। এভাবেই নিত্য চলে দাদু নাতির কথোপকথন।
একদিন চুপিসারে বাজারে যাচ্ছে দাদু, সুমিষ্ট খেলা করছে আপন মনে। তাই আড়ালে রেখেই রওনা হলো দাদু, পলকেই দেখে ফেলল সুমিষ্ট, ধূলোবালি মাখানো অবস্থায় দিলো দৌড়, পিছু পিছু ছুটল দাদুর, আমিও যাব তোমার সাথে। আচ্ছা যাও তোমার মাকে বলে আসো। না বলব না, তুমি বলো, হাত মুখ পরিস্কার করে আসো। না আসব না, আমাকে ফেলে চলে যেতে? না, যাব না আমি, যাবে আমি জানি, বিজ্ঞের ন্যায় বলে দেয় সুমিষ্ট। অগত্যা নাতিকে নিয়ে ঘরে ফিরল ফের। না নিয়ে গেলে তো হুলস্থুল কান্ড ঘটে যাবে ঘরে।
পরিশেষে মা’য় হাত মুখ ধূয়ে মুছে দিয়ে তৈরী করে দিলে আদরের দাদু নাতি মন খুশিতে পা বাড়ায় বাজারের পথে। দোকানের যেটা বলে ওটা কিনে দিতেই হবে, না দিলে দোকানের সামনে থেকেও নড়বে না এক কদম। পকেটে টাকা থাকুক আর না থাকুক।এক রোখা নাতি। প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র সওদা করে ফেরার সময় বলে আমি জুস খাবো। জুস একটা কিনে দিল, কিন্তু সুমিষ্ট একটা নিবে না দুটো চায়। একটা নিজের আরেকটা বোনের জন্য।
দোকানে কোন কিছু কিনলেই দুটো কিনে দিতে হবে বোনের জন্য সহ, দোকানদার বলে দেখ, বোনের জন্য কত টান ছোট্ট ভাইটার।
দাদু বলে নাতি আমার এমনই। ঘরে ভাই বোন ঝগড়া ঝাটি করলেও বাইরে এলে বোনের জন্য টান থাকে নাতির। এটা নিয়ে যখন উপস্থিত সবাই হাসাহাসি করছে, দোকানদার বলে উঠে, দেখতে হবে না নাতিটা কার? মিষ্টি দাদুর দুষ্ট নাতি। এমন দুষ্ট নাতি থাকলে সময়টা ভালোই কাটে দাদুর। দাদু সায় দিয়ে বলে, দাদু নাতির আনন্দটাই যেন পরম আনন্দ। হাসি মুখে বাড়ি ফিরে দাদু আর নাতি।