মি’রাজ : বিশ্বনবীর বিস্ময়কর মু’জিযা

6

মুহাম্মদ জাবেদ হোছাইন

মি’রাজ অর্থ ঊর্ধ্বগমন। ঊর্ধ্বাকাশে ভ্রমণ। বিশ্ববিধাতা তাঁর অপার করুণা ও আপন ইচ্ছায় তাঁরই প্রিয়তম রাসূল বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে স্বীয় নিদর্শনাদি অবলোকন করানোর জন্য তাঁর অতি নিকটে ডেকে নিয়ে যান। মাসজিদুল হারাম থেকে মাসজিদুল আকসা হয়ে রজনীর সামান্যতম সময়ের মধ্যেই গোটা সৃষ্টিজগতের তাবৎ লীলাকান্ড প্রদর্শন করানো হয় নবীজিকে। যা বিশ্ববাসীর কাছে বিস্ময়করই বটে। নবুয়তের দশম বছর। রজব মাস। ছাব্বিশ তারিখ দিবাগত সাতাশতম রাত্রি। রাতের প্রথমার্ধ শেষ হয়েছে। গোটা দুনিয়ায় নেমেছে এক গভীর নিস্তব্ধতা। পশু-পাখি নিজ নিজ নীড়ে নীরব, নিস্তব্ধ। বাতাসের শনশন রব আর ঝরনাধারা পানির কলকল ধ্বনিও অনেকটা স্থমিত হয়ে এসেছে। এমনই এক নীরব মুহূর্তে উঠ উঠ ধ্বনীতে নবীজির ঘুম ভেঙ্গে গেলো। তিনি উঠে বসলেন। দেখলেন স্বর্গীয় দূত এসেছেন। জিবরাইল (আ.)। তাঁর তুষার-শুভ্র ললাট জ্বলজ্বল করছে। মাথায় কোঁকড়ানো চুল। পরনে হীরা-মুক্তা-পান্না খচিত স্বর্গীয় পোশাক। তাঁর দেহের সঙ্গে দুলছে রংবেরঙের অপরূপ অনেক পাখা। আর সঙ্গে ছিল একটি অদ্ভুত ধরনের বাহন। বোরাক। বোরাকের দুই বাহুতেও পাখা ছিল।
বিশ্বনবী (দ.)-কে দেখেই বোরাকটি ঝুঁকে গেল। এভাবেই সে নবীজিকে তার পৃষ্ঠদেশে আরোহণের আবেদন করেছিল। তিনি তাতে আরোহণ করলেন। বোরাক নবীজিকে নিয়ে তড়িৎবেগে বায়ুতে উত্তর দিকে উড়ে চলল। বোরাকের সঙ্গে সঙ্গে হজরত জিবরাইল (আ.)ও উড়ে চললেন। বোরাক চোখের পলকে মক্কার গিরি-পর্বতমালা আর মরুপ্রান্তর অতিক্রম করে সিনাই পর্বতের ঠিক যেই স্থানে হজরত মুসা (আ.)-এর সাথে মহান আল্লাহ কথা বলেছিলেন, সেখানে যাত্রা বিরতি করলো। এরপর পৌঁছালো হজরত ঈসা (আ:) এর জন্মস্থানে। হ্যাঁ, বেথেলহামে। সেখান থেকে বোরাক আবার হাওয়ায় উড়ে চলে। এ সময় মহানবী (দ.) কিছু অদৃশ্য ধ্বনি শুনতে পান। এসব অস্পষ্ট আওয়াজের মাধ্যমে মহানবী (দ.)-কে সফর থেকে বিরত হওয়ার ইঙ্গিত করা হয়। কিন্তু তিনি তখন রিসালাত ও নবুয়তের এমন উচ্চমার্গে অধিষ্ঠিত যে, তিনি বোরাক থামানোর কল্পনাও করেননি। তখন তাঁর ধারণা ছিলো, আল্লাহ তা’আলা ছাড়া আর কারোরই তাঁর এই বাহনটি থামাবার অধিকার নেই। একমাত্র তিনিই যেখানে চাইবেন সেখানে গিয়েই বোরাক থামবে।
বোরাক বায়তুল মাকদাস পৌঁছে থেমে যায়। মহানবী (দ.) নিচে অবতরণ করলেন এবং বোরাকটিকে একটি পাথরের সাথে বেঁধে রাখেন। বায়তুল মাকদাসের তিনি হজরত ইব্রাহীম (আ.), হজরত মুসা (আ.) এবং হজরত ঈসা (আ.)-সহ অসংখ্য নবী (আলাইহিমুস সালাম)-কে নিয়ে হায়কলে সোলায়মানীর ধ্বংসাবশেষের ওপর সালাত আদায় করলেন। সালাতে ইমামতি করলেন তিনি নিজেই। কারণ তিনি সায়্যিদুল মুরসালিন। এরপর তিনি হজরত ইয়াকুব (আ.)-এর পাথরের ওপর উপবেশন করলেন। এবার বোরাক তাঁকে নিয়ে দ্রæতবেগে ঊর্ধ্বাকাশের পানে ছুটে চলে। মহানবী (দ.) প্রথম আসমানে পৌঁছান।
প্রথম আসমান খাঁটি রূপার। তারকারাজি সোনার হালকা রশি দিয়ে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। আসমানের দরজায় প্রহরারত ফেরেশতা দÐায়মান। শয়তান যাতে ওপরে উঠতে না পারে কিংবা কোন জ্বিন যাতে আসমানের গোপন আলাপ-আলোচনা শুনতে না পায়Ñতাই এই ব্যবস্থা। এই আসমানে হজরত আদম (আ.)-এর সাথে বিশ্বনবীর সাক্ষাৎ হয়। তিনি তাঁকে সালাম দেন। এখানে তিনি অসংখ্য মাখলুককে আল্লাহর তাসবিহ পাঠে মশগুল দেখতে পান। এখান থেকে তিনি অন্য ছয় আসমানে পদার্পণ করেন। এ পর্যায়ে হজরত নূহ, ইব্রাহীম, দাউদ, সোলায়মান, ইদরিস, ইয়াহইয়া, হারুন এবং হজরত মুসা (আ.)-এর সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। এই আসমানেই তিনি মৃত্যুদূত হজরত আজরাইল (আ.)-কে দেখতে পান।
আজরাইল (আ.) অত্যন্ত ভয়ংকর আকৃতির। তাঁর চতুর্পাশে লাখ লাখ ফেরেশতা রয়েছেন। তাঁরা সবাই এক বিশাল খাতায় জন্মগ্রহণকারী ও মৃত্যুবরণকারীর নাম লিখছিলেন। সেখানে মহানবী (দ.) অশ্রæর ফেরেশতাকে দেখতে পান। তিনি (ফেরেশতা) সব মানুষের পাপতাপ সম্পর্কে কান্নাকাটি করছেন। নবীজি আযাবের ফেরেশতাকে দেখেন। তাঁর মুখমÐল তামার। তিনি একটি আগুনের আসনে বসে আছেন। আগুন তাঁর নিয়ন্ত্রণে।
বিশ্বনবী (দ.) এখানে আরেকজন ফেরেশতাকে দেখেনÑতাঁর অর্ধেক আগুনে তৈরি এবং বাকি অর্ধেক বরফের। কিছু সংখ্যক ফেরেশতা তাঁর চারদিকে বসে আল্লাহ তা’আলার জিকিরে রত রয়েছেন। তারা আল্লাহ তা’আলার দরবারে এই বলে দু’আ করছিলেন, ‘হে আল্লাহ! তুমি আগুন ও বরফকে একই স্থানে জড়ো করেছ। তোমার সমস্ত বান্দাকেও তোমার আনুগত্য-বন্ধনে আবদ্ধ করো।’ সপ্তম আসমান হচ্ছে ন্যায়পতি ফেরেশতার নিবাসস্থল। পৃথিবীর চেয়েও বিরাটাকার ঐ ফেরেশতার বিশাল দেহে সত্তর হাজার মাথা রয়েছে। প্রতিটি মাথায় সত্তর হাজার মুখ রয়েছে! প্রতিটি মুখে সত্তর হাজার মুখ-গহŸর রয়েছে। প্রতিটি মুখগহŸরে সত্তর হাজার রসনা এবং প্রতিটি রসনায় সত্তর হাজার ভাষা! প্রতিটি ভাষায় সত্তর হাজার রকমের ধ্বনি। আর প্রতিটি ধ্বনিতে মহান আল্লাহর স্তুতিগান ছাড়া আর কিছুই উচ্চারিত হয় না।
রাসুলুল্লাহ (দ.) আল্লাহ তা’আলার এসব কুদরত দেখতে দেখতে সিদরাতুল মুনতাহার শীর্ষদেশ পর্যন্ত পৌঁছান। ‘সিদরাতুল মুনতাহা’ আরশের ডান দিকে অবস্থিত। আরশের ওপর লাখ লাখ ফেরেশতার ছায়া পড়েছিল। এখান থেকে নবীজি আরো ওপরের দিকে উড়ে চললেন। সেখানে বিরাট এক সাগর দেখতে পান। সাগরের পর দেখেন আলো ও অন্ধকারময় মহাশূন্য। এরপর আগুন, পানি ও বাতাসের স্তর পার হয়ে এগিয়ে চলেন। প্রতিটি স্তরের মধ্যবর্তী ব্যবধান হচ্ছে পাঁচশ বছরের পথ! কিন্তু রাসুলুলুøাহ (দ.) আল্লাহর কুদরতে এসব কিছু চোখের পলকে অতিক্রম করেন। এরপর জামালিয়ত, কামালিয়ত এবং জালালিয়ত ও ওয়াহদানিয়তের স্তর অতিক্রমকালে নবীজি সত্তর হাজার ফেরেশতাকে সিজদাবনত অবস্থায় দেখতে পান। তাদের নড়াচড়ার শক্তি নেই। বাকশক্তিও রহিত। এখানে এসে পরম করুণাময়ের অবস্থান খুবই নিকটে আঁচ করতে পেরে মহানবী (দ.) কেঁপে ওঠেন। মর্ত ও আকাশ যেন তাঁর নিকট একাকার হয়ে আছে। এসব যেন মহাশূন্যের সীমাহীন অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছিল। সমগ্র বিশ্বজগতকে বিরাট শস্যক্ষেত্রে ছিটানো একটি সরিষা বীজের মতো ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র মনে হচ্ছিল। এসময় নবীজি আরও অনুভব করেন, মানুষেরও আল্লাহ তা’আলার দরবারে ফেরেশতাদের মতো অনুগত হয়ে সিজদাবনত থাকা উচিত। তারপর মহানবী (দ.) আরশের দিকে এগিয়ে যান। ‘আরশ থেকে দুই ধনুক কিংবা তার চেয়েও নিকটে পৌঁছান’ (সুরা নাজ্ম, আয়াত ৯)। আল্লাহর কুদরতি পবিত্র ভ্রæর সাথে তাঁর ভ্রæ মিলে যায়। তিনি দিব্যদৃষ্টিতে আল্লাহ তা’আরার নূর প্রত্যক্ষ করেন। এসময় তিনি এমন অবস্থা অনুভব করেন যা প্রকাশের অতীত। আল্লাহ তা’আলা তাঁর এক হাত মহানবী (দ.)-এর বুঁকে ও অপর হাত তাঁর কাঁধে রাখেন। তাতে তিনি অত্যন্ত শীতলতা অনুভব করলেন। তাঁর মনে হলো তাঁর পিঠে যেন বরফ লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। এতে তিনি প্রশান্তি অনুভব করেন। মুহূর্তের জন্য নিজেকে তিনি আল্লাহতে বিলীন মনে করলেন। আশেক ও মাশুকের মধ্যে অনেক গোপন কথাবার্তা হয়।
এসময় আল্লাহ তা’আলা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য দৈনিক পঞ্চাশ ওয়াক্ত সালাত ফরজ করেন। এই বিধান নিয়ে নবী করিম (দ.) আল্লাহর দরবার হতে ফিরে আসার পথে নিচের আসমানে হজরত মুসা (আ.)-এর সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। এই বিধানের কথা শুনে তিনি মহানবী (দ.)-কে সতর্ক করেন। হজরত মুসা (আ.) বললেন, ‘আপনি কি আশা করতে পারেন যে আপনার উম্মত দৈনিক পঞ্চাশ ওয়াক্ত সালাত আদায় করতে পারবে? আমি এই ব্যাপারে বনি ইসরাইলকে পরীক্ষা করেছি। তারা পারে নি। অতএব আমি আপনাকে অনুরোধ করছি, আপনি ফিরে যান এবং আল্লাহ তা’আলার নিকট থেকে সালাত কমিয়ে আনুন।’ নবী করিম (দ.) ফিরে যান এবং তাঁর অনুরোধে ক্রমান্বয়ে আল্লাহ তা’আলা সালাত চল্লিশ ওয়াক্তে নামিয়ে দেন। হজরত মুসা (আ.) আরো কম করার জন্য মহানবী (দ.)-কে আবারো আল্লাহ তা’আলার দরবারে পাঠান। এভাবে মহানবী (দ.) বেশ কয়েকবার আল্লাহ তা’আলার দরবারে যাতায়াত করেন এবং সালাতের ওয়াক্ত হ্রাস পেয়ে পাঁচ ওয়াক্ত নির্ধারিত হয়। মূলত প্রিয় হাবিবকে বারবার দেখার জন্যই মহান আল্লাহ তা’আলা এভাবে অল্প অল্প করে সালাতের ওয়াক্ত কমাতে থাকেন। কথিত আছে, মহানবী (দ.) যদি আবারো ফিরে যেতেন তাহলে অবশিষ্ট পাঁচ ওয়াক্তও মাফ করে দেওয়া হতো! কিন্তু মহানবী (দ.) তাতে লজ্জাবোধ করলেন এবং দৈনিক মাত্র পাঁচ ওয়াক্ত সালাত নিজের অনুসারীদের জন্য ফরজ করে নিলেন।
সবশেষে হজরত জিবরাইল (আ.) নবীজিকে জান্নাত ও জাহান্নাম এবং এতদুভয়ের অধিবাসীদের দেখালেন। ভ্রমণ শেষে তিনি নবীজিকে পৃথিবীর দিকে নিয়ে আসেন। বোরাক খুলে মহানবী (দ.) তাতে আরোহণ করে প্রথমে বায়তুল মাকদাস এবং মক্কায় প্রত্যাবর্তন করেন। নবীজির এই ঊর্ধ্বালোকে গমনের কাহিনী কেবল দুনিয়াবাসীকেই বিস্ময়ে হতবাক করেনি; স্বয়ং বিশ্ববিধাতাও তাতে সমান বিস্ময় প্রকাশ করেছেন! তাঁর ভাষায় : ‘সুবহানাল্লাজি! (আশ্চর্যের কথাই তো বটে!) পূত পবিত্র সেই মহামহিম সত্তা যিনি তাঁর প্রিয়তম বান্দাকে রাতের অতি অল্প সময়ে মাসজিদুল হারাম থেকে মাসজিদুল আকসা পর্যন্ত পরিভ্রমণ করিয়েছেন, যার আশেপাশে আমি (আল্লাহ) প্রভূত বরকত ও কল্যাণধারা ঢেলে দিয়েছি যাতে আমার প্রিয় হাবিবকে আমার কুদরতের নিদর্শনাদি (ঘুরে ঘুরে) দেখাতে পারি’ (সুরা বনি ইসরাইল, আয়াত ১)।
লেখক : এম.ফিল. গবেষক