মির্জা ফখরুলের আসন শূন্য ঘোষণা

27

নির্দিষ্ট সময়ে সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ না নেওয়ায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের আসনটি শূন্য হয়ে গেল। ফলে বগুড়া-৬ আসনটিতে নতুন করে ভোটের উদ্যোগ নেবে নির্বাচন কমিশন। গতকাল মঙ্গলবার রাতে সংসদ অধিবেশনে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী এই ঘোষণা দেন।
একাদশ সংসদ নির্বাচনে বিএনপি থেকে নির্বাচিত পাঁচজন সংসদ সদস্য নানা নাটকীয়তার পর শপথ নিলেও দলটির মহাসচিব ফখরুল নেননি। তিনি বলেছেন, দলীয় সিদ্ধান্তেই তিনি শপথ নেওয়া থেকে বিরত থাকছেন। এটা তাদের ‘কৌশলেরই অংশ’।
সেক্ষেত্রে ফখরুলের বিষয়ে কী হবে- এ প্রশ্নের জবাবে স্পিকার শিরীন শারমিন গতকাল বিকালে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শপথ না নিলে সংবিধান অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সংবিধানের ৬৭ (১) এর ‘ক’ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, কোনো নির্বাচনের পর সংসদের প্রথম বৈঠকের তারিখ থেকে ৯০ দিনের মধ্যে শপথ নিতে না পারলে ওই সংসদ সদস্যের আসন শূন্য হবে। তবে এই ৯০ দিনের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে স্পিকার যথার্থ কারণে তা বাড়াতে পারবেন। খবর বিডিনিউজের
একাদশ সংসদের কার্যক্রম গত ২৯ জানুয়ারি শুরু হওয়ায় ৯০ দিনের সেই সময়সীমা সোমবার পেরিয়ে যায়। শেষ দিনে বিএনপির চারজন সংসদ সদস্য শপথ নেন, তার তিন দিন আগে নেন অন্যজন।
বিএনপি মহাসচিব শপথ নিতে কোনো আবেদনও করেননি বলে বিকালে জানিয়েছিলেন স্পিকার।
রাতে সংসদের অধিবেশনে শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন, সংবিধান অনুযায়ী সংসদের প্রথম বৈঠক থেকে ৯০ দিনের মধ্যে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর শপথ নিতে অসমর্থ হওয়ায় তার আসনটি শূন্য হয়েছে। জাতীয় সংসদের কোনো আসন শূন্য হলে কার্যপ্রণালী বিধি অনুযায়ী তা সংসদকে জানাতে হয়; সেটাই জানান স্পিকার।
কার্যপ্রণালী বিধির ১৭৮ (৩) বিধিতে বলা আছে, যদি কোনো সদস্য তার আসন থেকে পদত্যাগ করেন কিংবা সংসদের অনুমতি না নিয়ে একাধিক্রমে ৯০ দিন বৈঠকে অনুপস্থিত থাকেন, কিংবা সংবিধানের ৬৭ অনুচ্ছেদের (১) (ক) দফায় উল্লেখিত নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শপথগ্রহণ করতে ও শপথ-পত্রে স্বাক্ষর প্রদান করিতে ব্যর্থ হন কিংবা অন্য কোনোভাবে সদস্য না থাকেন, তাহলে সংসদ অধিবেশনে থাকলে স্পিকার তা সংসদের গোচরে আনবেন। তবে শর্ত থাকে যে, সংসদ অধিবেশনে না থাকলে পরবর্তী অধিবেশন আরম্ভ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই স্পিকার সংসদকে জানাবেন যে, অধিবেশন মধ্যবর্তী সময়ে ওই সদস্য পদত্যাগ করেছেন বা সদস্যপদ হারিয়েছেন।
ভোটের পর বিএনপি শপথ না নেওয়ার ঘোষণা দিলে ইসি সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ বলেছিলেন, কেউ ৯০ দিনের মধ্যে শপথ না নিলে ওই আসন শূন্য ঘোষণার পর নতুন নির্বাচনের উদ্যোগ নেবেন তারা।
নানা নাটকীয়তার মধ্যে একাদশ সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেওয়ার পর ফখরুল দুটি আসনে ভোটের লড়াইয়ে নেমেছিলেন। নিজের জেলা ঠাকুরগাঁও-১ আসনে তিনি হারলেও বিজয়ী হন দলীয় প্রধান খালেদা জিয়ার আসন বগুড়া-৬ এ।

৩০ ডিসেম্বরের ওই নির্বাচনে ভোট ডাকাতির অভিযোগ তুলে বিএনপি ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট পুনর্নির্বাচনের দাবি তোলে। সেই সঙ্গে ঘোষণা দেয়, তাদের জোট থেকে বিজয়ীরা শপথ নেবেন না।
কিন্তু কিছু দিন পর ঐক্যফ্রন্ট থেকে বিজয়ী গণফোরামের দুজন শপথ নিয়ে ফেলেন; এরপর গত ২৫ এপ্রিল বিএনপির একজন শপথ নেওয়ার পরও আগের সিদ্ধান্তে অটল থাকার কথাই জানিয়েছিল বিএনপি।
কিন্তু ২৯ এপ্রিল চারজন শপথ নেওয়ার পর ফখরুল সংবাদ সম্মেলন করে জানান, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশে ওই চারজন শপথ নিয়েছেন।
তার শপথের বিষয়ে সোমবারের সংবাদ সম্মেলনে স্পষ্ট কিছু বলেননি ফখরুল; তবে একদিন বাদে জানান, তিনি সংসদে যাচ্ছেন না।
সরকারি কলেজে শিক্ষকতার চাকরি ছেড়ে বিএনপিতে যোগ দিয়ে ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালে সালের নির্বাচনে ঠাকুরগাঁও-১ আসনে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করে পরাজিত হন।
২০০১ সালের নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন ফখরুল; খালেদা জিয়ার সরকারে প্রতিমন্ত্রীও হন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে হারেন। ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি।
এবারের নির্বাচনে বগুড়া-৬ আসনে ধানের শীষ প্রতীকের ফখরুলের সঙ্গে আওয়ামী লীগের কোনো প্রতিদ্ব›দ্বী ছিল না। ওই আসনে মহাজোট থেকে প্রার্থী ছিলেন জাতীয় পার্টির নুরুল ইসলাম ওমর।
শপথগ্রহণ নিয়ে যা বললেন ফখরুল : গতকাল মঙ্গলবার ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বিএনপি মহাসচিব বলেছেন, দল সিদ্ধান্ত বদলেছে বলেই তাদের নির্বাচিত চারজন এমপি হিসেবে শপথ নিয়েছেন। আর দলীয় সিদ্ধান্তেই তিনি শপথ নেওয়া থেকে বিরত থাকছেন। এটা তাদের ‘কৌশলেরই অংশ’।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি থেকে নির্বাচিত ছয়জনের মধ্যে বগুড়া-৬ আসন থেকে নির্বাচিত ফখরুলই কেবল সংসদের বাইরে থাকছেন।
বিএনপি তিন দিন আগেও ওই সিদ্ধান্তে অটল থাকার কথা জানিয়েছিল; সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নেওয়ায় দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল ঠাকুরগাঁও-৩ আসনের জাহিদুর রহমান জাহিদকে।
রাতে এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে এসে ফখরুল বলেন, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশেই বিএনপির সংসদ সদস্যরা শপথ নিয়েছেন। তবে নিজের শপথের বিষয়টি তিনি স্পষ্ট না করায় শুরু হয় নানা ধরনের গুঞ্জন; এর ভিত্তিতে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়।
গতকাল মঙ্গলবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে মানবাধিকার সংগঠন ‘আওয়াজ’ এর এক আলোচনা সভায় এসে নিজের এবং দলের সিদ্ধান্তের বিষয়ে একটি ব্যাখ্যা দেন ফখরুল।
শপথের বিষয়ে দলের সিদ্ধান্ত বদলের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বিএনপি মহাসচিব বলেন, বর্তমানে বিশ্বে রাজনীতির যে ধারা চলছে, তাতে সব সিদ্ধান্ত একেবারে চূড়ান্ত হয়ে থাকবে, স্থবির হয়ে থাকবে- এটা সব সময় ‘সঠিক নয়’ বলেই তারা বিশ্বাস করেন।
ন্যূনতম যে সুযোগটুকু আছে সংসদে কথা বলার সেই সুযোগটিকে কাজে লাগানোর জন্য আমরা সংসদে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এটা নিয়ে অনেকে অনেক রকম কথা বলছেন। তবে আমরা বিশ্বাস করি, এ সিদ্ধান্তটা খুব খারাপ না। আমাদের এই সিদ্ধান্তের পেছনে বড় যুক্তি যেটা- এই সামান্যতম যে স্পেসটা রয়েছে, সেই স্পেসটাকে ব্যবহার করা।
এই সিদ্ধান্ত সঠিক কি না- সময়েই তা প্রমাণ হবে মন্তব্য করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, আমরা বিশ্বাস করি এই সিদ্ধান্তটা সঠিক সিদ্ধান্ত। এখন অনেকে বলতে পারেন তাহলে আগে কেন গেলেন না? আগে করি নাই বলে এখন যে করব না তার তো কোনো মানে নেই। আগে আমরা নিইনি বিভিন্ন প্রেক্ষিতে, এখন আমরা নিচ্ছি বাস্তবতার প্রেক্ষিতে।
সংসদে য­াওয়ার বিষয়ে বিএনপির সিদ্ধান্ত বদলের পেছনে সরকারের সঙ্গে সমঝোতার যে গুঞ্জন রয়েছে, সে বিষয়েও কথা বলেন মির্জা ফখরুল।
তিনি বলেন, বিএনপি সমঝোতা করলে অনেক আগেই করতে পারত। বেগম খালেদা জিয়া যদি সমঝোতা করতেন তাহলে উনি প্রধানমন্ত্রী থাকতেন, অন্য কেউ প্রধানমন্ত্রী হতে পারতেন না, এই কথাগুলো আপনাদের মনে রাখতে হবে।
সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করে নয়, বরং সংসদের ভেতরে-বাইরে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে, জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে আন্দোলন গড়ে তুলতেই বিএনপি সংসদে গেছে বলে দাবি করে দলের মহাসচিব।
‘উন্নয়নের মৃত্যুকূপে জনজীবন ও নুসরাত একটি প্রতিবেদন’ শীর্ষক এই আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন আওয়াজের সভাপতি সেলিমা রহমান।